Beta
শুক্রবার, ১৬ মে, ২০২৫
Beta
শুক্রবার, ১৬ মে, ২০২৫

গাজা ধ্বংসের কৌশল যেভাবে লেবাননেও খাটাচ্ছে ইসরায়েল

Lebanon_Israel_Destruction
[publishpress_authors_box]

“লেবাননকে আমরা যেমনটি জানি তার অস্তিত্ব থাকবে না”– জুলাইয়ের শুরুতে ইসরায়েলের শিক্ষামন্ত্রী ইয়োভ কিশ স্থানীয় একটি সংবাদ অনুষ্ঠানে এমনটাই বলেছিলেন।

তার ওই হুমকির পর লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহকে ধ্বংস করার আহ্বান জানিয়ে কয়েকজন উগ্র ডানপন্থী ইসরায়েলি মন্ত্রীও বিবৃতি দেন।

এক বছর আগে ইসরায়েলি মন্ত্রীরা গাজায় হামাসকে ‘নির্মূল’ করার জন্য প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর দৃশ্যমান যুদ্ধের লক্ষ্যকে সমর্থন করেছিলেন। হামাসের সশস্ত্র শাখা দক্ষিণ ইসরায়েলে ঢুকে পড়ে এক নজিরবিহীন হামলা চালানোর পর ওই যুদ্ধ শুরু হয়।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের ওই হামলায় ১ হাজার ১৩৯ জন ইসরায়েলি নিহত হয়। এছাড়া হামাস ২৫০ জনকে জিম্মি করে নিয়ে যায়।

সেই অজুহাতে ইসরায়েল গাজায় ইতোমধ্যে ৪২ হাজার ৮৭৭ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা এবং ২৩ লাখ বাসিন্দার প্রায় সবাইকে বাস্তুচ্যুত করেছে। ইসরায়েল গাজার সমস্ত অবকাঠামো ধ্বংস করেছে এবং ব্যাপক দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি তৈরি করেছে। প্রতিদিনই নিহতের সংখ্যা শয়ে শয়ে বাড়ছে।

স্থানীয় বেসামরিক বাসিন্দা, বিশ্লেষক ও অধিকার গোষ্ঠীগুলোর মতে, গত মাসের শেষদিকে হিজবুল্লাহর ওপর হামলা শুরু করার পর থেকে ইসরায়েল এখন দক্ষিণ লেবাননেও একই ধরনের কৌশল ব্যবহার করছে।

দক্ষিণ লেবাননের বাসিন্দা এবং হিজবুল্লাহ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ আমাল সাদ বলেন, “আমরা গাজার সঙ্গে দক্ষিণ লেবাননের হামলার তীব্রতার তুলনা করতে পারি না, কারণ গাজায় যা চলছে তা ঐতিহাসিকভাবে নজিরবিহীন এবং এটি একটি জেনোসাইড বা জাতিগত নিধনযজ্ঞ।”

তিনি আল জাজিরাকে আরও বলেন, “তবে দেখে মনে হচ্ছে ইসরায়েল গাজায় যে কৌশলগুলো ব্যবহার করেছে, লেবাননেও প্রায় তেমনই কিছু কৌশল নিচ্ছে।

“তবে তা এখনও গাজার ‍রূপ ধারণ করেনি। লেবাননে এখনও জাতিগত নির্মূল শুরু করেনি ইসরায়েল। এটি এখনও জাতিগত গণহত্যা নয়। তবে পরিস্থিতি সেখানেও পৌঁছাতে পারে।”

হত্যা অঞ্চল

গত ২৩ সেপ্টেম্বর ইসরায়েলের সামরিক প্রধান ড্যানিয়েল হাগারি দক্ষিণ লেবাননের গ্রামবাসীদেরকে ‘অস্ত্র মজুদ করার মতো সামরিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হিজবুল্লাহর বিভিন্ন ভবন ও এলাকা’ থেকে সরে যাওয়ার আহ্বান জানান।

তবে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের লেবাননের গবেষক রামজি কাইসের মতে, ওই নোটিশ ছিল অকার্যকর। কারণ সরে যাওয়ার আহ্বান জানালেও কোন গ্রামগুলোকে খালি করতে হবে এবং কোন এলাকাগুলো নিরাপদ থাকবে সে বিষয়ে নির্দিষ্ট করে কিছু বলা হয়নি।

তিনি বলেন, অধিকন্তু এই সতর্কতা ইঙ্গিত দেয় যে, যারা তাদের গ্রাম ছেড়ে যাবে না ইসরায়েল তাদের প্রত্যেককে হামলার লক্ষ্যবস্তু হিসেবে গণ্য করবে, ঠিক যেমনটি গাজায় করেছিল। গাজায় ইসরায়েলি সেনাবাহিনী যেই এলাকা থেকে ফিলিস্তিনিদেরকে সরে যেতে বলেছে সেই এলাকাকেই ‘কিল জোন’ বা ‘হত্যা অঞ্চল’ হিসাবে গণ্য করেছে।

যারা সেসব অঞ্চল থেকে সরে যেতে পারেনি তারা প্রায়ই গুলি বা বোমা হামলা শিকার হয়।

কাইস বলেন, “কোনো এলাকা থেকে সরে যাওয়ার জন্য শুধুমাত্র একটি সতর্কতা দেওয়ার পরই সেখানকার সবাইকে সামরিক ব্যক্তি বা যোদ্ধা হিসাবে গণ্য করা যায় না।”

আল জাজিরা দক্ষিণ লেবাননের চারজনের সঙ্গে কথা বলেছিল, যারা জানান যে, সিডনের বাইরে বেশিরভাগ গ্রাম এবং শহর প্রায় খালি। সিডন বৈরুত থেকে প্রায় ৪৪ কিলোমিটার দক্ষিণের একটি শহর।

২৩ সেপ্টেম্বর থেকে নিজেদের বাড়িঘর ছেড়ে যাওয়ার আগে প্রায় ২ হাজার মানুষকে হত্যা করেছে ইসরায়েল, যাদের মধ্যে শতাধিক শিশু, কয়েক ডজন চিকিৎসক এবং উদ্ধারকর্মীও রয়েছে।

দক্ষিণ লেবাননের নাবাতিয়ার কাছের একটি ছোট গ্রামের যুবক আহমেদ বলেছেন, বিপদ সত্ত্বেও আলঝেইমারে আক্রান্ত তার দাদির দেখাশোনার জন্য তিনি গ্রাম থেকে সরে যাননি।

আল জাজিরাকে তিনি বলেন, একটি ইসরায়েলি বোমা তার বাড়ির কাছের একটি এলাকায় আঘাত হেনেছিল।

তিনি একটি ভয়েস নোটে বলেন, “যারা এখনও এখানে আছে তাদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা আধাআধি।”

আহমেদ বলেন, “কেউ বেসামরিক কিনা সেটা ইসরায়েলিরা পরোয়া করে না। তারা শুধু লোককে সামরিক হিসেবে ধরে নেয় এবং ধ্বংসযজ্ঞ চালায়।

“ইসরায়েল আমার চারপাশে প্রচুর বাড়ি ধ্বংস করেছে। অথচ আমি জানি সেসব বাড়িতে কোনও অস্ত্র ছিল না। বাড়িগুলোর বাসিন্দাদের সকলকেই আমি চিনতাম।”

অবকাঠামোর ওপর ধ্বংসযজ্ঞ

জাতিসংঘ স্যাটেলাইট সেন্টারের (ইউএনওএসটি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ইসরায়েল গাজার সমস্ত কাঠামোর প্রায় ৬৬ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস করেছে।

এই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ইঙ্গিত করে যে, ইসরায়েল ইচ্ছাকৃতভাবে বেসামরিক মানুষদের বাড়িঘর, হাসপাতাল এবং ত্রাণের গুদামের মতো কাঠামোগুলোকে হামলার লক্ষ্যবস্তু করেছে।

বিশ্লেষকরা আল জাজিরাকে বলেন, মনে হচ্ছে লেবাননেও ইসরায়েল কিছুটা একই কৌশল নিয়েছে।

দক্ষিণ লেবাননের একটি খ্রিস্টান অধ্যুষিত গ্রামের একজন বয়স্ক ব্যক্তি বলেছেন, ৩০ সেপ্টেম্বর ইসরায়েল তার বাড়ি এবং তার প্রতিবেশীর বাড়িতে বোমাবর্ষণ করেছে।

পরবর্তী আক্রমণে তার স্ত্রী ও সন্তানদের মৃত্যু হয়। নিহতদের মধ্যে একটি শিশুও ছিল, যার বয়স এখনও এক সপ্তাহ হয়নি।

ওই ব্যক্তি বলেন, তিনি বৈরুতে পালিয়ে এসেছেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন, ইসরায়েল সবকিছুকে হামলার লক্ষ্যবস্তু করছে এবং কখনও কখনও বেসামরিক লোকজনকে দেরিতে সতর্কবার্তা দেয়। হামলার মাত্র কিছুক্ষণ আগে বা পরে।

তিনি আল জাজিরাকে বলেন, “আমাদের গ্রামে বিমান হামলা শুরু করার আগে তারা আমাদের কোনও সতর্কতা দেয়নি। এটা ঠিক নয়। তাদের তরফ থেকে সতর্কবার্তা এল হামলার পরে।”

সোশাল মিডিয়ায় প্রচারিত একটি সাম্প্রতিক ভিডিওতে দেখা গেছে, সীমান্ত শহর ইয়ারুন, যা প্রধানত একটি শিয়া গ্রাম, গত এক বছরে ইসরায়েলি বোমা হামলায় পতিত জমিতে পরিণত হয়েছে।

এইচআরডব্লিউ থেকে কাইস বলেছেন, লেবাননের অবস্থাকে গাজায় তোলা ছবিগুলো থেকে আলাদা করা যায় না এবং আরও অসংখ্য বেসামরিক লোক মারা যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

তিনি আল জাজিরাকে বলেন, “আমরা যা দেখছি তা থেকে বলা যায়, দেশের বেসামরিক নাগরিকরা নৃশংসতার মুখোমুখি হতে চলেছে বা নৃশংসতার শিকার হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।”

দীর্ঘস্থায়ী বাস্তুচ্যুতি

ইসরায়েল লেবাননের বিশাল অংশে কার্পেট বোমা ফেলেছে। এতে লোকের মাঝে দীর্ঘমেয়াদে বাস্তুচ্যুত থাকার ভয় ঢুকে পড়েছে। ঠিক গাজার মতো, যেখানে ইসরায়েল মূলত উত্তরাঞ্চলকে পরিষ্কার করেছে এবং এখনও সেখানে থাকা অবশিষ্টদের দক্ষিণে পালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিচ্ছে।

গাজার বাস্তুচ্যুতরা কেউ জানে না কখন বা আদৌ তারা উত্তরাঞ্চলে তাদের জীবন পুনরায় শুরু করার জন্য ফিরে আসতে পারবে কিনা।

দীর্ঘস্থায়ী বা স্থায়ী বাস্তুচ্যুতির সম্ভাবনা জাদ দিলাতিকেও অস্থির করে তোলে, যার পরিবার নাবাতিহ থেকে বৈরুতে পালিয়ে এসেছে।

তিনি বলেন, আশপাশের সবজির বাজার ও নাপিতের দোকানের মতো ভবন ও দোকানগুলো যেগুলো তার দৈনন্দিন জীবন ও শৈশবের অংশ ছিল সেগুলো এখন ধ্বংসস্তূপ।

তিনি আশঙ্কা করছেন, এরপর তার বাড়িতেও হামলা হতে পারে।

দিলাতি (২৩) আল জাজিরাকে বলেছেন, “তারা আমাদের বাড়ি টার্গেট করতে পারে কারণ তারা এটাই চায়। আমার মনে হচ্ছে আমি এমন একটি শহরে ফিরে যাব, যা আমি আর চিনি না।”

দিলাতি এই সম্ভাবনার কথা ভাবছেন যে, তিনি হয়তো বেশ কিছু সময়ের জন্য নাবাতিহে ফিরে যেতে পারবেন না, কারণ যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। এ ছাড়া ইসরায়েল আবারও দক্ষিণের কিছু অংশ দখল করার চেষ্টা করতে পারে, যেমনটি ১৯৮২ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত হয়েছিল।

৮ অক্টোবর, সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, ইসরায়েলি সৈন্যরা লেবাননের ভূমিতে তাদের পতাকা উত্তোলন করছে।

দিলাতি আল জাজিরাকে বলেন, “একটি সম্প্রসারণবাদী জাতি-রাষ্ট্রের পাশে বসবাস করার জন্য আমাদেরকে এই মূল্য শোধ করতে হচ্ছে।”

ইসরায়েলের আগ্রাসন এবং দক্ষিণ লেবাননে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ সত্ত্বেও দিলাতি এখনও বিশ্বাস করেন, তিনি তার সম্প্রদায়কে আবারও ইসরায়েলি আগ্রাসনে ছিন্নভিন্ন বাড়ি ও জীবন-জীবিকা পুনর্নির্মাণে সহায়তা করতে নাবাতিহে ফিরে আসবেন।

তিনি বলেন, “আমরা নাবাতিহ পুনর্নির্মাণ করব, যাতে এটি আগের চেয়ে আরও ভালো হয়। আমার বাবা-মা নাবাতিহে চাকরি করেন। আমার বোন নাবাতিহে স্কুলে যায়। আমি যা যা জানি, তার সবই আমি নাবাতিহে শিখেছি।

“আমি কল্পনা করতে পারি না যে, আমি ফিরে যেতে পারব না। আমি জানি ফিলিস্তিনিরা এর মধ্য দিয়ে গেছে এবং আমি জানি এটি একটি সম্ভাবনা হতে পারে, কিন্তু আমি এটি কল্পনা করতে পারি না।”

দিলাতি বলেন, “আমি বিশ্বাস করি, অবশেষে আমরাই যুদ্ধে জয়ী হব, যদিও এতে একটু সময় লাগবে।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত