Beta
বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারি, ২০২৫
Beta
বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারি, ২০২৫

মরিশাসের ছোট্ট দ্বীপটি কি ভারতের গোপন গোয়েন্দা ঘাঁটি

মরিশাসের আগালেগা দ্বীপ। ছবি: বিবিসি/বিলি হেনরি।
মরিশাসের আগালেগা দ্বীপ। ছবি: বিবিসি/বিলি হেনরি।
[publishpress_authors_box]

আর্নড পাউলে কখনোই তার বাসস্থান ভারত মহাসাগরের ছোট্ট দ্বীপ আগালেগা ছেড়ে যেতে চাননি। কিন্তু এবছর অবশেষে তিনি তার বাক্স-পেটরা নিয়ে দ্বীপটি ছেড়েছেন। কারণ তার আশঙ্কা, দ্বীপটির সামরিকীকরণ করা হচ্ছে।

কিছুদিন আগ পর্যন্তও মাত্র ৩৫০ জন মানুষ আগালেগা দ্বীপে বসবাস করতেন, যারা জীবন চলত মাছ ধরে এবং নারকেল চাষ করে। অন্যান্য খাবার দ্বীপটির ১১০০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত দেশের (মরিশাস) রাজধানী থেকে জাহাজের মাধ্যমে বছরে চারবার আমদানি করা হত।

এ ছাড়া দ্বীপটিতে বিমান ওঠা-নামার একটি ছোট রানওয়েও থাকলেও জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজন ছাড়া খুব কমই ব্যবহার হতো।

২০১৫ সালে মরিশাস সরকার ভারতের সঙ্গে একটি গোপন চুক্তি করে। চুক্তিতে ভারতকে আগালেগা দ্বীপে ৩ কিলোমিটারের বিশাল একটি বিমানের রানওয়ে এবং নতুন একটি জেটি তৈরির অনুমতি দেওয়া হয়।

সামুদ্রিক নিরাপত্তার বিষয়ে দুই দেশের গভীর সহযোগিতার অংশ হিসাবে চুক্তিটি করা হয়। তবে আগলেগার বাসিন্দাদের আশঙ্কা, এর মধ্য দিয়ে দ্বীপটিতে ভারতের স্থায়ী সামরিক উপস্থিতি তৈরি হতে পারে।

৪৪ বছর বয়সী আর্নড পাউলে একজন হ্যান্ডম্যান এবং রেগায়ে মিউজিশিয়ান, যিনি এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে একটি প্রচারণার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।

তিনি বলেন, “আমি আমার দ্বীপকে ভালবাসি এবং আমার দ্বীপ আমাকে ভালবাসে। কিন্তু যখন সেই ঘাঁটি উন্মোচন করা হয়েছিল, আমি জানতাম যে আমাকে দ্বীপটি ছেড়ে চলে যেতে হবে।”

দক্ষিণ-পশ্চিম ভারত মহাসাগরে ২৫ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে একই দ্বীপের অংশ দুটি ছোট দ্বীপ নিয়ে গঠিত আগালেগা। এটি সমুদ্রে জাহাজ চলাচলের ওপর নজর রাখতে ভারতের জন্য একটি আদর্শ অবস্থান হবে।

স্যাটেলাইট থেকে ২০১৯ সালে তোলা দ্বীপটির কিছু ছবির সঙ্গে এবছরের জুলাইয়ে তোলা কিছু ছবির তুলনা করে দেখা যায়, দ্বীপটির চেহারা অনেকটাই বদলে গেছে।

স্যাটেলাইট থেকে ২০১৯ সালে তোলা দ্বীপটির ছবি (বামে); ডানের ছবিটি এ বছরের জুলাইয়ের।

আগে যেখানে কার্পেটের মতো বিছানো পাম গাছের সারি ছিল এখন তার মাঝখান দিয়ে এখন একটি লম্বা সাদা দাগ দেখা যাচ্ছে, যা মূলত একটি নতুন রানওয়ে। রানওয়েটি উত্তর দ্বীপের মাঝ বরাবর দুটি প্রধান গ্রামের মধ্য দিয়ে গেছে— উত্তরে লা ফোর্চে ও দক্ষিণে ভিংক্ট-সিংক গ্রাম।

অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির গবেষক স্যামুয়েল ব্যাশফিল্ড বলেন, দুটি ৬০ মিটার প্রশস্ত ভবনকে একটি টারমাক এপ্রোনের ওপর বসে থাকতে দেখা যাচ্ছে, যার মধ্যে অন্তত একটি ভারতীয় নৌবাহিনীর পি-৮আই বিমানের থাকার হ্যাঙ্গার হতে পারে।

পি-৮আই হল বোয়িং ৭৩৭ বিমানকে মডিফাই করে বানানো একটি বিমান, যা ডুবোজাহাজ খুঁজে বের করে আক্রমণ এবং সামুদ্রিক যোগাযোগ নিরীক্ষণের জন্য বানানো হয়েছে। দ্বীপবাসীরা ইতিমধ্যেই এয়ারস্ট্রিপে বিমানটির অবস্থানের কিছু ছবি তুলেছে।

আগলেগার নতুন রানওয়েতে ভারতীয় নৌবাহিনীর একটি পি-৮আই বিমান।

উত্তর-পশ্চিম উপকূলে একটি নতুন জেটিকে সাগরে ভেসে থাকতে দেখা গেছে। ব্যাশফিল্ড বলেন, জেটিটি ভারতীয় টহল জাহাজ এবং সেইসঙ্গে আগালেগাতে মালামাল নিয়ে আসা জাহাজগুলো ব্যবহার করতে পারে।

তিনি বলেন, “আরও কিছু নতুন স্যাটেলাইট ছবি আসার পর আমরা ভারত মহাসাগরের যোগাযোগে আগালেগার ভূমিকা আরও ভালোভাবে বুঝতে পারব।”

ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ বলেছে, ভারত সেখানে একটি গোপন নজরদারি স্টেশন তৈরি করেছে। যার মধ্যে একটি উপকূলীয় রাডার নজরদারি ব্যবস্থা থাকতে পারে। সেটি মরিশাসের অন্যান্য জায়গায় স্থাপিত ভারতের তৈরি সরঞ্জামের মতোই।

আগলেগার উত্তর প্রান্তে ব্যাপক নির্মাণকাজ এবং জেটি ও জাহাজ দেখা যায়।

ভারত সরকার আগালেগা সম্পর্কে বিবিসিকে কোনও প্রশ্নের উত্তর দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে এবং তাদের ওয়েবসাইটে দেওয়া আগের বিবৃতিগুলো দেখতে বলেছে।

এমন একটি বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন, ভারত ও মরিশাস সামুদ্রিক নিরাপত্তায় ‘প্রাকৃতিক অংশীদার’, যারা ভারত মহাসাগর অঞ্চলে ঐতিহ্যগত এবং অপ্রথাগত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি।

১৯৭০ সাল থেকেই দেশ দুটির মধ্যে ঘনিষ্ঠ প্রতিরক্ষা সম্পর্ক রয়েছে।

দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা, কোস্টগার্ড প্রধান এবং পুলিশ হেলিকপ্টার স্কোয়াড্রনের প্রধান সকলেই ভারতীয় নাগরিক এবং যথাক্রমে ভারতের বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা, নৌবাহিনী এবং বিমান বাহিনীর অফিসার।

মরিশাস দ্বীপপুঞ্জ।

কিংস কলেজ লন্ডনের ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক হর্ষ পান্ত বলেছেন, উভয় পক্ষই দ্বীপটিকে ‘যেকোনও প্রকাশ্য সামরিক ব্যবহারের চেয়ে বরং সক্ষমতা বৃদ্ধির’ স্থান হিসাবে দেখতে চায়।

আর এটাও কোনও গোপন বিষয় নয় যে, ভারত ও তার পশ্চিমা মিত্ররা ভারত মহাসাগরে চীনের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন।

বড় কোনও দেশের পক্ষে ছোট কোনও মিত্র দেশের ভূখণ্ডে সামরিক ফাঁড়ি স্থাপন করা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু আগালেগায় ভারতের নির্মাণ কাজ দ্বীপবাসীদেরকে বিরক্ত করেছে।

দ্বীপবাসীরা বলছেন, দ্বীপের পামগাছ ঘেরা সাদা-বালির সৈকত সহ বেশ কয়েকটি এলাকা ইতোমধ্যে দেয়াল দিয়ে ঘেরাও করা হয়েছে।

গুঞ্জনও উঠেছে যে, লা ফোর্চে গ্রামটির চারপাশে গড়ে ওঠা ভারতীয় পরিকাঠামো গ্রামটিকে গ্রাস করবে এবং সেখানে বসবাসকারী ১০টি পরিবারকে জোরপূর্বক তাদের বাসস্থান থেকে উচ্ছেদ করা হবে।

অ্যাসোসিয়েশন অব ফ্রেন্ডস অব আগালেগার সভাপতি লাভাল সুপ্রামানিয়েন বলেছেন, “এটি সম্পূর্ণরূপে ভারতীয়দের চলাচল ও অবস্থানের জন্য সীমাবদ্ধ একটি এলাকায় পরিণত হবে।”

তিনি আশঙ্কা করেন, “আগালেগার পরিণতিও ছাগোস দ্বীপপুঞ্জের মতো হবে। একই উদ্বেগ দেখা গেছে ২৬ বছর বয়সী হ্যান্ডম্যান বিলি হেনরির মাঝেও। তার মা ছাগোস দ্বীপপুঞ্জ থেকে উচ্ছেদ হয়ে আগালেগায় বাস করতে আসেন ১৯৬০ এর দশকে।

হেনরি বলেন, “আমার মা তার দ্বীপ হারিয়েছেন। এবার আমার বাবাও হারাবে।”

আগালেগার বর্তমান বাসিন্দাদের একটি অংশ ২০০০ কিলোমিটার দূরের ছাগোস দ্বীপ থেকে উচ্ছেদ হয়ে আসা পরিবারগুলোর উত্তরসুরি। ১৯৬৫ সালে যুক্তরাজ্য সরকার ছাগোস দ্বীপকে ব্রিটিশ ভূখণ্ড বলে ঘোষণা করার পর তাদের সেখান থেকে উচ্ছেদ করা হয়।

একই সময়ে মরিশাসের সবচেয়ে বড় দ্বীপ দিয়েগো গার্সিয়াকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে লিজ দিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার। দিয়েগো গার্সিয়াও ধীরে ধীরে একটি পূর্ণাঙ্গ সামরিক ঘাঁটিতে পরিণত হয়।

আগালেগার রাজধানী ভিংক্ট-সিংক (ফরাসি ভাষায় যার অর্থ ২৫)। নামটি এসেছে পাম চাষে নিয়োজিত ক্রীতদাসদের ওপর ঔপনিবেশিক মনিবদের বেত্রাঘাতের সংখ্যা থেকে।

বিলি হেনরি আশঙ্কা করছেন, মরিশাস সরকার নিজেই আগালেগার পরিস্থিতি এতোটাই শোচনীয় করার চেষ্টা করছে যাতে সেখানকার বাসিন্দারা সবাই দ্বীপটি ছেড়ে চলে যায়।

হেনরি স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষার সমস্যা, স্থানীয় অর্থনীতিতে সীমিত বিনিয়োগ, কাজের সুযোগের অভাব এবং স্থানীয়দের নিজস্ব ব্যবসা খোলার উপর নিষেধাজ্ঞার দিকে ইঙ্গিত করেন।

