Beta
শুক্রবার, ৭ নভেম্বর, ২০২৫
Beta
শুক্রবার, ৭ নভেম্বর, ২০২৫

গাজা যুদ্ধের দুই বছর : ইসরায়েল আজ বিভক্ত ও একঘরে, বলছেন বিশ্লেষকরা

gazan
[publishpress_authors_box]

গাজা উপত্যকায় দুই বছর ধরে চলা যুদ্ধে ৬৭ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। দুর্ভিক্ষের কবলে অগুনতি মানুষ। ফিলিস্তিনের প্রতিবেশী দেশগুলোতে বারবার হামলা চালানো হচ্ছে। গোটা অঞ্চলে আর নিরাপদ বোধ করছে না কেউ।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এমন পরিস্থিতির মধ্যে ইসরায়েল এখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একঘরে ও দেশের ভেতরে বিভক্ত।

গত সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের (ইউএনজিএ) অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বক্তৃতা দিতে উঠে দেখেন তার সামনে উপস্থিত অনেক প্রতিনিধি পেছন ঘুরে বেরিয়ে যাচ্ছেন। অনেকে বলছেন, গাজায় ইসরায়েলের “গণহত্যামূলক যুদ্ধের” প্রতিবাদে তারা এইভাবে প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন।

বিশ্বপরিসরে ইসরায়েল এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি একঘরে এবং যুক্তরাষ্ট্রের নিঃশর্ত সমর্থনের ওপর আগের চেয়ে অনেক বেশি নির্ভরশীল। যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, এমনকি জার্মানির মতো মিত্র দেশগুলোও গাজা যুদ্ধের নিন্দা করছে।

দেশের ভেতরে এই দুই বছরের যুদ্ধ ইসরায়েলের দীর্ঘদিনের ‘উদার ও প্রগতিশীল গণতন্ত্র’ হিসেবে থাকা ভাবমূর্তিকে চূর্ণ করেছে। এর জায়গা নিয়েছে এক অন্ধকার, কঠোর ও চরমপন্থী রাজনৈতিক বাস্তবতা।

ক্লান্ত ও সহিংস সমাজ

আল জাজিরাকে যুক্তরাষ্ট্রে ইসরায়েলের সাবেক রাষ্ট্রদূত ও কনসাল জেনারেল অ্যালন পিঙ্কাস বলেন, “ইসরায়েলি সমাজ আজ প্রবল যন্ত্রণায় আছে। তারা অনুভব করছে, বিশ্বজনমতের বিচারে তাদের বিরুদ্ধে রায় হয়ে গেছে।

“২০২৩ সালের অক্টোবরে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট, আইফেল টাওয়ার ও এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং ইসরায়েলের সমর্থনে নীল-সাদা আলোয় আলোকিত হয়েছিল। আর এখন তারা ইসরায়েলকে বর্জন করছে।”

চ্যাথাম হাউসের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা ইয়োসি মেকেলবার্গ আল জাজিরাকে বলেন, “ইসরায়েল ও তার রাজনীতি এখনও ৭ অক্টোবরেই আটকে আছে।”

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের নেতৃত্বাধীন হামলায় ১ হাজার ১৩৯ জন নিহত হয় এবং প্রায় ২০০ জনকে বন্দি করা হয়। এই ঘটনার স্মৃতি ও প্রচার ইসরায়েলি গণমাধ্যমে দুই বছর ধরে বারবার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।

বিশ্লেষকরা আল জাজিরাকে বলেন, রাজনৈতিক নেতারা এই ঘটনার ওপর নির্ভর করেই যুক্তি দিচ্ছেন যে, ৭ অক্টোবরই ইসরায়েলি সমাজের সংজ্ঞা নির্ধারণ করবে এবং এর নামেই যেকোনো পদক্ষেপ ন্যায্য বলে প্রমাণ করা যাবে।

উপদেষ্টা ইয়োসি মেকেলবার্গ বলেন, “বিশ্ব এগিয়ে গেছে। কিন্তু ইসরায়েল এখনও সেই জায়গায় আটকে আছে। এটাই তাদের সব কাজের যুক্তি। গাজায় ৬৫ হাজারের বেশি মানুষ হত্যার পরও তারা এখনও ধরে নিয়েছে, গাজার সবাই ওই হামলায় জড়িত।”

রাজনৈতিক বিশ্লেষক অরি গোল্ডবার্গ বলেন, “ইসরায়েল একসাথে ক্লান্ত ও আরও সহিংস হয়ে উঠেছে।” মানুষ এখন নানা দলে বিভক্ত। কেউ যুদ্ধকে সমর্থন করছে, কেউ বিরোধিতা করছে, কেউ আবার পুরো বিষয়টাই উপেক্ষা করছে।

গোল্ডবার্গ বলেন, সাধারণ মানুষ এখন এমনকি দৈনন্দিন কথোপকথনেও “অস্বস্তিকর বিষয়গুলো” এড়িয়ে যাচ্ছে। যেমন, সেই সব বন্দিদের প্রসঙ্গ, যারা দুই বছর ধরে গাজায় আটকে আছে। যদিও তাদের দেশে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী সেনাবাহিনী থাকার কথা বলা হয়েছিল।

গাজার ক্রমবর্ধমান মৃত্যুর মিছিল, দুর্ভিক্ষ বা বারবার বাস্তুচ্যুত হওয়ার মতো ভয়াবহ বিষয়গুলো নিয়েও জনসমক্ষে আলোচনা প্রায় নেই বললেই চলে।

এদিকে দুই বছর আগে আটক হওয়া বন্দিদের পরিবারের সদস্য ও তাদের সমর্থকরা এখনও আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে তাদের মুক্তির দাবি জানিয়ে আসছেন।

এই যুদ্ধ পরবর্তী ট্রমার আরেকটি প্রকাশ হলো হাজার হাজার রিজার্ভ সেনার ঘরে ফেরা। দেশে তাদের ফিরিয়ে আনা মানসিকভাবে ভয়াবহ প্রভাব ফেলেছে। আত্মহত্যা, পারিবারিক সহিংসতা ও পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডারের ‘মহামারী’ এখন চিকিৎসকদের ভাষায় ইসরায়েলে বাস্তবতা হয়ে উঠেছে।

“যুদ্ধের প্রভাব এখন সর্বত্র দৃশ্যমান,” বলেন গোল্ডবার্গ।

ইসরায়েলের রাস্তায় চালকরা দিক নির্দেশক বাতি ব্যবহার বন্ধ করে দিয়েছে। তারা হয় ভুলে যাচ্ছে, নয়তো অন্যদের প্রতি সম্পূর্ণ উদাসীন। ১৯৫৬ সাল থেকে চালু থাকা তেল আবিবের সৈকত সংলগ্ন গর্ডন সুইমিং পুলের সদস্যদের কাছে গত আগস্টে এক চিঠি পাঠানো হয়, যাতে অনুরোধ করা হয় “কোনও শারীরিক বা মৌখিক আগ্রাসন প্রদর্শন থেকে বিরত থাকতে।”

অস্তিত্বের লড়াই

গাজায় হত্যাযজ্ঞ থেকে বিচ্ছিন্নতার এই অনুভূতি ইসরায়েলের সংসদেও প্রতিফলিত হয়েছে। সেখানে বিরোধীরা যুদ্ধের বিরোধিতা না করে বরং কেবল তার পদ্ধতি বা বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। যুদ্ধবিরোধী কণ্ঠস্বর সংসদের একেবারে প্রান্তে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।

এদিকে জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন-গভির ও অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোটরিচ এখন নেতানিয়াহুর জোট টিকিয়ে রাখার মূল স্তম্ভে পরিণত হয়েছেন। ফলে চরম দক্ষিণপন্থীরা কার্যত নীতিনির্ধারণে ভেটো অধিকার অর্জন করেছে।

মেকেলবার্গ বলেন, “ইসরায়েলি রাজনীতি এখন আত্মার লড়াইয়ে নেমেছে। এটি যুদ্ধ দিয়ে শুরু হয়নি, তবে যুদ্ধ এটিকে দ্রুততর করেছে। আসলে এই পথচলা শুরু হয়েছিল গত নির্বাচনের সময়, যখন এক সুযোগসন্ধানী ও নৈরাশ্যবাদী প্রধানমন্ত্রী চরম দক্ষিণপন্থী ধর্মীয় শক্তিগুলোকে বৈধতা দিয়েছিলেন।”

২০২২ সালে পুনর্নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই নেতানিয়াহু টালমাটাল এক জোট ধরে রাখার জন্য সংগ্রাম করছেন।

বিশ্লেষকদের মতে, এর একটি কারণ হলো তার নিজের কট্টর দক্ষিণপন্থী নীতি, যা বসতি স্থাপনকারী গোষ্ঠী ও চরমপন্থীদের খুশি করার উদ্দেশ্যে তৈরি। পাশাপাশি ২০১৯ সাল থেকে তার বিরুদ্ধে চলা দুর্নীতির মামলাগুলোও এই রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার পেছনে ভূমিকা রেখেছে।

সাবেক রাষ্ট্রদূত ও কনসাল জেনারেল অ্যালন পিঙ্কাসের মতে, “নেতানিয়াহু ভাগ্যবান যে তার বিরোধীরা অদক্ষ। তারা অল্প সময়ের জন্য তার সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন, যা তাকে বৈধতা দিয়েছিল।” 

তিনি বলেন, অক্টোবর ৭ তারিখের হামলার পর বিরোধীদলীয় নেতা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনি গ্যান্টজের মতো ব্যক্তিরা নিরাপত্তা মন্ত্রিসভায় যোগ দেওয়ার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে।

“তারা এখনও পুরনো সেই ধারণায় আবদ্ধ যে, যখন সেনারা যুদ্ধ করছে, তখন সবাইকে সরকারকে সমর্থন করতে হবে।

“জনগণ জানে এটি সঠিক নয়। কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না। যতদিন নেতানিয়াহু এই চরম দক্ষিণপন্থী উন্মাদদের কাছে রাখবেন, ততদিন তিনি টিকে যাবেন,” বলেন পিঙ্কাস।

রাফাহ ধ্বংস (মে ২০২৪), যুদ্ধবিরতির ভাঙন (মার্চ ২০২৪) ও গাজা শহরে অব্যাহত হামলার মতো ঘটনায় স্পষ্ট যে, সাধারণ জনগণ, সেনাবাহিনী, আন্তর্জাতিক সমাজ বা বন্দিদের পরিবার; কেউ নয়, বরং চরম দক্ষিণপন্থীদের মতই শেষ পর্যন্ত প্রাধান্য পাচ্ছে।

মেকেলবার্গ ব্যাখ্যা করেন, ইসরায়েলের ‘ধর্মীয়-জাতীয়তাবাদী’ ডানপন্থী ও বসতি স্থাপনকারী আন্দোলন নিজেদের এক ঐশ্বরিক মিশনের বাহক হিসেবে দেখে। ইসরায়েলি গণতন্ত্রকে স্থায়ীভাবে দুর্বল করার এই প্রচেষ্টায় যুদ্ধ তাদের সহায়তা করেছে।

তিনি বলেন, “এই কারণেই তারা মন্ত্রণালয়গুলোর নিয়ন্ত্রণ চায়, পশ্চিম তীরের অভ্যন্তরীণ প্রশাসনের ওপর কর্তৃত্ব চায়। এটি ইসরায়েলের ইতিহাসের এক অন্ধকার সময়, যেখান থেকে পুনরুদ্ধার কতটা সম্ভব তা অনিশ্চিত।”

একঘরে রাষ্ট্র

সাম্প্রতিক মাসগুলোতে যুক্তরাজ্য, কানাডা, ফ্রান্স ও অস্ট্রেলিয়ার মতো দীর্ঘদিনের মিত্র দেশগুলো (গাজায় ক্রমবর্ধমান মৃত্যুহার ও পশ্চিম তীরে সহিংস অভিযানের পর) ইসরায়েলের যুদ্ধের নিন্দা করেছে এবং ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নও, যাদের সঙ্গে ইসরায়েলের ঐতিহাসিক বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে, এখন দেশটির সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি স্থগিত রাখা এবং চরমপন্থী মন্ত্রীদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টি বিবেচনা করছে।

জাতিসংঘে বর্তমানে সাধারণ পরিষদের ১৯২টি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে ১৫৯টি এবং নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্যের মধ্যে চারটি ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে। একমাত্র যুক্তরাষ্ট্রই এখনও তা করেনি।

পিঙ্কাস বলেন, “শুরুতে অনেকে বলেছিল এটা ভুল বোঝাবুঝি বা ইহুদিবিদ্বেষ, সেই পুরনো বুলি। পরে বলা হলো, এটা শুধু নেতানিয়াহুর সমস্যা। কিন্তু সেটিও টিকলো না। শেষ পর্যন্ত সবাই বুঝে গেছে, বিশ্বের দৃষ্টিতে একটি দেশ মানে তার কার্যক্রম। আর গত দুই বছরে ইসরায়েলের কার্যক্রম হলো গাজায় মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করা, যুদ্ধাপরাধ করা এবং গণহত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়া।”

২০১৯ সালে নেতানিয়াহু নির্বাচনী প্রচারে নিজেকে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে তুলনা করে বলেছিলেন: “এক আলাদা শ্রেণি।”

পিঙ্কাস বলেন, “ইসরায়েল এখন সত্যিই এক আলাদা শ্রেণিতে। কিন্তু এমন এক শ্রেণিতে, যেখানে তাদের আন্তর্জাতিকভাবে উত্তর কোরিয়ার মতো ঘৃণিত বলে মনে করা হয়।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত