Beta
শনিবার, ১৭ মে, ২০২৫
Beta
শনিবার, ১৭ মে, ২০২৫

ভারত কি পাকিস্তানে হামলায় নিজেদের অবস্থান মজবুত করছে 

India-Pakistan Diplomacy
[publishpress_authors_box]

কাশ্মীরে গত সপ্তাহে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এক ডজনেরও বেশি বিশ্বনেতার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন। 

ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে ১০০টি দূতাবাসের কূটনীতিকরা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ব্রিফিংয়ের জন্য হাজির হয়েছিলেন বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

তবে এই প্রচেষ্টা মূলত ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা প্রশমনের জন্য সহায়তা চাওয়ার উদ্দেশ্যে নয়। 

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্রিফিংয়ে আলোচনায় অংশ নেওয়া চারজন কূটনীতিকের মতে, নয়া দিল্লি বৈরী প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা নেওয়ার ভিত্তি গড়ে তুলছে। 

সরাসরি পাকিস্তানের নাম না করেই, মোদী গত বৃহস্পতিবারের ভাষণে সন্ত্রাসীদের আস্তানা ধ্বংস ও কঠোর শাস্তির প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

পরিস্থিতি কতটা উত্তপ্ত, তার ইঙ্গিত মিলেছে সীমান্তে।

রবিবার ভারতীয় কর্মকর্তারা জানান, সীমান্তে দুই দেশের বাহিনীর মধ্যে প্রায়ই ছোট অস্ত্রের গুলিবিনিময় হয়েছে। এক কর্মকর্তা বলেন, গত তিন রাতের মধ্যে দুই রাতে এ ধরনের গুলিবিনিময় হয়েছে। আরেক কর্মকর্তা জানান, টানা তিন রাত গুলিবিনিময় হয়েছে।

কাশ্মীরে ভারতীয় বাহিনী ব্যাপক ধরপাকড় শুরু করেছে। সন্ত্রাসী হামলার সঙ্গে জড়িতদের সন্ধানে শত শত মানুষকে আটক করা হয়েছে।

এর আগে ভারত পাকিস্তানে পানি সরবরাহ বন্ধের পরিকল্পনার ঘোষণা দেয়। পাকিস্তানের সেচ ব্যবস্থা মূলত উজানের নদীগুলোর ওপর নির্ভরশীল। ভারত পাকিস্তানের দূতাবাসের কয়েকজন কর্মী এবং ভারতে থাকা কিছু পাকিস্তানি নাগরিককে তাৎক্ষণিক দেশে ফেরার নির্দেশও দেয়।

অন্যদিকে পাকিস্তান জানায়, তারা ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে বিদ্যমান দ্বিপক্ষীয় চুক্তিগুলো থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেবে। এর মধ্যে এমন একটি চুক্তি রয়েছে, যা নিয়ন্ত্রণ রেখা সংক্রান্ত সীমান্ত নির্ধারণে প্রভাব ফেলে। এই রেখায় কয়েক বছর ধরে যুদ্ধবিরতি কার্যকর ছিল।

ভারতে মুসলিমবিরোধী মনোভাবও বাড়ছে। বিশেষ করে অন্য শহরে পড়তে যাওয়া কাশ্মীরি শিক্ষার্থীরা ব্যাপক হয়রানির শিকার হচ্ছেন এবং অনেকে বাধ্য হয়ে ঘরে ফিরছেন।

সন্ত্রাসী হামলার পাঁচ দিন পরও ভারত সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে এর জন্য দায়ী কোনও গোষ্ঠীর নাম ঘোষণা করেনি। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অভিযোগের পক্ষে প্রকাশ্যে তেমন কোনও প্রমাণও উপস্থাপন করা হয়নি। পাকিস্তান সরকার হামলার সঙ্গে কোনও সংশ্লিষ্টতা থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কূটনীতিকদের দেওয়া ব্রিফিংয়ে ভারতীয় কর্মকর্তারা পাকিস্তানের অতীতে ভারতবিরোধী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে সহায়তার নজির তুলে ধরেছেন। তারা বলেন, তদন্ত এখনও চলছে। 

এছাড়া গত সপ্তাহের হামলার সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পৃক্ততার ইঙ্গিত দিয়ে প্রযুক্তিগত তথ্য-প্রমাণ, যেমন চেহারা শনাক্তকরণ তথ্যের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে।

বিশ্লেষক ও কূটনীতিকদের মতে, এখন পর্যন্ত দৃঢ় প্রমাণের অভাব দুটি সম্ভাবনার দিকে ইঙ্গিত করে। এক, ভারত আরও তথ্য সংগ্রহের জন্য সময় নিচ্ছে যাতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। দুই, বর্তমান বৈশ্বিক বিশৃঙ্খলার সময় ভারতের মনে হচ্ছে, তাদের পদক্ষেপের জন্য অন্যদের কাছে ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রয়োজন নেই।

ভারত ও পাকিস্তান উভয়েই পরাশক্তিধর দেশ। ফলে সামরিক সংঘর্ষ দ্রুত বড় আকার নিতে পারে এবং তা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হতে পারে। তবে বৈশ্বিক চাপের অভাবে ভারত তার প্রতিক্রিয়া সীমিত করার প্রয়োজনীয়তা তেমন অনুভব করছে না। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতের কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তি বেড়ে যাওয়ায় দেশটি আরও আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছে।

ইরান ও সৌদি আরব দুই পক্ষের সঙ্গে কথা বলেছে। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রকাশ্যে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছেন। জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন সংযম ও সংলাপের আহ্বান জানিয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রধান শক্তিগুলো অন্য সঙ্কটে ব্যস্ত। 

বিশ্লেষকদের মতে, বহু দেশের ন্যায়বিচারের পক্ষে ভারতের প্রতি সমর্থনকে নয়াদিল্লি তার যেকোনও পদক্ষেপের জন্য সবুজ সংকেত হিসেবে দেখছে।

ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তারা ভারতের সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে শক্ত সমর্থন জানিয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছেন, তিনি ভারত ও পাকিস্তান উভয়ের বন্ধু। তবে তিনি স্বীকার করেছেন, দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিনের বিরোধ রয়েছে।

তবে যুক্তরাষ্ট্র এই সংঘাতে কতটা সক্রিয়ভাবে জড়াবে তা স্পষ্ট নয়। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মেয়াদের তিন মাস পার হলেও তিনি এখনও ভারতে কোনও রাষ্ট্রদূত নিয়োগ দেননি। এতে বোঝা যায়, তার অগ্রাধিকার তালিকায় দক্ষিণ এশিয়ার স্থান কতটা নিচে।

যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোনও শক্তি এই সংঘাতে হস্তক্ষেপ করলেও তাদের প্রভাব সীমিত থাকতে পারে। ভারত ও পাকিস্তান একাধিকবার কাশ্মীর ইস্যুতে যুদ্ধ করেছে। দুই দেশই কাশ্মীরকে নিজেদের বলে দাবি করে। নয়াদিল্লি এই বিরোধকে সম্পূর্ণ দ্বিপাক্ষিক বিষয় হিসেবে দেখে।

জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটির সিনিয়র ফেলো ড্যানিয়েল মার্কি বলেন, ট্রাম্প প্রশাসনের বর্তমান প্রতিক্রিয়া ২০১৯ সালের কাশ্মীর ইস্যুতে তাদের আগের প্রতিক্রিয়ার মতো।

সেই সময় একটি হামলায় ডজনখানেক ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য নিহত হয়। হামলাকারীরা পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন জইশ-ই-মুহাম্মদের সঙ্গে যুক্ত ছিল।

তখন ট্রাম্প প্রশাসন প্রকাশ্যে ভারতের প্রতি সমর্থন জানায়। তবে ভারত পাকিস্তানে পাল্টা বিমান হামলা চালানোর পরই সংযমের জন্য কূটনৈতিক চাপ বাড়ানো হয়।

ওই হামলার ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে বিতর্ক ছিল। পরে পাকিস্তান পাল্টা প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে ভারতীয় একটি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করে ও পাইলটকে বন্দি করে।

এই ব্যর্থ প্রতিক্রিয়ার অভিজ্ঞতা থেকে এবার ভারত ‘কিছু নাটকীয়’ করতে পারে বলে জানান ড্যানিয়েল মার্কি। অন্যদিকে পাকিস্তান জানিয়েছে, ভারতের যেকোনও আঘাতের জবাবে তারা আরও শক্তিশালী প্রতিক্রিয়া দেখাবে।

মার্কি বলেন, “প্রতিঘাতের চক্র খুব দ্রুত গতিতে বাড়তে পারে। ভারত ও পাকিস্তান উভয়েই নিজেদের উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতা অতিরিক্ত মূল্যায়ন করে।”

২০১৯ সালের হামলার তুলনায় এবারের হামলার ক্ষেত্রে দায় স্বীকার অনেক অস্পষ্ট। হামলাকারীদের সংখ্যা নিয়েও সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। ভারতের সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, ‘দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট’ নামে একটি কম পরিচিত গোষ্ঠী সোশাল মিডিয়ায় হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে। তবে ভারতীয় কর্মকর্তারা বেসরকারিভাবে জানিয়েছেন, এই গোষ্ঠী পাকিস্তানভিত্তিক সন্ত্রাসী সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বার ছায়া সংগঠন।

এই অনিশ্চয়তা হয়তো ব্যাখ্যা করে, কেন ভারত এখন পাকিস্তানের অতীত সন্ত্রাসবাদের সহায়তার নজিরের ওপর ভিত্তি করে সামরিক প্রতিশোধের যুক্তি দিচ্ছে। তবে যথেষ্ট প্রমাণ ছাড়াই এমন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া নিয়ে কূটনৈতিক মহলে প্রশ্ন উঠেছে। 

ভারতের সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশংকর মেনন বলেছেন, ২০১৬ ও ২০১৯ সালের সন্ত্রাসী হামলার পর পাকিস্তানে পাল্টা হামলা চালানোর নজির থাকার কারণে মোদির কাছে এবারও সামরিক প্রতিক্রিয়ার বিকল্প কম। 

তিনি বলেন, ভারত সরকার এমন এক অঞ্চলে বড় নিরাপত্তা ব্যর্থতার জন্য চাপের মুখে রয়েছে, যেটিকে তারা সাম্প্রতিক সময়ে পরিবর্তিত ও পর্যটনের জন্য উপযোগী এলাকা হিসেবে তুলে ধরছিল।

তবে মেনন মনে করেন, দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের মধ্যে পাল্টাপাল্টি প্রতিক্রিয়া অতিমাত্রায় বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা কম।

তিনি বলেন, “আমি খুব বেশি উদ্বিগ্ন নই। কারণ দুই পক্ষই নিয়ন্ত্রিত শত্রুতা বজায় রাখার অবস্থায় বেশ সন্তুষ্ট।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত