নির্বাচনী প্রচারে আমেরিকানদের সমৃদ্ধির নতুন যুগে নিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করেছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। কিন্তু বিপুল ভোটে জয় পেয়ে ক্ষমতায় বসার দুই মাসের মাথায় ভিন্ন কথা বলছেন এই রিপাবলিকান নেতা।
দ্বিতীয় মেয়াদে হোয়াইট হাউসে বসে যেখানে তার নির্বাচনী ওয়াদা পূরণের কথা ছিল, সেখানে তিনি ভবিষ্যৎ নিয়ে সতর্ক করছেন আমেরিকানদের।
তিনি বলেছেন, জিনিসপত্রের দাম সহসাই কমানো কঠিন। যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ দেশে ফেরত আনার আগ পর্যন্ত জনগণ যেন ‘সামান্য বিশৃঙ্খলার’ জন্য প্রস্তুতি নেয়।
এদিকে বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রে মন্দার আশঙ্কা বাড়ছে। আর এজন্য তারা ট্রাম্পের নীতিকেই দায়ী করছেন।
প্রশ্ন উঠেছে, অর্থনৈতিক অগ্রগতির বাণী শোনানো ট্রাম্প কি তাহলে বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির দেশে মন্দা ডেকে আনছেন?
পুঁজি বাজারের পতন
বেকারত্বের হার বৃদ্ধি ও আয়ের পরিমাণ কমে যাওয়ার মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক কার্যক্রমে দীর্ঘকালীন ও ব্যাপক আকারে পতনকে যুক্তরাষ্ট্রে মন্দা পরিস্থিতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
দেশটি যে এমন পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে, তা অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা সম্প্রতি সতর্ক করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান জেপি মরগানের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে মন্দার আশঙ্কা ৪০ শতাংশ বলা হয়েছে, যা চলতি বছরের শুরুতে ছিল ৩০ শতাংশ।
প্রতিবেদনে সতর্ক করে এও বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের নীতি প্রবৃদ্ধির বিপরীতে ঝুঁকছে।
আরেক আর্থিক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান মুডি’স অ্যানালাইটিকসের প্রধান অর্থনীতিবিদ মার্ক জ্যান্ডি ১৫-৩৫ শতাংশ মন্দার আশঙ্কা করছেন।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ও এশিয়ার পুঁজি বাজারে যে অস্থিরতা দেখা গেছে, তার আংশিক দায় ট্রাম্পের নতুন শুল্ক নীতি।
গত জানুয়ারিতে ক্ষমতা নিয়েই যুক্তরাষ্ট্রের তিন বৃহৎ বাণিজ্যিক অংশীদারের পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করেন তিনি; যা দেখে বিশ্লেষকদের ধারণা হয়, প্রেসিডেন্টের এই শুল্ক নীতি জিনিসপত্রের দাম বাড়াবে এবং প্রবৃদ্ধি হ্রাস করবে।
ট্রাম্প ও তার অর্থনৈতিক উপদেষ্টারা কয়েকদিন আগে জনগণকে অর্থনৈতিক ক্ষতির জন্য প্রস্তুত থাকার ব্যাপারে সতর্ক করেন।
তবে তাদের পুঁজি বাজারে সৃষ্ট উদ্বেগকে খারিজ করতে দেখা যায়।
এই অবস্থান ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের থেকে আলাদা। সেসময় তিনি বারবার পুঁজি বাজারকে নিজের সাফল্যের মাপকাঠি হিসেবে উল্লেখ করতেন।
গত সপ্তাহে ব্যবসায়ীরা অর্থনৈতিক পরিস্থিতির বিষয়ে আরও স্পষ্ট হওয়ার অনুরোধ জানালে ট্রাম্প তাদের বলেন, “পরিবর্তন ও সমন্বয় সবসময় চলতে থাকবে।”
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের এমন বক্তব্য তার পরিকল্পনা ঘিরে বিনিয়োগকারীদের উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে দেয়।
শুল্কের হাত ধরে অনিশ্চয়তা
অনেক কোম্পানির সবচেয়ে বড় প্রশ্ন শুল্ক নিয়ে; যা আমদানি পণ্যে আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসাগুলোর খরচ বাড়িয়ে দিয়েছে।
ট্রাম্পের শুল্ক নীতির কবলে পড়ে অনেক কোম্পানিই এখন কম মুনাফা করছে, যা তাদের বিনিয়োগ ও নিয়োগ স্থগিত করার বিষয়ে উৎসাহিত করছে।
এছাড়া সরকারের কর্মীসংখ্যা ও সরকারি খরচে বড় ধরনের কাটছাঁটে উদ্বিগ্ন বিনিয়োগকারীরা।
ইনভেস্টমেন্টে ব্যাংক স্টিফেলের ওয়াশিংটন নীতি কৌশল বিভাগের প্রধান ব্রায়ান গার্ডনার বলেন, “ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বিনিয়োগকারীরা ভেবেছিলেন শুল্ককে আলোচনার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চান ট্রাম্প।
“কিন্তু প্রেসিডেন্ট ও তার মন্ত্রিসভা যে সঙ্কেত দিচ্ছেন, তাতে বোঝা যাচ্ছে, তারা আসলে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ঢেলে সাজাতে চাইছেন, যার প্রভাব গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বাজারের ওপর পড়েছে।”
যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি আগে থেকেই ধীরগতিতে এগোচ্ছিল। এর বেশ কয়েকটি কারণের একটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। জিনিসপত্রের দাম স্থিতিশীল রাখতে সুদের হার বাড়িয়ে দিয়েছিল তারা।
সম্প্রতি প্রকাশিত কিছু ডেটায় যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ধীরগতিতে চলার বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়।
যুক্তরাষ্ট্রে গত ফেব্রুয়ারিতে খুচরা বিক্রি কমে যায়।
নির্বাচনে ট্রাম্পের জয়ের পর বেশ কিছু ভোক্তা ও ব্যবসা সংক্রান্ত জরিপে আমেরিকানদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস বেড়ে যাওয়ার যে ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল, এখন তা নেই।
যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় উড়োজাহাজ কোম্পানি থেকে শুরু করে ওয়ালমার্ট, টার্গেটের মতো প্রতিষ্ঠান অর্থনৈতিক মন্দার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, শেয়ার বাজারে ধস নামলে উচ্চ আয়ের পরিবারসহ সব শ্রেণির মানুষ আরও ব্যয় সংকোচনে বাধ্য হবে।
শেয়ার বাজারের অস্থিরতা
শেয়ার বাজারে অস্থিরতা পুরোপুরি ট্রাম্পের কারণে নয়।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) নিয়ে বিনিয়োগকারীদের অতি আশার ফলে প্রযুক্তি খাতের শেয়ারের দ্রুত উত্থানে গত দুই বছরে বড় লাভের পর বিনিয়োগকারীরা সংশোধন হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে ভীত ছিল।
সংশোধন বলতে এখানে বাজারে অতিরিক্ত উত্থান হওয়ার পর মূল্য আবার নেমে আসাকে বোঝাচ্ছে।
উদাহরণ হিসেবে চিপ নির্মাতা এনভিডিয়ারের কথা বলা যায়। তাদের শেয়ারের দাম ২০২৩ সালের শুরুতে ১৫ ডলার কম ছিল। গত বছরের নভেম্বরে যা প্রায় ১৫০ ডলার বেড়ে যায়।
এ ধরনের ঊর্ধ্বগতি অর্থাৎ ‘এআই বুদবুদ’ নিয়ে বিতর্ক আছে।
বিনিয়োগকারীরা এই বুদবুদ ফেটে যাওয়ার লক্ষণ নিয়ে সতর্ক ছিল, যা সামগ্রিক অর্থনীতির গতি যা-ই হোক না কেন, শেয়ার বাজারে বড় প্রভাব ফেলে।
এখন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে আশাবাদী থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে।
প্রযুক্তি বিশ্লেষক জিন মুনস্টার সম্প্রতি সোশাল মিডিয়ায় বলেন, “অর্থনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে আমার আশাবাদ এক পা পিছিয়ে গেছে। কারণ গত মাসে মন্দার আশঙ্কা পরিমাণগতভাবে বেড়েছে।”
তিনি বলেন, “মূল কথা হলো, আমরা যদি মন্দায় প্রবেশ করি, তাহলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সংক্রান্ত ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে যাওয়া অনেক কঠিন হয়ে পড়বে।”