উত্তেজনা চলছিল বছরজুড়ে, কৌশলগত স্থাপনায় পাল্টাপাল্টি হামলাও চলছিল। কিন্তু পারমাণবিক কিংবা সামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে হামলা হবে, তা অপ্রত্যাশিতই ছিল।
কিন্তু সেই হামলাই চালিয়েছে ইসরায়েল। শুক্রবার ভোরে ইরানের বিভিন্ন সামরিক ও পারমাণবিক স্থাপনা লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালাল তারা।
এতে ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানসহ শীর্ষ স্থানীয় তিনজন সামরিক কর্মকর্তা এবং ছয়জন পরমাণু বিজ্ঞানী নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
ইসরায়েল দাবি করেছে, দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ায় তারা বাধ্য হয়ে ইরানে এই হামলা চালিয়েছে। অন্যদিকে ইরানের শীর্ষ নেতা আয়াতোল্লাহ আলি খামেনি এই হামলার চরম প্রতিশোধ নেওয়ার হুমকি দিয়েছেন।
ওয়াশিংটনের মদদে ইসরায়েল এই হামলা চালিয়েছে বলে তেহরান অভিযোগ করলেও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, এই হামলার সঙ্গে তার দেশের কোনও সংশ্লিষ্টতা নেই। তবে আত্মরক্ষার ক্ষেত্রে ইসরায়েলের পাশে যুক্তরাষ্ট্র থাকবে বলে জানিয়েছেন তিনি।
ইসরায়েল-ইরানের এই উত্তেজনায় মধ্যপ্রাচ্যে বড় যুদ্ধের আশঙ্কায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নেতারা।
মধ্যপ্রাচ্যের এই দুই রাষ্ট্রের মধ্যে উত্তেজনা চরম আকার ধারণ করেছিল ২০২৪ সাল থেকেই। ওই বছরের এপ্রিলে দামেস্কে ইরানের দূতাবাসে হামলার জবাবে ইসরায়েলে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালিয়েছিল ইরান।
এরপর অক্টোবরে লেবাননের হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরাল্লাহ ও ইরানের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্বাস নিলফোরওশানকে ইসরায়েল হত্যা করার পর দেশটি লক্ষ্য করে আবার হামলা চালায় ইরান।
দুই বারই ইসরায়েলও পাল্টা হামলায় জবাব দিয়েছিল। তবে আগের দুই বারের হামলায় স্পর্শকাতর পারমাণবিক স্থাপনা ছিল হামলার লক্ষ্যবস্তুর বাইরে। এবার হামলার ব্যাপকত আগের সব বার ছাড়িয়ে গেল।
আল জাজিরার সাংবাদিক দোরসা জাব্বারি বলেন, ১৯৭৯ সালের পাল্টপাল্টি আক্রমণের পর গত বছরই দুই দেশের মধ্যে পাল্টাপাল্টি হামলা দেখা গিয়েছিল। তবে দুই পক্ষই কিছু নিয়ম-মেনে চলত। হামলার আগে পরস্পরকে সতর্ক করে বার্তা পাঠানোর ব্যবস্থা করত। এবার সেই বাধ ভেঙে গেল।
“এটা পুরোপুরি অপ্রত্যাশিত। এবারের হামলা আগের যে কোনও সময়ের চেয়ে ব্যাপক ও ধ্বংসাত্মক।”
“এটা চলতে থাকবে না, তেমন ভাবার কোনও সুযোগ নেই। এটা কোথায় গিয়ে থামবে, তাও বোঝা যাচ্ছে না,” বলেন জাব্বারি।
কোথায় কোথায় হামলা হলো
প্রাথমিক তথ্যে জানা গেছে, ইরানজুড়ে ছয়টি স্থানে বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল।
‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ নামে এই অভিযানে ২০০টি যুদ্ধবিমান অংশ নেয় বলে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী জানিয়েছে। পাল্টায় ইরানও ইসরায়েল লক্ষ্য করে ১০০টি ড্রোন হামলা চালায় বলে তেল আবিব জানিয়েছে।
ইরানের সরকারি বার্তা সংস্থা জানিয়েছে, ভোরে ঘণ্টাখানেকের ব্যবধানে দুই দফায় বিমান
হামলা চালায় ইসরায়েল। তৃতীয় দফায় হামলার কথাও বলা হচ্ছে, তবে তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
যে সব স্থানে হামলা হয়েছে, সেগুলো হলো-
১. রাজধানী তেহরানের সামরিক স্থাপনা।
২. তেহরানের দক্ষিণের নাতাঞ্জ শহর, যেখানে ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ প্ল্যান্ট রয়েছে।
৩. তেহরানের উত্তর-পশ্চিমের তাবরিজ শহর, যেখানে পরমাণু গবেষণা কেন্দ্র রয়েছে, সেই সঙ্গে আছে দুটি সামরিক ঘাঁটি।
৪. তেরানের দক্ষিণে ইস্পাহান শহর।
৫. তেহরানের দক্ষিণ-পশ্চিমের আর্ক শহর।
৬. তেহরানের পশ্চিমের কারমনশাহ শহর।
কারা কারা নিহত হলেন
হামলায় ইরানের সামরিক বাহিনীর শীর্ষ তিন কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন বলে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানিয়েছে।
তারা হলেন- ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান জেনারেল মোহাম্মদ বাগেরি, ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড বাহিনীর প্রধান হোসাইন সালামি এবং সেনা কমান্ডার মেজর জেনারেল গোলাম আলি রশিদ।
ইরানের পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক প্রধান, পার্লামেন্টের সাবেক সদস্য ফেরেদউন আব্বাসি নিহত হয়েছেন ইসরায়েলি হামলায়।
নিহত হয়েছেন ইসলামী আজাদ ইউনিভার্সিটির পরমাণু বিজ্ঞানী মোহাম্মদ মেহদি তেহরানচি। তিনি যে ভবনে নিহত হন, সেখানে আরও পরমাণু বিজ্ঞানী থাকেন।
এছাড়া আরও চারজন পরমাণু বিজ্ঞানী শুক্রবারের হামলায় নিহত হয়েছেন বলে ইরানের বার্তা সংস্থা তাসনিম জানিয়েছে।
তারা হলেন- আবদুলহামিদ মিনোশেহর, আহমদরেজা জোলফাগারি, আমিরহোসেন ফাখিহ ও মোতালেব জাদেহ।
তাসনিম আরও জানিয়েছে, ইসরায়েলি হামলায় তেহরানের তাজরিশ এলাকায় অন্তত ৫০ জন আহত হয়েছেন, যাদের শামরান হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
আহতদের মধ্যে ৩৫ জন নারী ও শিশু বলে জানিয়েছে সংবাদ সংস্থাটি।
দুই পক্ষের কী বক্তব্য
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল আইয়াল জামির বলেছেন, পিঠ দেয়ালে ঠেকে যাওয়ায় বাধ্য হয়ে এই হামলা চালিয়েছে তার দেশের সামরিক বাহিনী।
মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে আত্মরক্ষায় এই হামলা চালাতে হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
জেনারেল জামির বলেন, “যে কেউ যারা আমাদের চ্যালেঞ্জ জানাতে আসবে, তাদের চড়া মূল্য চুকাতে হবে।”
এই হামলার জন্য চরম প্রতিশোধ ইসরায়েলের ওপর নেওয়ার হুমকি দিয়েছেন ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আলি খামেনি।
তিনি এক বিবৃতিতে বলেন, জায়নিস্টরা আবার ঘৃন্য একটি কাজের মাধ্যমে তাদের হাতে রক্ত মাখাল। তাতে তাদে শয়তানি মনোভাব আবার প্রকাশ পেল।
“তাদের এখন শাস্তি পেতে হবে। ইরানের শক্তিশালী সামরিক বাহিনী তাদের ছেড়ে দেবে না। তাদের অবশ্যই তিক্ত ও বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতার জন্য প্রস্তুত হতে হবে। তারা অবশ্যই তা পাবে।”
এই হামলার সমুচিৎ জবাব ইসরায়েলকে দেওয়া হবে বলে ঘোষণা দিয়েছে ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড বাহিনী-আইআরজিসি।
যুক্তরাষ্ট্র কী করছে
ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে অভিযোগ করেছে, যুক্তরাষ্ট্রের মদদ পেয়েই ইসরায়েলের এতটা বাড় বেড়েছে এবং এই হামলার দায় হোয়াইট হাউসকও নিতে হবে।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের ফক্স নিউজের সাংবাদিক ব্রেট বেয়ার জানিয়েছেন, তিনি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে কথা বলেছেন এবং জেনেছেন যে ইরান-ইসরায়েলের ‘স্টুপিড’ যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র জড়াবে না।
বেয়ারের ভাষ্য অনুযায়ী ট্রাম্প তাকে বলেছেন, “ইরানের পরমাণু বোমা থাকতে পারবে না। তাদের আলোচনার টেবিলে ফিরতে হবে। তারা তা করবে বলে আশা করছি।”
ইরান পাল্টা হামলা চালালে প্রয়োজনে ইসরায়েলের পাশে যুক্তরাষ্ট্র থাকবে, এমনটাও বেয়ারকে বলেছেন ট্রাম্প।
তথ্যসূত্র : আল জাজিরা, সিএনএন, বিবিসি