ইসলামিক স্টেটসের নাম প্রায় হারিয়েই গিয়েছিল আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম থেকে; কিন্তু ইরানে ভয়াবহ হামলার পর ফিরে এল জঙ্গি গোষ্ঠীটির নাম।
গত বুধবার ইরানে জোড়া বোমা বিস্ফোরণে অর্ধ শতাধিক মানুষের মৃত্যুর ঘটনায় আইএস দায় স্বীকার করে বার্তা দেওয়ার পর আবারও আলোচনায় গোষ্ঠীটির নাম।
আইএসের প্রতিষ্ঠা ২০১৩ সালের এপ্রিলে। শুরুতে এর নাম ছিল ইসলামিক স্টেট ইন ইরাক অ্যান্ড লেভান্ত (আইএসআইএল)। পরে নাম পরিবর্তন করে হয় ইসলামিক স্টেট। ইরাক ও সিরিয়ার বিশাল অঞ্চলজুড়ে ‘খিলাফত’ প্রতিষ্ঠাই ছিল তাদের লক্ষ্য।
কিন্তু ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ইরান ও তুরস্কের অভিযানের মুখে আঞ্চলিকভাবে সংগঠনটির পতন হয়। কাগজে কলমে আইএস না থাকলেও আদর্শিক এবং যোগাযোগের জায়গা থেকে সংগঠনটি এখনও টিকে আছে। এখনও সংগঠনটিকে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নিরাপত্তার হুমকি হিসেবে দেখা হয়।
তবে প্রশ্ন উঠেছে, হঠাৎ করে ইরানে কেন আইএস হামলা চালাল। এর পেছনের উদ্দেশ্য কী?
ইরানেই কেন হামলা
আইএসের মিডিয়া আল-ফুরকান বলছে, বুধবার ইরানে হামলা চালিয়েছে ওমর আল মওয়াহিদ এবং সায়েফুল্লাহ আল মুজাহিদ নামের দুই ভাই। কেন এই হামলা চালানো হয়েছে এর ব্যাখ্যায় তারা শিয়া বিদ্বেষের বিষয়টি উল্লেখ করেছে। আইএসের শিয়াবিদ্বেষ নতুন কিছু নয়।
২০২২ সালের অক্টোবরে আইএসের খোরাসান শাখার এক বন্দুকধারী ইরানের শিরাজ শহরে হামলা চালায়। এতে ১৩ জন বেসামরিক নিহত হয়।
এমন হামলা অতীতেও ইরানে হয়েছে। কিন্তু এবারের হামলা কি শুধু শিয়াবিদ্বেষ, নাকি এর পেছনে আরও কোনও উদ্দেশ্য আছে?
এই প্রশ্ন এখন ঘুরে ফিরে আসছে। কারণ এমন এক সময়ে ইরানে হামলা হলো, যখন ইরান ইয়েমেনের হুতিদের প্রতি পুনরায় সমর্থন ব্যক্ত করেছে, গাজা যুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের পক্ষেও বিবৃতি দিয়েছে।
গাজা-ইসরায়েল যুদ্ধে হামাসের পেছনে ইরানের সমর্থন রয়েছে, এমন অভিযোগ ইসরায়েলের। আবার লোহিত সাগরে বাণিজ্যিক জাহাজে হুতিদের হামলার পেছনেও ইরান রয়েছে, এমন অভিযোগ করছে হোয়াইট হাউস। তেহরানকে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার দিকে নজর দিতেই এই হামলা করা হয়েছে কি না, তাও বিবেচনার বিষয়।
হামলাটি হয় তেহরানের সাবেক জেনারেল কাসেম সুলেইমানির চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে। মধ্যপ্রাচ্যে আইএসের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর ক্ষেত্রে কাসেম সুলেইমানির ব্যাপক ভূমিকা ছিল। তার নেতৃত্বাধীন কুদস ফোর্স ইরাক ও সিরিয়ায় আইএসের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল।
মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক বিশ্লেষকদের মতে, মধ্যপ্রাচ্যে আইএসকে খিলাফতের বাসনা ত্যাগ করতে হয়েছিল সুলেইমানির কারণে। আঞ্চলিক সীমান্ত লড়াইয়ে তার অবদান অনেক। একই সঙ্গে তার কারণেই মধ্যপ্রাচ্যে শিয়া মিলিশিয়াদের নতুন করে উত্থান ঘটে, যা যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্রদের মাথাব্যথার কারণ।
আইএসের টিকে থাকার কৌশল
বৈশ্বিক ‘খিলাফত’ প্রতিষ্ঠা করতে চায় সংগঠনটি। শুরুতে এই খিলাফত শুরু মধ্যপ্রাচ্যে সীমিত ছিল। কিন্তু ২০১৯ সালে পরাজয়ের পর এর ব্যপ্তি পায়। সংগঠনটি তখন একাধিক সম-মতাদর্শিক দলের মধ্যে নিজেদের কার্যক্রম বিস্তৃত করতে শুরু করে। নাইজেরিয়া, কঙ্গো, মোজাম্বিক, সাহেল এবং আফগানিস্তান এর অন্যতম উদাহরণ।
কৌশল হিসেবে তারা সেই দেশগুলো বেছে নেয় যেখানে সরকার অতটা শক্তিশালী নয়। ওই দেশগুলোর প্রত্যন্ত অঞ্চলে নিজেদের মতাদর্শ প্রচারে মনোযোগ দেয় তারা। প্রত্যেকটি জায়গাতেই তারা স্থানীয় ইসলামপন্থি সশস্ত্র সংগঠনগুলোর ওপর ভর করতে শুরু করে। এতে স্থানীয় সংগঠনগুলোও সুবিধা পায়। তাদের কর্মকাণ্ড তখন আইএস এর ব্যানারে হতে থাকে।
এভাবেই আইএস তাদের বৈশ্বিক খিলাফত পশ্চিম থেকে পূর্বে, উত্তর থেকে দক্ষিণে ছড়িয়ে দিচ্ছে। এক্ষেত্রে তারা এখন সোশাল মিডিয়া প্লাটফর্মগুলো ব্যবহার করছে। এসব প্লাটফর্ম থেকে তারা নতুন সদস্য ও তহবিল সংগ্রহ এবং হামলার পরিকল্পনা করছে।
কর্মী সংগ্রহের ক্ষেত্রে নিজেদের নেতাদের সত্যিকারের পরিচয় গোপন রাখার কৌশলকে কাজে লাগিয়েছে। আইএসের প্রতিষ্ঠাতা বলা হয় বাগদাদিকে। তার সঠিক পরিচয় কিন্তু এখনও ধোঁয়াশাচ্ছন্ন। একই অবস্থা দলটির অন্য অনেক শীর্ষ নেতাদের ক্ষেত্রেও। পরিচয় গোপন রাখার এই কৌশল তাদের সমর্থক বাড়াতে সাহায্য করেছে বলে মনে করেন বিবিসির সাংবাদিক মিনা আল লামি।
অনুকূল ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি
বৈশ্বিক অস্থিতিশীলতার সুযোগ নিচ্ছে আইএস। রাশিয়া, চীন, ইরান, ইউক্রেন, যুক্তরাষ্ট্র, মিয়ানমারসহ আরও অনেক দেশ এখন অস্থিতিশীল। মালি থেকে নিজেদের সৈন্য প্রত্যাহার করেছে ফ্রান্স, আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্র-ইউরোপ। এই শূন্যতা নিজেদের অস্তিত্বের জানান দিতে সহায়তা করেছে আইএসকে।
রাশিয়ার ভাড়াটে যোদ্ধা ওয়াগনার গ্রুপ যখন ক্রিমিয়ায় অভিযান চালায় তখন আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় তাদের হাতে মুসলিম নিধনের বিষয়টি সামনে আসে। এই প্রচারকে কাজে লাগায় সন্ত্রাসী দলটি। এখন তো রাশিয়ার পকেট এলাকাতেও আইএসের ছোট ছোট হামলার খবর পাওয়া যায়, আগে যা ছিল না।
চলমান গাজা-ইসরায়েল যুদ্ধের কারণে ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনাও অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছে সংগঠনটির জন্য। এই যুদ্ধের মধ্যে একাধিকবার সংগঠনটির নাম এসেছে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তো হামাসকে আইএসের সঙ্গেই তুলনা করেন।
মধ্যপ্রাচ্যের ছায়াযুদ্ধে আইএস কারও ছায়া?
আইএস একটি সুন্নি মুসলিম সংগঠন। মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরব অনেক সুন্নি মুসলিম গ্রুপের সমর্থনদাতা রাষ্ট্র। আর আঞ্চলিকভাবে ইরান এবং সৌদি আরব প্রতিদ্বন্দ্বী। ফলে আইএস কোনও পক্ষের ছায়া হয়ে ইরানকে বার্তা দিতে এই হামলা করতে পারে। এমন সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না বিশ্লেষকরা।
কাউন্সিল ফর ফরেন রিলেশনসের জ্যেষ্ঠ ফেলো রায় তাকিয়াহ বলেছেন, “এটা সম্ভব যে, ইসরায়েলের ছত্রছায়ায় থাকা দলগুলোর একটি ওই হামলা চালাতে পারে।”
ইসরায়েলের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্ক এখন আগের তুলনায় অনেক ভালো।
আইএসের সর্বশেষ অবস্থা
বুরকিনা ফাসো, মালি, নাইজার, নাইজেরিয়া, বেনিন, ঘানা, সেনেগাল, টোগো, পাকিস্তান, আফগানিস্তানে আইএসের কার্যক্রম রয়েছে। গত বছরের আগস্টে নিহত হয় সংগঠনটির প্রধান নেতা আবু হুসেইন আল হুসেইনি আল কুরেশি। তুরস্ক দাবি করে, তাদের হাতে নিহত হন কুরেশি।
কিন্তু আইএসের দাবি, সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় ইদলিব প্রদেশে হায়াত তাহরির আল-শাম নামক একটি গ্রুপের সঙ্গে লড়াইয়ের সময় নিহত হয় কুরেশি। এরপর দলটি নতুন নেতা নির্বাচিত করে আবু হাফস আল হাশিমি আল কুরেশি নামের একজনকে। তার সম্পর্কে খুব বেশি জানা যায় না। আল জাজিরার প্রতিবেদনে জানা যায়, হাশিমি ছিলেন সংগঠনের পঞ্চম শীর্ষ নেতা।
সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের অধিকাংশই যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্ক এবং রাশিয়ার অভিযানে নিহত হয়েছেন।
সংবাদমাধ্যমে আইএস
আইএস এখনও সক্রিয় বলেই জানা যাচ্ছে, যদিও তাদের কর্মকাণ্ড সবসময় আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে স্থান পায় না। বিভিন্ন দেশের আঞ্চলিক সংবাদ মাধ্যম ঘাঁটলে দেখা যাবে, প্রায়ই আইএস ছোটখাটো হামলা চালাচ্ছে বিভিন্ন জায়গায়।
সিরিয়ায় গত ৮ নভেম্বরে আইএসের হাতে ৩০ সরকারপন্থি মিলিশিয়া নিহত হয়। এনিয়ে আল জাজিরা একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, সিরিয়ার রাকা, হোমস ও দেইর এজ জরে নিয়মিতই সরকারি বাহিনী আইএসের হামলার শিকার হচ্ছে।
গত ডিসেম্বরের ৯ তারিখ টাইমস অব ইন্ডিয়া আইএস নিয়ে একটি প্রতিবেদন ছাপায়। সেখানে বলা হয়, মহারাষ্ট্রের কাছের একটি গ্রাম থেকে ১৫ আইএস কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা ওই গ্রামকে ‘স্বাধীন অঞ্চল’ ঘোষণা করেছিল।
একই মাসের ১০ তারিখ যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডোতে এক কিশোরকে গ্রেপ্তার করা হয় আইএস সম্পৃক্ততার জন্য। এবিসি নিউজ স্থানীয় পুলিশের উদ্ধৃতি দিয়ে জানায়, ওই কিশোর আইএসে যোগ দিতে ডেনভারের একটি ফ্লাইটে উঠেছিল। তার নাম হুমজাহ মাশকুর।
দ্য ডনের গত ৩ জানুয়ারির প্রতিবেদনে বলা হয়, পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদের খাইবার পাখতুনখাওয়ার আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে আইএস হুমকি মোকাবেলায় চিন্তিত। সেনেটে এনিয়ে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।
সূত্র : দ্য গার্ডিয়ান, টাইমস অব ইন্ডিয়া, এবিসি নিউজ, সেন্টার ফর স্ট্রাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ।