ভ্যালেন্সিয়ার অধিবাসী র্যামন রুবিও পেশায় ছিলেন ব্যাংক কর্মচারি এবং ব্যবসায় প্রশাসন বিষয়ের অধ্যাপক। ২০ শতকের মাঝামাঝি সময়ে রুবিও একটি একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন। যার কাজ ছিল পেশাগত জীবনে যে তরুণরা হিসাবরক্ষক হতে চান তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া। ক্লাসে ছাত্রদের অর্জিত জ্ঞানকে আরও ফলপ্রসু করতে তিনি এক অভিনব পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন। যার নাম তিনি দিয়েছিলেন ‘কার্ড সিস্টেম’। এই সিস্টেম বা পদ্ধতির মাধ্যমে ছাত্ররা বাড়িতে বসেই তাদের অ্যাকাউন্টিং এবং হাতের লেখার দক্ষতা ঝালিয়ে নিতে পারতো।
সময়ের সাথে সাথে নানা ধাপ পেরিয়ে এই ‘কার্ড সিস্টেম’ আজকে রুবিও নোটবুক হিসেবে পরিচিত। ১৯৭০ সাল থেকে এই পদ্ধতি হাতের লেখা সহজ এবং দ্রুততর করতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। হাতে লেখার ওপর যারা জোর দিতে চান তারা অনেক প্রজন্ম ধরে এই পদ্ধতির কাছে বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ। পদ্ধতিটিকে তারা রুবিওর দূরদর্শিতা হিসেবে দেখেন।
রুবিওর নোটবুক ব্যবহার করে যে অক্ষরগুলো বানানো হতো সেগুলো ছিল ক্লাসিক যুক্ত অক্ষর। যেখানে প্রতিটি অক্ষর একটির সঙ্গে আরেকটি এমনভাবে যুক্ত যাতে পেন্সিল না তুলেই একেকটি শব্দ লিখে ফেলা যায়। তবে বলে রাখা দরকার, পদ্ধতিটি আজকের বহুল চর্চিত ‘স্ক্রিপ্ট টাইপফেস’ থেকে আলাদা ছিল। অক্ষরগুলোতে কোন সংযুক্ত রেখা ব্যবহৃত না হয়েও তা ছিল দ্রুত লেখার এক কার্যকর পদ্ধতি।
স্কুলে এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা একসময় তাদের অ্যাসাইনমেন্ট এবং ক্লাস নোটগুলি হাতেই লিখত। কিন্তু সেই তারাই এখন ট্যাবলেট, ল্যাপটপ বা কম্পিউটারে ওই কাজগুলো করে। অবশ্য বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্রটা এখনো বেশিরভাগ বিভাগগুলোতে আগের মতোই আছে। তারপরও সেটা গত ১০ বছরে তো অনেকটাই কমেছে এমন হলফ করে বলা যায়।
হাতে লেখার চর্চার এই অভাবটি আমাদের টানা হাতের লেখায় ফুটে উঠছে। এক অক্ষরকে আরেক অক্ষরের সঙ্গে যুক্ত করার যে মাত্রা তা হারিয়ে নতুন ধারা বিকশিত হয়েছে এই শিল্পটিতে।
হাতের লেখার এই পরিবর্তনটি বোঝার জন্য আমরা যে কারও হাতের লেখা পালটে যাওয়ার নির্ধারকগুলো নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করে দেখতে পারি। শৈশবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আমাদের হাতের লেখার সুস্পষ্টতার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হলেও বড় বেলায় হাতের লেখার এই পরিষ্কার আর ঝরঝরে ব্যাপারটি আর থাকেনা।
তারপর কৈশোরে যেটা হয়, প্রত্যেকেই তাদের হাতের লেখার প্যাটার্ন থেকে কিছুটা সরে এসে একান্ত নিজের একটা স্বতন্ত্র প্রকৃতি দাঁড় করায়। বয়স এবং ব্যক্তিত্বের বিকাশের সঙ্গে হাতের লেখার পরিবর্তনের ঘনিষ্ঠ যোগ আছে। ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের নানা বৈশিষ্ট্য তার পরিবর্তিত হাতের লেখায় ধীরে দৃশ্যমান হতে শুরু করে।
তাহলে হাতের লেখা যদি আমাদের ব্যক্তিত্ব এবং অভিজ্ঞতার প্রতিফলন হয় তাহলে এটাও মেনে নিতে হয় যে ডিজিটালাইজেশন আমাদের হাতের লেখাকেও ব্যাপকভাবে পালটে দিয়েছে। কারণ আমরা যতটা না কাগজে লিখছি, তার চেয়েও বেশি লিখছি ফোন, ট্যাবলেট, ল্যাপটপ এবং পিসিতে। অবশ্য এর অর্থ এই নয় যে হাতের লেখা বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে।
তবে টাইপ করে লেখার চেয়ে হাতের লেখার নাকি বেশ কিছু সুবিধা রয়েছে। বেশ কয়েকটি গবেষণা অন্তত তাই নিশ্চিত করেছে। ভাষাবিদ হোসে আন্তোনিও মিলান, তার প্রবন্ধ “দ্য স্ট্রোক দ্যাট স্পিক” এ লিখেছেন হাতের লেখার জন্য মস্তিষ্কের ব্যাপক ব্যবহারের প্রয়োজন হয়।
অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি) এর একটি প্রতিবেদন বলছে, যে শিক্ষার্থীদের পত্রিকা পড়ার অভ্যাস আছে তাদের মুখস্থ করবার ক্ষমতা, যারা ইলেকট্রনিক ডিভাইসে খবর পড়ে তাদের চেয়ে বেশি। ফলে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, মানুষের মনে রাখার ক্ষমতার সঙ্গে স্পর্শ কেন্দ্রিক সংবেদনশীলতার সম্পর্ক আছে। এই সম্পর্ক কাগজে কলমে লেখার সঙ্গেও সম্পর্কিত।