তবে মরিশাস সরকারের একজন মুখপাত্র বিবিসিকে বলেছেন, কাউকে দ্বীপ ছেড়ে যেতে বলা হয়নি এবং স্থানীয় লোকজনকে শুধুমাত্র বিমানবন্দর ও সমুদ্রবন্দরে প্রবেশ করতে বাধা দেওয়া হবে।

তার দাবি, বন্দরগুলো দেশকে জলদস্যুতা, মাদক-পাচার এবং অনিয়ন্ত্রিত মাছ ধরা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করবে।

মরিশাস সরকার আগালেগায় কোনও সামরিক ঘাঁটি তৈরির দাবি অস্বীকার করে বলে যে, এখনও দ্বীপটির সম্পূর্ণভাবে দেশের জাতীয় পুলিশের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

দেশটির সরকার অবশ্য স্বীকার করে যে, ভারতীয় খরচে নির্মিত নতুন স্থাপনাগুলোর ‘রক্ষণাবেক্ষণ এবং পরিচালনা’ করতে ভারত সরকারই সহায়তা করবে।

মরিশাস ও ভারত সরকার বলেছে, দ্বীপবাসীদের উপকার করতে এবং তাদের দারিদ্র্য থেকে বের করে আনতে সাহায্য করার জন্যই সেখানকার সমুদ্র ও বিমান পরিবহন ব্যবস্থায় উন্নতির পরিকল্পনা করা হয়েছে।

কিন্তু স্থানীয় বাসিন্দারা বলেছেন, তেমনটি ঘটেনি। এখনও প্রতি বছর মরিশাসের মূল দ্বীপে মাত্র চারটি ফেরি চলাচল করে এবং কোনও যাত্রীবাহী বিমান চলাচল করে না।

আগালেগার বাসিন্দারা বলছেন, তাদের একটি নতুন ভারত-নির্মিত হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা দিতেও অস্বীকৃতি জানানো হয়েছে।

যদিও মরিশাস সরকার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে হাসপাতালটির অপারেটিং থিয়েটার, এক্স-রে মেশিন এবং দন্তচিকিৎসা সরঞ্জামগুলো নিয়ে গর্ব করে।

আর্নড পাউলে।

বিলি হেনরি বলেছেন, রান্নার তেলে পুড়ে যাওয়া একটি ছেলে গত অক্টোবরে সেখানে চিকিৎসা সাহায্য চাইতে গেলে তাকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি।

তিনি বলেন, “হাসপাতালটি শুধুমাত্র ভারতীয়দের জন্য!”

পরে ছেলেটিকে মরিশাসের মূল দ্বীপে নিয়ে যাওয়া হয়। লাভাল সুপ্রামানিয়েন বলেছেন, ছেলেটি এখনও সেখানকার হাসপাতালে রয়েছে।

এই বিষয়ে মন্তব্যের জন্য বিবিসি মরিশাস ও ভারত সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও কোনও সাড়া পায়নি।

মরিশাস পার্লামেন্টে সাম্প্রতিক এক বক্তৃতায় দেশটির প্রধানমন্ত্রী প্রবিন্দ জগন্নাথ বলেছেন, আগলেগার আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন তার সরকারের এজেন্ডায় আগের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে।

তিনি বলেন, দ্বীপের বাসিন্দাদের জন্য স্বাস্থ্য ও শিক্ষা, পরিবহন সংযোগ, বিনোদন সুবিধার উন্নতি এবং মাছ ধরার খাত ও নারকেলের চাষাবাদে উন্নয়নের জন্য একটি ‘মাস্টার প্ল্যান’ তৈরি করা হয়েছে।

কিন্তু ভারত বা মরিশাস কেউই ২০১৫ সালের সমঝোতা স্মারকের বিশদ প্রকাশ করেনি। যে কারণে সবার মধ্যে অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে এবং তাদের ভবিষ্যতও অজানা।

তথ্যসূত্র : বিবিসি

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত