ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের সাম্প্রতিক হামলাটি একটি ধারাবাহিকতার অংশ। এর শুরু হয়েছিল ৭ অক্টোবর ২০২৩ সালে হামাসের গাজা থেকে ইসরায়েলে চালানো হামলার মাধ্যমে।
ওই সময়ের পর থেকে ঘটতে থাকা প্রতিটি ঘটনা ধাপে ধাপে তেহরানকে দুর্বল করেছে। অন্তত সামরিক দিক থেকে ইসরায়েলকে আরও শক্তিশালী করেছে। এই প্রতিটি ঘটনা না ঘটলে শুক্রবার ইরানের উপর সরাসরি চালানো নতুন এই আক্রমণ সম্ভব হতো না।
প্রথম ঘটনা ছিল গাজায় ইসরায়েলি সামরিক অভিযান। এই অভিযান ছিল রক্তক্ষয়ী ও ব্যয়বহুল, বিশেষ করে ফিলিস্তিনিদের জন্য। তবে কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই এই অভিযান হামাসকে এতটাই দুর্বল করে তোলে যে, তারা আর ইসরায়েলি নাগরিকদের জন্য তাৎক্ষণিক কোনও বড় হুমকি ছিল না।
হামাস ছিল তথাকথিত ‘অ্যাক্সিস অব রেজিস্ট্যান্স’ বা প্রতিরোধ জোটের একটি অংশ। এই জোটটি ছিল মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন সশস্ত্র সংগঠনের একটি জোট, যা গত এক দশকে তেহরান গড়ে তুলেছিল।
এই জোটের উদ্দেশ্য ছিল পুরো অঞ্চলে ইরানের ক্ষমতা প্রসারিত করা এবং ইসরায়েলকে ইরানের পরমাণু কর্মসূচিতে হামলা চালানো থেকে বিরত রাখা। সুতরাং হামাসের পতনের মধ্যে এই পুরো জোটের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ আঘাত নিহিত ছিল।
এরপর গত বছরের এপ্রিলে ইসরায়েল সিরিয়ার দামেস্কে অবস্থিত ইরানি দূতাবাস কমপ্লেক্সে বিমান হামলা চালায়। এতে সাতজন নিহত হয়। এর জবাবে ইরান প্রথমবারের মতো সরাসরি ইসরায়েলের উপর ড্রোন হামলা চালায়, যদিও তা ছিল একেবারেই অকার্যকর।
ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে এতদিন ধরে যে সংঘর্ষ চলছিল পরোক্ষভাবে—প্রক্সি, গুপ্তহত্যা ও সীমান্তের বাইরে হামলার মাধ্যমে—এবার তা সরাসরি ও প্রকাশ্য সংঘাতে পরিণত হয়।
হামাস দুর্বল হয়ে পড়লে ইসরায়েলের লক্ষ্য হয় হিজবুল্লাহ। এটি লেবাননভিত্তিক একটি শক্তিশালী সংগঠন। আর এটিও ইরান সমর্থিত এবং ‘অ্যাক্সিস অব রেজিস্ট্যান্স’ জোটের সবচেয়ে শক্তিশালী অংশ।
ইসরায়েল গত সেপ্টেম্বরে হিজবুল্লাহর পুরো নেতৃত্বকে হত্যা করে এবং তাদের ভীতিকর ক্ষেপণাস্ত্র ভাণ্ডারের বড় অংশ ধ্বংস করে দেয়। তারা দক্ষিণ লেবাননের হিজবুল্লাহ নিয়ন্ত্রিত এলাকায় অনায়াসে প্রবেশ করে। সেখানে কোনও বড় প্রতিরোধের মুখে পড়তে হয়নি। এমনকি হিজবুল্লাহর সমর্থকরাও স্বীকার করেছে যে, এটি ছিল একটি বড় ধরনের পরাজয়।
ইরান এরপর আরেকটি ব্যর্থ বিমান হামলা চালায় ইসরায়েলের বিরুদ্ধে। এর জবাবে ইসরায়েল পাল্টা বিমান হামলা চালিয়ে ইরানের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার বড় একটি অংশ ধ্বংস করে দেয়। এর ফলে শুক্রবারের বড় আকারের হামলা চালানোর পথ উন্মুক্ত হয়।
আরেকটি গুরুতর ফল ছিল হিজবুল্লাহর আকস্মিক দুর্বলতা। এর ফলে তারা সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদের সরকারকে রক্ষা করতে পারেনি, যেটি ছিল ইরানের আরেক গুরুত্বপূর্ণ মিত্র। বিদ্রোহীরা সিরিয়ায় এক বড় হামলা চালায়। ডিসেম্বর মাসে আসাদ সরকারের পতন ঘটে এবং এর মধ্য দিয়ে তেহরান ও দামেস্কের মধ্যে দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের অবসান ঘটে।
এই ঘটনা প্রতিরোধ জোটকে আরও দুর্বল করে দেয়। সিরিয়ায় ইরানি প্রভাব হ্রাস পায় এবং ইসরায়েলি যুদ্ধবিমানের পক্ষে ইরানের ভেতরে দুর্বল লক্ষ্যবস্তুতে পৌঁছানো সহজ হয়ে পড়ে।
সিরিয়া ও ইরাকে ইরান-সমর্থিত মিলিশিয়ারা এই অবস্থায় বুঝে যায়, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে মুখে হুমকি দেওয়া আর বাস্তবে হামলা চালানো এক নয়। তাই তারা হামলা থেকে বিরত থাকে।
ফলে প্রতিরোধ জোটের একমাত্র সক্রিয় সদস্য হিসেবে ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরাই থেকে যায়। তারা লোহিত সাগরে জাহাজ চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে এবং তেল আবিব লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে। কিন্তু এসব ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলে কোনও কৌশলগত ক্ষয়ক্ষতি করতে পারেনি।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির সিদ্ধান্ত—ইরানের নিরাপত্তা প্রক্সিদের হাতে ছেড়ে দেওয়া একটি বড় ভুল হিসাবেই প্রতীয়মান হয়। অন্যদিকে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এই সাময়িক সুযোগকে কাজে লাগানোর চেষ্টা শুরু করেন এবং বহুদিন ধরে পরিকল্পনা করা বড় আকারের হামলার প্রস্তুতি নিতে থাকেন।
তবে এপ্রিলের মধ্যে এই হামলা চালানোর পরিকল্পনা সফল হয়নি। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানের সঙ্গে পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে নতুন চুক্তির জন্য মাত্র ৬০ দিনের সময় বেঁধে দিয়েছিলেন। ইসরায়েলের দাবি, ইরান প্রায় পরমাণু অস্ত্র তৈরি করে ফেলেছিল। এই সময়সীমা শেষ হয় গত সপ্তাহেই।
নেতানিয়াহু গত শুক্রবার ইরানিদের উদ্দেশে বলেন, তিনি আশা করেন ইসরায়েলের চলমান সামরিক অভিযান তাদের ‘স্বাধীনতা অর্জনের পথ’ সুগম করবে।
ইসরায়েল যদিও চায় না যে, ১৯৭৯ সালের ইরানি বিপ্লবের আগের সময়ের মতো পরিস্থিতি ফিরে আসুক। তখন ইরান ছিল ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র। তবুও ইসরায়েলি পরিকল্পনাকারীরা যে ধরনের লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ করেছে, তা অন্তত সেই শাসনব্যবস্থাকে ভেঙে দেওয়ার পথে নিয়ে যেতে পারে, যেটি ঐ ঐতিহাসিক বিপ্লবের পর থেকে ইরান শাসন করে আসছে।
এর একটি কারণ হলো, ইরানে এখনও সেই প্রজন্মের মানুষেরাই কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করছেন, যারা তাদের রাজনৈতিক জীবন শুরু করেছিলেন শাহর পতনের পরপরই কিংবা তারও আগে।
শুক্রবারের প্রথম দফার হামলায় যেসব ব্যক্তি নিহত হন, তাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন উচ্চপর্যায়ের সামরিক কর্মকর্তা। তারা ছিলেন ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পসের (আইআরজিসি) প্রাথমিক সদস্য। এই বাহিনী গঠিত হয় ১৯৮০ সালে। উদ্দেশ্য ছিল নতুন ইসলামী শাসনব্যবস্থাকে রক্ষা করা। পরে এটি বিপ্লবের মতাদর্শিক চালিকাশক্তিতে পরিণত হয়।
নিহতদের অনেকে ছিলেন ১৯৮০ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত চলা ইরান-ইরাক যুদ্ধের অভিজ্ঞ যোদ্ধা। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, এই যুদ্ধের মধ্য দিয়েই বর্তমান ইরানি শাসনব্যবস্থার ভিত্তি গড়ে ওঠে।
প্রথম দফার হামলায় নিহতদের মধ্যে কমপক্ষে একজন পারমাণবিক বিজ্ঞানীও ছিলেন, যিনি আইআরজিসির একজন সাবেক সদস্য ছিলেন। খামেনির একজন ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা আলি শামখানি হামলার লক্ষ্যবস্তু ছিলেন। তিনি ১৯৭০-এর দশকে ছিলেন একজন গোপন ইসলামী কর্মী। পরবর্তীতে তিনি ধাপে ধাপে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আসীন হন। খামেনি নিজে আয়াতুল্লাহ খোমেনির মৃত্যুর পর ১৯৮৯ সালে ক্ষমতায় আসেন। তবে তিনি তার ইসলামী রাজনৈতিক জীবন শুরু করেছিলেন ১৯৬০-এর দশকের শেষ দিকে।
এই যুদ্ধ শেষ হয়ে ধোঁয়া সরে গেলে ইরান যে আবার ইসরায়েল বা যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে ফিরে যাবে, সেই সম্ভাবনা অত্যন্ত কম। তবে যা খুবই সম্ভাব্য তা হলো, যেসব পুরনো নেতারা শাহর শাসন পতনের পর এই বিপ্লবী শাসনব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন এবং তা পরিচালনা করে আসছেন, তাদের ক্ষমতা ভয়াবহভাবে, এমনকি চূড়ান্তভাবে দুর্বল হয়ে পড়তে পারে।
তথ্যসূত্র : দ্য গার্ডিয়ান