একদল বিজ্ঞানী আমাদের সৌরজগতের বাইরে প্রাণের সম্ভাবনার সবচেয়ে স্পষ্ট প্রমাণ আবিষ্কারের দাবি জানিয়েছেন। তারা বলছেন, পৃথিবী থেকে ১২৪ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত একটি গ্রহের বায়ুমণ্ডলে পাওয়া গেছে এই প্রাণের অস্তিত্ব। তাদের এই আবিষ্কার বৈজ্ঞানিক মহলে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
যুক্তরাজ্যের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের নেতৃত্বে গবেষকরা জেমস ওয়েব মহাকাশ টেলিস্কোপ যন্ত্র ব্যবহার করে এই আবিষ্কার করেছেন। তারা গ্রহটির বায়ুমণ্ডলে এমন দুটি রাসায়নিক উপাদানের চিহ্ন পেয়েছেন, যেগুলো পৃথিবীতে শুধু জীবিত প্রাণীর মাধ্যমে উৎপন্ন হয়।
ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানের অধ্যাপক ও এই গবেষণার প্রধান নিক্কু মাধুসূদন গত ১৫ এপ্রিল এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, “এটি এমন একটি ভিনগ্রহের প্রথম ইঙ্গিত, যেখানে সম্ভবত প্রাণ রয়েছে। এটি এক বিপ্লবী মুহূর্ত।”
এখন প্রশ্ন হলো—এই সম্ভাব্য প্রাণবাহী গ্রহটি কোথায়, বিজ্ঞানীরা কী কী প্রমাণ পেয়েছেন, এবং এর বিষয়ে সংশয়ের কোনও কারণ আছে কি না?
গবেষকরা নাসার জেমস ওয়েব মহাকাশ টেলিস্কোপের সংগ্রহ করা তথ্যের ওপর নির্ভর করেছেন। এই টেলিস্কোপটি ২০২২ সালে মহাকাশে পাঠানো হয়। এটি পৃথিবী থেকে প্রায় ১৫ লক্ষ কিলোমিটার (৯ লাখ ৩০ হাজার মাইল) দূরে অবস্থান করছে। এটি মহাবিশ্ব পর্যবেক্ষণের জন্য মানবজাতির এক প্রহরী হিসেবে কাজ করছে।
গবেষকরা কে২-১৮বি নামে একটি নির্দিষ্ট গ্রহ নিয়ে গবেষণা করেছেন। কারণ এই গ্রহটি আগেই পৃথিবীর মতো পরিবেশ থাকার সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিয়েছিল।
এই গ্রহটি “লিও” নামক নক্ষত্রপুঞ্জে অবস্থিত। এটি পৃথিবী থেকে এত দূরে যে আলোর গতিতে ভ্রমণ করেও সেখানে পৌঁছাতে ১২৪ বছর সময় লাগবে। তবে বাস্তবে এটি আরও অনেক বেশি সময় নেবে। কারণ পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম অনুযায়ী আলো ছাড়া অন্য কিছু এত দ্রুত গতিতে চলতে পারে না।
এই গ্রহটির ভর পৃথিবীর চেয়ে ৮ দশমিক ৬ গুণ বেশি এবং আকারে ২ দশমিক ৬ গুণ বড়। গ্রহটি তার নক্ষত্রের “গোল্ডিলক্স অঞ্চল”-এ অবস্থিত। এই অঞ্চল এমন একটি দূরত্বে থাকে, যেখানে তাপমাত্রা এমন হতে পারে যে গ্রহের পৃষ্ঠে তরল অবস্থায় পানি থাকতে পারে।
২০২৩ সালে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা গ্রহটির বায়ুমণ্ডলে মিথেন ও কার্বন ডাই-অক্সাইডের অস্তিত্ব আবিষ্কার করেন।
এই প্রথম কোনও নক্ষত্রের বাসযোগ্য অঞ্চলে অবস্থিত গ্রহের বায়ুমণ্ডলে কার্বনভিত্তিক অণুর উপস্থিতি ধরা পড়ল। এই অঞ্চল এমন, যেখানে খুব গরম বা খুব ঠান্ডা নয়। ফলে তাত্ত্বিকভাবে প্রাণের অস্তিত্ব সম্ভব। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, গ্রহটির পৃষ্ঠে প্রথমে একটি মহাসাগর এবং তার ওপর একটি হাইড্রোজেন-সমৃদ্ধ বায়ুমণ্ডল থাকতে পারে। এই গঠনই কার্বনভিত্তিক অণুর উপস্থিতি ব্যাখ্যা করতে পারে। সহজভাবে বললে, এই গ্রহে পানি থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
গবেষকরা এখন এমন শক্তিশালী প্রমাণ পেয়েছেন যা শুধু গ্রহটিতে প্রাণ টিকে থাকার অনুকূল পরিবেশ থাকার সম্ভাবনাই নয়, বরং তাত্ত্বিকভাবে প্রাণ থাকার ইঙ্গিতও দেয়।
পৃথিবী থেকে আলোকবর্ষ দূরের গ্রহগুলো গবেষণা করার জন্য বিজ্ঞানীরা অপেক্ষা করেন, কখন গ্রহটি তার নক্ষত্রের সামনে দিয়ে যাবে। তখন তারা সেই নক্ষত্রের আলো পর্যবেক্ষণ করেন। কারণ সেই আলো গ্রহের বায়ুমণ্ডল দিয়ে প্রবাহিত হয়। এই আলো বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা গ্রহটির বায়ুমণ্ডলে উপস্থিত উপাদান সম্পর্কে ধারণা পান।
এই পদ্ধতি ব্যবহার করে গবেষক দল কে২-১৮বি গ্রহের বায়ুমণ্ডলে ডাইমিথাইল সালফাইড (ডিএমএস) ও ডাইমিথাইল ডিজালফাইড (ডিএমডিএস) গ্যাসের চিহ্ন পেয়েছেন।
পৃথিবীতে এই যৌগগুলো কেবল জীবিত প্রাণী, বিশেষ করে সামুদ্রিক ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটনের মতো অণুজীব দ্বারা উৎপন্ন হয়। আরও আশ্চর্যের বিষয়, গবেষকরা যা পেয়েছেন, তা ইঙ্গিত দেয় যে কে২-১৮বি গ্রহের বায়ুমণ্ডলে এই যৌগগুলোর ঘনত্ব পৃথিবীর তুলনায় হাজার গুণ বেশি হতে পারে।
গবেষণার সহলেখক ও যুক্তরাষ্ট্রের বাল্টিমোরে স্পেস টেলিস্কোপ সায়েন্স ইনস্টিটিউটের গবেষক ম্যানস হোমবার্গ এক বিবৃতিতে বলেছেন, “ফলাফলগুলো ধাপে ধাপে প্রকাশিত হতে দেখা এবং দীর্ঘ ও স্বাধীন বিশ্লেষণ ও নির্ভরযোগ্যতা পরীক্ষার মধ্যেও তা একই রকম থাকা ছিল এক অবিশ্বাস্য অভিজ্ঞতা।”
গবেষণাটি এরইমধ্যে অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নাল লেটার্স নামক একটি পর্যালোচিত বৈজ্ঞানিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। এর মানে, সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের অন্যান্য বিশেষজ্ঞরাও তাদের গবেষণা পড়ে সেটিকে বিশ্বাসযোগ্য মনে করেছেন।
তবে এর অর্থ এই নয় যে, গবেষকরা জীবনের চূড়ান্ত ও অপ্রতিরোধ্য প্রমাণ পেয়েছেন। বরং এখনও তা থেকে অনেক দূরে রয়েছেন।
গবেষণার প্রধান অধ্যাপক নিক্কু মাধুসূদন স্বীকার করেছেন, কে২-১৮বি গ্রহের বায়ুমণ্ডলে পাওয়া ডিএমএস ও ডিএমডিএস এর চিহ্নগুলো এমন কোনও রাসায়নিক প্রক্রিয়ার ফল হতে পারে, যা এখনও মানবজাতির অজানা।
তিনি বলেন, “ফলাফল নিয়ে আমাদের নিজেদের গভীরভাবে সন্দেহপ্রবণ থাকা জরুরি। কারণ বারবার পরীক্ষা করেই আমরা একসময় আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারি। বিজ্ঞান এভাবেই এগিয়ে চলে।”
তার গবেষক সহকর্মীরাও এতে একমত পোষণ করেছেন।
গবেষণার সহলেখক ও ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব অ্যাস্ট্রোনমির বিজ্ঞানী সাভভাস কনস্টানটিনু বলেন, “আমাদের কাজ হচ্ছে এমন এক প্রাথমিক ধাপ, যেখান থেকে এখন আরও বিস্তৃত গবেষণা শুরু হবে। এসব অনুসন্ধানই আমাদের সামনে এই রোমাঞ্চকর আবিষ্কারের প্রকৃত তাৎপর্য উন্মোচন করতে সাহায্য করবে।”
গবেষক দলটির এই আবিষ্কার সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঘটে যাওয়া কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির ধারাবাহিকতা। এসব আবিষ্কার বিজ্ঞানীদের মনে পৃথিবীর বাইরেও প্রাণের সম্ভাবনা নিয়ে নতুন আশার সৃষ্টি করেছে।
২০১১ সালে নাসার বিজ্ঞানীরা ঘোষণা দেন, তারা অ্যান্টার্কটিকায় পতিত কিছু উল্কাপিণ্ডে ডিএনএর মূল উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত রাসায়নিক চিহ্ন খুঁজে পেয়েছেন। এই রাসায়নিক পদার্থগুলো পৃথিবীতে আসার পর দূষণের কারণে সৃষ্টি হয়নি। গবেষকদের ব্যাখ্যা ছিল—গ্রহাণু ও ধূমকেতুতে প্রাণের মৌলিক উপাদান থাকতে পারে।
এর এক বছর পর, কোপেনহেগেন ইউনিভার্সিটির জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা একটি দূরবর্তী নক্ষত্রপুঞ্জে একটি চিনির অণু খুঁজে পান। এই অণুটি রাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড বা আরএনএ-এর অপরিহার্য উপাদান। এটি জীববিজ্ঞানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
২০২৩ সালে বিজ্ঞানীরা শনির একটি উপগ্রহ এনসেলাদাসের চারপাশের গ্যাসে জৈব অণুর চিহ্ন আবিষ্কার করেন।
২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে বিজ্ঞানীরা এমন পাঁচটি গ্রিনহাউস গ্যাস শনাক্ত করেন, যেগুলো অন্য কোনও গ্রহে প্রাণের উপস্থিতির গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত হতে পারে বলে তারা মনে করেন।
তবে বিজ্ঞানের পথ সবসময় সাফল্যের নয়; ব্যর্থতাও তার অংশ। ২০০৫ সালে নাসার দুই বিজ্ঞানী দাবি করেন, তারা মঙ্গলে প্রাণের সম্ভাব্য চিহ্ন পেয়েছেন। কারণ সেখানে মিথেন গ্যাসের উপস্থিতি ধরা পড়েছিল। কিন্তু পরবর্তী গবেষণায় সেই দাবিগুলো টেকেনি এবং নাসা তাদের বক্তব্য থেকে দূরে সরে আসে।
ক্যামব্রিজ দলের গবেষকরা জানিয়েছেন, তারা ডিএমএস ও ডিএমডিএস যৌগের উপস্থিতি ৯৯ দশমিক ৭ শতাংশ নিশ্চিতভাবে শনাক্ত করেছেন। শুনতে এটি প্রায় নিখুঁত মনে হলেও, বিজ্ঞানের কঠোর মানদণ্ড অনুযায়ী এটি এখনও চূড়ান্ত আবিষ্কার হিসেবে গণ্য হওয়ার পর্যায়ে পৌঁছায়নি।
একটি গবেষণাকে নির্ভুল ও প্রতিষ্ঠিত হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হলে ‘ফাইভ-সিগমা থ্রেশহোল্ড’ অর্জন করতে হয়। যার মান ৯৯ দশমিক ৯৯৯৯৪ শতাংশ নিশ্চিত।
গবেষকরা মনে করেন, জেমস ওয়েব দূরবীক্ষণ যন্ত্রে আরও পর্যবেক্ষণের সুযোগ পেলে তারা এই স্তরের নিশ্চিয়তা অর্জন করতে পারবেন।
অধ্যাপক মাধুসূদন বলেন, “অনেক বছর পর আমরা হয়তো ফিরে তাকিয়ে দেখব—এই মুহূর্তটিই ছিল সেই সময়, যখন জীবন্ত মহাবিশ্ব আমাদের নাগালের মধ্যে চলে আসে। এটি হতে পারে সেই সন্ধিক্ষণ, যখন আমরা প্রথমবারের মতো প্রশ্ন করতে পারি—এই বিশাল মহাবিশ্বে আমরা কি সত্যিই একা?”
তথ্যসূত্র : ফক্স নিউজ ও আল জাজিরা।