নেপালের অপসারিত রাজা জ্ঞানেন্দ্রকে কাঠমাণ্ডুতে রাজকীয় কায়দায় অভ্যর্থনা দেওয়া হলো। তাকে স্বাগত জানাতে এত মানুষ বিমানবন্দরে ছিলেন যে গোটা রাজধানী কয়েক ঘণ্টার জন্য অচল হয়ে গিয়েছিল।
দেশটির একাধিক সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, জ্ঞানেন্দ্রকে স্বাগত জানাতে কয়েক হাজার নেপালি কাঠমাণ্ডুর বিমানবন্দরে জড়ো হয়েছিলেন।
৭৭ বছর বয়সী জ্ঞানেন্দ্রকে বিপুল সংখ্যক জনতা উচ্ছ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করে। তারা তার পক্ষে স্লোগান দেয়। এসময় তাদের বিভিন্ন স্লোগান লেখা প্ল্যাকার্ড বহন করার পাশাপাশি গানও গাইতে শোনা যায়।
প্রায় দুই দশক আগে আন্দোলনের জেরে রাজা জ্ঞানেন্দ্রকে ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছিল। পরে দেশটির পার্লামেন্ট রাজতন্ত্র বিলুপ্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জ্ঞানেন্দ্র পোখারা থেকে কাঠমাণ্ডুতে ফিরেছেন। তিনি গত দুই মাস ধরে সেখানে অবস্থান করছিলেন। তিনি এসময় বিভিন্ন ধর্মীয় স্থান পরিদর্শন করেন। সিমরিক এয়ারের হেলিকপ্টারে করে কাঠমাণ্ডু পৌঁছান তিনি।
ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে রাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র পার্টির (আরপিপি) শীর্ষ নেতারা ও কর্মীরা তাকে স্বাগত জানান। ১৯৯০-এর দশকে রাজতন্ত্রপন্থীরা আরপিপি দলটির সূচনা করেন। এখনো এটি রাজতন্ত্র পুনর্বহালের পক্ষে সবচেয়ে শক্তিশালী দল।
সিএনএন জানিয়েছে, জ্ঞানেন্দ্রকে স্বাগত জানাতে প্রায় ১০ হাজার রাজতন্ত্র সমর্থক বিমানবন্দরে হাজির হয়েছিল। এশিয়া নিউজ নেটওয়ার্কের তথ্য অনুযায়ী, এতে আরপিপি সভাপতি রাজেন্দ্র লিঙ্গদেন, রাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র পার্টি-নেপালের প্রধান কমল থাপা ও অন্য জ্যেষ্ঠ নেতারা অংশ নেন।
এসময় অত্যাধিক ভিড়ের কারণে যাত্রীদের বিমানবন্দরে আসা-যাওয়া হেঁটেই করতে হয়।
কাঠমাণ্ডু বিমানবন্দর থেকে নির্মল নিবাস পর্যন্ত শত শত নিরাপত্তাকর্মী মোতায়েন করা হয়। নির্মল নিবাস কাঠমাণ্ডুর উপকণ্ঠে অবস্থিত। আর এটি সাবেক রাজা জ্ঞানেন্দ্রের ব্যক্তিগত বাসভবন।
বিমানবন্দরের বাইরে রাজতন্ত্রপন্থীরা মোটরসাইকেলে করে জ্ঞানেন্দ্রের ছবি ও জাতীয় পতাকা বহন করে তাকে অভ্যর্থনা জানান।
সমর্থকরা বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে ছিলেন। তাতে লেখা ছিল— ‘আমরা আমাদের রাজাকে ফিরে পেতে চাই’, ‘রাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা কর’, এবং ‘রাজা ও দেশ আমাদের জীবনের চেয়েও দামি’।
উপস্থিত জনতা নেপালে রাজতন্ত্র ফিরিয়ে আনা এবং হিন্দুধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম হিসাবে পুনর্বহালের দাবিও জানায়।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে জ্ঞানেন্দ্রের প্রতি ব্যাপক সমর্থন দেখা গেছে।
এদিকে একসময়কার নেপালের রাজপ্রাসাদ ‘নারায়ণহিটি প্রাসাদ জাদুঘর’ এর সামনে দাঙ্গা পুলিশের সদস্যরা সতর্ক অবস্থানে ছিলেন। গুজব ছড়িয়েছিল জ্ঞানেন্দ্র তার সমর্থকদের সঙ্গে ওই রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করবেন। কিন্তু তিনি সরাসরি নির্মল নিবাসে যান।
এমন গুজব ছড়ানোর কারণও অবশ্য ছিল। জমায়েতের মধ্যে থেকে বারবার স্লোগান দেওয়া হচ্ছিল- ‘আমাদের প্রাণের রাজা দীর্ঘায়ু হোন’, ‘রাজার জন্য রাজপ্রাসাদ খালি করে দাও’। গোটা কাঠমাণ্ডুর রাস্তায় রাস্তায় ধ্বনিত হচ্ছিল এই স্লোগান।
নেপালের স্থানীয় একটি পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিমানবন্দর থেকে নিজের বাসভবনে পৌঁছাতে জ্ঞানেন্দ্রর প্রায় আড়াই ঘণ্টা লেগেছে, যদিও দূরত্ব মাত্র পাঁচ কিলোমিটার। এসময় কিছু সমর্থক দেশটির বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কমিউনিস্ট নেতা কে পি শর্মা ওলির বিরুদ্ধে স্লোগান দেন।
২০০৬ সালে জ্ঞানেন্দ্রকে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছিল। সেই সময়ের তুলনায় বর্তমান পরিস্থিতিতে এক বিশাল পরিবর্তন হিসেবে দেখা হচ্ছে।
জ্ঞানেন্দ্রর উত্থান-পতন
জ্ঞানেন্দ্র ২০০২ সালে নেপালের রাজা হন। এর আগে তার বড় ভাই বীরেন্দ্র বীর বিক্রম শাহ দেব ও তার পরিবার রাজপ্রাসাদে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। তখন জ্ঞানেন্দ্র নির্বাহী ক্ষমতা ছাড়াই সাংবিধানিক রাজা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৫ সালে তিনি সম্পূর্ণ ক্ষমতা নিজের হাতে নেন।
তিনি সরকার ও পার্লামেন্ট বাতিল করেন। রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিকদের কারাগারে পাঠান এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করেন। এরপর দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে সেনাবাহিনীর মাধ্যমে শাসন চালান।
নেপালে ১৯৯০ সালের আগে রাজনৈতিক দল গঠনের অনুমতি ছিল না। তবে গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলনের ফলে নির্বাচন চালু হয় এবং রাজতন্ত্র শুধু প্রতীকী ক্ষমতায় সীমিত হয়ে পড়ে। তবে ২০০৬ সালে ব্যাপক জনবিক্ষোভের মুখে জ্ঞানেন্দ্র ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন।
আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জ্ঞানেন্দ্র তখন একটি বহুদলীয় সরকারকে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। পরে ওই সরকার মাওবাদীদের সঙ্গে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করে। এই চুক্তির মাধ্যমে ১০ বছর ধরে চলা গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটে, যাতে হাজারো মানুষের প্রাণ গিয়েছিল।
নেপালের পার্লামেন্ট ২০০৮ সালে রাজতন্ত্র বিলুপ্তির পক্ষে ভোট দেয়। এর মধ্য দিয়ে দেশটিতে ২৪৯ বছরের রাজতন্ত্রের অবসান হয়। জ্ঞানেন্দ্র ক্ষমতা ছাড়েন এবং সাধারণ মানুষের মতো জীবনযাপন শুরু করেন। এরপর থেকে তিনি কোনও সরকারি নিরাপত্তা কিংবা সুবিধা পাচ্ছেন না।
ততদিনে নেপাল একটি ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়। তবে পরিস্থিতি মোটেও সহজ ছিল না।
ক্রমাগত অসন্তোষ
২০০৮ সালে রাজতন্ত্র বিলুপ্ত হওয়ার পর নেপালে ১৩টি সরকার পরিবর্তন হয়েছে। অধিকাংশ নেপালি তাদের প্রজাতন্ত্র ব্যবস্থা নিয়ে হতাশ।
তারা মনে করেন, এটি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনতে ব্যর্থ হয়েছে। পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক সঙ্কট ও ব্যাপক দুর্নীতির জন্যও এটিকে দায়ী করা হচ্ছে।
সাবেক রাজা জ্ঞানেন্দ্রের সমর্থকরা নেপালের বিভিন্ন এলাকায় সমাবেশ করছেন। গত ফেব্রুয়ারিতে গণতন্ত্র দিবসের পর থেকে রাজতন্ত্রপন্থীদের আন্দোলন আরও তীব্র হয়েছে। জ্ঞানেন্দ্র বলেন, “দেশ রক্ষা ও জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব নেওয়ার সময় এসেছে।”
সমাবেশে অংশগ্রহণকারীরা রাজনৈতিক পরিবর্তনের আশা করছেন। তারা চান দেশ আরও অবনতির হাত থেকে রক্ষা পাক।
রাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবিতে সমর্থকদের বক্তব্য
৭২ বছর বয়সী থির বাহাদুর ভাণ্ডারী বলেন, “আমরা রাজাকে পূর্ণ সমর্থন দিতে এসেছি। তাকে সিংহাসনে পুনর্বহাল করতে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো।”
শিক্ষক রাজিন্দ্র কুনওয়ার এএফপিকে বলেন, “দেশে অস্থিরতা চলছে। মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে, মানুষ বেকার, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা সঙ্কটে রয়েছে। গরিবরা না খেয়ে মরছে। আইন শুধু সাধারণ মানুষের জন্য প্রযোজ্য, কিন্তু রাজনীতিবিদদের জন্য নয়। তাই আমাদের রাজাকে ফিরে চাই।”
সমাবেশে অংশ নেওয়া ৫০ বছর বয়সী কুলরাজ শ্রেষ্ঠা একসময় রাজতন্ত্রের বিরোধী ছিলেন। ২০০৬ সালের আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। কিন্তু এখন তার মত বদলেছে।
তিনি বলেন, “দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো ব্যাপক দুর্নীতি। ক্ষমতায় থাকা রাজনীতিবিদরা দেশের জন্য কিছুই করছেন না।
“আমি ভেবেছিলাম রাজতন্ত্র অপসারণে দেশ উপকৃত হবে। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম। দেশ আরও গভীর সঙ্কটে পড়েছে। তাই আমি এখন রাজতন্ত্রকে সমর্থন করি।”
বলিউড তারকা মনীষা কৈরালা হলেন নেপালের প্রথম নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী বি পি কৈরালার নাতনি। সোশাল মিডিয়ায় তিনি সব নেপালিকে সাবেক রাজাকে স্বাগত জানাতে কাঠমাণ্ডু বিমানবন্দরে আসার আহ্বান জানান।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জ্ঞানেন্দ্রকে সরাসরি রাজনীতিতে যোগ দিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার চ্যালেঞ্জ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ওলি।
রাজতন্ত্রপন্থী গোষ্ঠীগুলো বড় রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর দুর্নীতি ও ব্যর্থ শাসনের অভিযোগ এনেছে। তবে জ্ঞানেন্দ্র রাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবির বিষয়ে এখনও কোনও মন্তব্য করেননি। বিশ্লেষকরাও নিকট ভবিষ্যতে জ্ঞানেন্দ্রের ক্ষমতায় ফেরার সম্ভাবনা দেখছেন না।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক লোক রাজ বরাল এএফপিকে বলেন, “আমি রাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার কোনও সম্ভাবনা দেখি না। কারণ এটি একসময় দেশকে অস্থিতিশীল করেছিল। কিছু অসন্তুষ্ট গোষ্ঠীর জন্য এটি আশ্রয়ের জায়গা হয়ে উঠেছে। কারণ রাজনীতিবিদদের অযোগ্যতা বেড়েছে এবং তারা ক্রমেই আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছেন। এই হতাশার প্রকাশই এসব সমাবেশ ও বিক্ষোভে দেখা যাচ্ছে।”
তবে বিশ্লেষকরা যাই বলুন না কেন, আসল ফয়সালা নেপালি জনগণের হাতে। দেশটির সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকেও জনগণের রায়কেই চূড়ান্ত বলে মানা হবে, এমনটা বলা হয়েছে। এখন সবকিছু নির্ভর করছে নেপালের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মতামতের ওপর।