ইরানের সামরিক স্থাপনায় ‘সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যকেন্দ্রিক’ হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী।
ইরানের সাম্প্রতিক হামলার জবাবে এই হামলা চালানো হয়েছে বলে শনিবার জানিয়েছে ইসরায়েলি ডিফেন্স ফোর্স (আইডিএফ)।
আইডিএফের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ইসরায়েলের ওপর চালানো হামলায় ব্যবহৃত ক্ষেপণাস্ত্র নির্মাণের স্থাপনা ছিল তাদের হামলার লক্ষ্য।
এর পাশাপাশি ভূমি থেকে আকাশে উৎক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র প্রক্রিয়াসহ ইরানের আকাশ সক্ষমতাকে টার্গেট করেও হামলা চালানো হয়েছে বলে জানিয়েছে আইডিএফ।
আর ‘সফল’ হামলার পর তাদের বিমানগুলো নিরাপদেই ইসরায়েলে ফিরেছে বলেও বিবৃতিতে জানানো হয়েছে।
অন্যদিকে, হামলার পর ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা বাহিনী বলছে, রাজধানী তেহরানের পাশাপাশি খুজেস্তান ও ইলাম প্রদেশে কয়েকটি ঘাঁটিতে হামলা হয়েছে। হামলাগুলো সাফল্যের সঙ্গে মোকাবেলা করা হয়েছে। তবে কিছু জায়গায় ‘সীমিত ক্ষতি’ হয়েছে।
হামলার সময় ইরানের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বড় ধরনের বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়ার কথা জানিয়েছেন। তবে এই শব্দ ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কার্যকর করার কারণেও হতে পারে বলে জানিয়েছেন তারা।
ইরানের বিপ্লবী রেভল্যুশনারি গার্ডের ঘনিষ্ঠ একটি বার্তা সংস্থার খবরে বলা হয়েছে, ইসরায়েলের এই হামলার লক্ষ্য ছিল তেহরানের পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিমের কয়েকটি সামরিক ঘাঁটি।
তেহরানে হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়াহকে হত্যার পর লেবাননে ইরান সমর্থিত সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহর প্রধান হাসান নাসরাল্লাহসহ সংগঠনটির শীর্ষ নেতাদের হত্যার প্রেক্ষাপটে মাসখানেক আগে ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে প্রায় ২০০ ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছিল ইরান।
এরপর থেকেই ইসরায়েল ইরানে প্রতিশোধমূলক হামলা চালাতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছিল। এমন পরিস্থিতিতে শনিবার ইরানে হামলা চালানোর কথা স্বীকার করল ইরায়েলের সামরিক বাহিনী।
যুক্তরাষ্ট্র ইরানে ইসরায়েলের এই হামলাকে তাদের ‘আত্মরক্ষার’ অংশ হিসেবে অভিহিত করেছে।
এদিকে সিরিয়ার মধ্য ও দক্ষিণাঞ্চলের কিছু সামরিক স্থাপনায়ও ইসরায়েল বিমান হামলা চালিয়েছে বলে জানিয়েছে সিরিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত বার্তা সংস্থা। তবে ইরানের বাইরে অন্য কোথাও হামলার বিষয়ে এখন পর্যন্ত ইসরায়েল কোনও মন্তব্য করেনি।
ইরানের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা ইরনায় প্রকাশিত খবরের বরাতে রয়টার্স জানিয়েছে, ইসরায়েল হামলা চালানোর পর ইরান তাদের আকাশসীমা বন্ধ করে দেয়।
দেশটির বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের মুখপাত্রকে উদ্ধৃত করে ইরনার খবরে বলা হয়েছে, সব ফ্লাইট পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বাতিল করা হয়েছে।
কী বলছে ইসরায়েল
ইরানে বিমান হামলা চালানোর পর ইসরায়েল একে তাদের ‘অধিকার’ হিসেবে বর্ণনা করেছে।
দেশটির সামরিক বাহিনীর বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর ইরান এবং ওই অঞ্চলজুড়ে তাদের ছায়া সহযোগীদের বিরামহীন হামলার জবাব দেওয়ার অধিকার বিশ্বের অন্য সব সার্বভৌম দেশের মতো ইসরায়েলও রয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, “ইসরায়েল রাষ্ট্র ও জনগণের সুরক্ষার জন্য যা যা করা দরকার, আমরা তা করব।”
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র ড্যানিয়েল হাগারি সোশাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ‘এক্স’-এ জানিয়েছেন, ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে ইরান যে হামলা চালিয়েছিল, তার জবাব দিয়েছে ইসরায়েল এবং তা শেষ হয়েছে।
পোস্টে হাগারি লিখেছেন, আমরা ইরানের সামরিক বাহিনীর স্থাপনায় সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যকেন্দ্রিক হামলা চালিয়েছি এবং এর মাধ্যমে ইসরায়েলের জন্য সম্ভাব্য হুমকিগুলোকে অপসারণ করা হয়েছে।”
ইসরায়েলের এই হামলার জবাবে ইরান যদি পাল্টা হামলা চালায়, তাহলে ইসরায়েল আবশ্যিকভাবেই পুনরায় তার জবাব দেবে বলেও এক্স পোস্টে জানান হাগারি।
ইরান কী বলছে
ইসরায়েলি হামলায় তেহরানসহ বিভিন্ন স্থানে বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া গেলেও দেশটির সামরিক বাহিনীর বিবৃতিতে বলা হয়েছে, কিছু স্থানে ‘সীমিত ক্ষতি’ হয়েছে।
হামলার পর ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা বাহিনীর এক বিবৃতিতে বলা হয়, তেহরান, খুজেস্তান ও ইলাম প্রদেশে কয়েকটি সামরিক ঘাঁটি ছিল ইসরায়েলি হামলার লক্ষ্য। তবে ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে বেশিরভাগ হামলাই সাফল্যের সঙ্গে মোকাবেলা করা হয়েছে। এ কারণে ‘সীমিত ক্ষতি’ হয়েছে।
তবে ইরান এই হামলার জবাবে আবারও ইসরায়েলে হামলা চালাবে কি-না সে বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে দেশটির সরকারের পক্ষ থেকে কোনও বিবৃতি বা ইঙ্গিত আসেনি।
তবে একটি সূত্রের বরাত দিয়ে ইরানের সংবাদ সংস্থা তাসনিম নিউজ বলছে, ইসরায়েলের যেকোনো আগ্রাসনের সমুচিত জবাব দেওয়ার জন্য ইরান প্রস্তুত আছে।
ওই সূত্র জানায়, “এতে কোনও সন্দেহ নেই যে, ইসরায়েলকে তার যেকোনো পদক্ষেপের জন্য সমুচিত জবাব দেওয়া হবে।”
এদিকে, ইসরায়েল হামলা চালালেও ইরানের পরিস্থিতি শান্ত আছে– এমনটাই বলা হচ্ছে দেশটির রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদমাধ্যমগুলোর খবরে।
ইরানের রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদ মাধ্যমে বড় কোনও ক্ষয়ক্ষতির কথাও অস্বীকার করা হয়েছে। তারা ইসরায়েলের হামলা সফল হয়নি বলে দাবি করেছে।
তবে দেশটির সামাজিক মাধ্যমে ভিন্ন চিত্র দেখা যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন ফাউন্ডেশন ফর ডিফেন্স অব ডেমোক্রেসির এর সিনিয়র ফেলো বেহনাম বেন তালেবলু।
তিনি মনে করেন, ইরানের কিছু সামরিক স্থাপনায় ইসরায়েল হামলা চালালেও দেশটির দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র হুমকিকে সমূলে উৎপাটনের চেষ্টা হয়নি।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া কী
দুজন সামরিক কর্মকর্তার বরাতে সিবিএস নিউজ জানিয়েছে, এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের সঙ্গে কথা বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন।
হোয়াইট হাউজ বলছে, তারা মনে করেন আত্মরক্ষার অংশ হিসেবে ইরানে এই হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের মুখপাত্র সিবিএসকে বলেন, “আমরা বুঝতে পারছি যে ইসরায়েল ইরানের সামরিক স্থাপনায় অভিযান চালাচ্ছে। ১ অক্টোবর ইসরায়েলে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলার প্রেক্ষাপটে আত্মরক্ষার অধিকার থেকেই তারা এটা করেছে।”
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে পুরো পরিস্থিতি ‘অবহিত করা হয়েছে এবং তিনি পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন’ বলেও ওই মুখপাত্র জানান।
তবে শনিবার ইরানে চালানো ইসরায়েলের এই হামলার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কোনও সংশ্লিষ্টতা নেই বলে দাবি করেছে পেন্টাগন।
তথ্যসূত্র: বিবিসি ,আল জাজিরা ও এনডিটিভি