যে ‘বাংকার বাস্টার’ বোমা হামলা চালিয়ে লেবাননে হিজবুল্লাহ প্রধান হাসান নাসরাল্লাহকে হত্যা করেছে ইসরায়েল, তা এক বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে পেয়েছিল দেশটি।
মারাত্মক ধ্বংসাত্মক হওয়ায় জনসমাগমস্থলে এই বোমা ফেলা জেনেভা কনভেনশনের বিরোধী বলে জাতিসংঘের বিষেশজ্ঞরা বলে আসছে।
২০২৩ সালের অক্টোবরে ইসরায়েল গাজা অভিযান শুরুর পর যুক্তরাষ্ট্রের জো বাইডেন সরকার ইসরায়েলকে যে বিপুল সমর সরঞ্জাম সরবরাহ করেছিল, তার মধ্যে এই বাংকার বাস্টারও রয়েছে।
তখন ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরায়েল গাজা অভিযান শুরুর পরপরই যুক্তরাষ্ট্র তাদের ১৫ হাজার বোমা ও ৫৭ হাজার গোলা সরবরাহ করে।
গাজা যুদ্ধের পাশাপাশি লেবাননে হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধেও এই বোমা ব্যবহার করছে ইসরায়েল। শুক্রবার তেমন এক হামলায় নিহত হন নাসরাল্লাহ।
লেবাননের রাজধানী বৈরুতের দক্ষিণাঞ্চলে একটি আবাসিক ভবন লক্ষ্য ওই বোমা হামলা চালানো হয়। সেখানেই ছিলেন নাসরাল্লাহ।
আল জাজিরা জানিয়েছে, হিজবুল্লাহ প্রধানকে হত্যায় বিমান থেকে ৮৫টি বাংকার বাস্টার ফেলে ইসরায়েল। প্রতিটি বোমার ওজন ২ হাজার থেকে ৪ হাজার পাউন্ড। তার প্রতিটি বোমা ১ টনের মতো বিস্ফোরকভরতি ছিল।
কী এই বাংকার বাস্টার
মারাত্মক ক্ষতি সাধনে সক্ষম বাংকার বাস্টার তৈরি করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী। মাটির নিচের বাংকারও এটি ভেদ করতে পারে বলে এর এমন নামকরণ।
সাধারণ বোমা দিয়ে ভূ উপরিস্থিত কাঠামোর ক্ষয়ক্ষতি করা হলেও বাংকারসহ ভূঅভ্যন্তরের ক্ষতি করা কঠিন। কিন্তু বাংকার বাস্টার তা সহজ করে দেয়।
সামরিক স্থাপনা ধ্বংস করতেই এই বোমা তৈরি করা হয়েছে এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুদ্ধে এর ব্যবহার বেড়েছে।
১৯৯১ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় ইরাকি বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য এই বাংকার বাস্টার তৈরি করে যুক্তরাষ্ট্র। সেগুলোর ওজন ছিল ৫ হাজার পাউন্ডের মতো।
বাংকার বাস্টার কংক্রিট বা মাটি ভেদ করার পরই বিস্ফোরিত হয়। খারাপ আবহাওয়ার মধ্যেও এই বোমা কাজ করতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের সমর সম্ভারে রয়েছে ‘ম্যাসিভ অর্ডন্যান্স পেনিট্রেটর বা এমওপি’। এটি দেশটির অস্ত্রাগারের সবচেয়ে বড় বাংকার বাস্টার বোমা, যার ওজন ৩০ হাজার পাউন্ড। এটি বিস্ফোরণের আগে ২০০ ফুট কংক্রিট বা ৬০ ফুট গভীর মাটি ভেদ করতে পারে।
ভূগর্ভস্থ পারমাণবিক স্থাপনা, বিশেষ করে ইরান বা উত্তর কোরিয়ার মতো দেশগুলোতে হামলার জন্য বাংকার বাস্টারকে ‘গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র’ হিসাবে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
কৌশলগত গুরুত্বের কারণেই বাংকার বাস্টার বোমাগুলো আধুনিক যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র হয়ে উঠেছে।
বাংকার ব্লাস্টার আন্তর্জাতিক আইনে এখনও নিষিদ্ধ নয়। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আবাসিক এলাকা, বেসামরিক মানুষের বাবস্থলে এই বোমার ব্যবহার সুস্পষ্টভাবে জেনেভা কনভেনশনের লঙ্ঘন।
কত বোমা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র
বন্ধু রাষ্ট্র ইসরায়েলকে সমর সরঞ্জাম দিয়েই যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। তার ধারাবাহিকতায় গত বছর বিপুল সমরাস্ত্র পায় তেল আবিব সরকার।
গত জুন মাসে প্রকাশিত রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গত অক্টোবর গাজা যুদ্ধ শুরুর পর ওয়াশিংটন ১০ হাজারের বেশি ধ্বংসাত্মক বোমা দিয়েছে ইসরায়েলকে, এগুলোর প্রতিটির ওজন ২ হাজার পাউন্ডের বেশি। দেওয়া হয় কয়েক হাজার ক্ষেপণাস্ত্রও।
যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক কর্মকর্তাদের দেওয়া তালিকা অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে কমপক্ষে ১৪ হাজার বড় বোমা (২ হাজার পাউন্ড ওজনের), সাড়ে ৬ হাজার মাঝারি বোমা (৫০০ পাউন্ড ওজনের), ২ হাজার ৬০০টি ছোট বোমা, আকাশ থেকে ভূমিকে নিক্ষেপণযোগ্য ৩ হাজার হেলফায়ার ক্ষেপণাস্ত্র পায় ইসরায়েল।
গাজা অভিযান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভের মধ্যেই তেল আবিবকে এই সমরাস্ত্র দিয়েছিল ওয়াশিংটন।
কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছে, আন্তর্জাতিক আহ্বান উপেক্ষা করে বাইডেন প্রশাসনের এই সমরাস্ত্র সহায়তা স্পষ্ট করে, ইসরায়েল নিয়ে ওয়াশিংটনের নীতিতে কোনও পরিবর্তন আসেনি।