ইরানে বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। ফলে আরও তীব্র হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ পরিস্থিতি। এই সংঘাত আরও গুরুতর রূপ নেবে কিনা, তা নির্ভর করছে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি ও তার উপদেষ্টাদের সিদ্ধান্তের ওপর।
একাধিক কঠিন বিকল্পের মধ্য থেকে তাদের সবচেয়ে কম ক্ষতিকর পথটি বেছে নিতে হবে। এমনও হতে পারে ইরান আরেক দফা ব্যালিস্টিক মিসাইল হামলা চালাতে পারে। তবে এমনটা ঘটলে ইসরায়েলও প্রতিশোধ নিতে ফের হামলা করবে।
হামলা-পাল্টা হামলার বিপরীতে আরেকটি বিকল্প হলো, একে অপরের ভূখণ্ডে এই ধ্বংসাত্মক হামলা বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া। তবে এক্ষেত্রে ইরানের জন্য ঝুঁকিও আছে। দেশটি পাল্টা হামলা না করলে এটি দেশটির দুর্বলতা প্রকাশ করবে। মনে হতে পারে, ইরান ইসরায়েলের সামরিক শক্তি ও যুক্তরাষ্ট্রকে ভয় পেয়ে হামলা চালায়নি।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা ও তার উপদেষ্টাদের এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সম্ভাবনা বেশি, যা তাদের দৃষ্টিতে দেশটির শাসনব্যবস্থার স্থায়িত্বের জন্য সবচেয়ে কম ক্ষতিকর হবে।
ফাঁকা হুমকি?
ইসরায়েলের হামলার আগে ও পরে পাল্টা হামলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে এমন ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে ইরানের সরকারি মিডিয়ায় প্রকাশিত বক্তব্যে। এই ভাষা ইসরায়েলের মতোই আত্মরক্ষার অধিকারকে তুলে ধরে। তবে পরিস্থিতি বিবেচনায় ইরান হয়ত তাদের হুমকি থেকে পিছু হটতেও পারে।
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ার স্টার্মার অবশ্য এমনটাই আশা করছেন। তার অবস্থান ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকারের পক্ষে।
তিনি বলেন, “আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই, ইরানের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার আছে। একইভাবে আমাদের উচিৎ এই অঞ্চলে আরও উত্তেজনা বৃদ্ধি এড়ানো এবং সব পক্ষকে সংযত হওয়া। ইরানকে প্রতিশোধ নেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।”
ইসরায়েলে ১ অক্টোবর ব্যালিস্টিক মিসাইল হামলার পর থেকে ইরানের দেওয়া বিবৃতিগুলো প্রায় সব একইরকম। এক সপ্তাহ আগে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি তুরস্কের এনটিভি নেটওয়ার্ককে জানান, “ইরানের ওপর যেকোনো আক্রমণকে আমাদের জন্য সীমা লঙ্ঘন হিসেবে বিবেচিত হবে। এমন হামলার জবাব না দিয়ে আমরা চুপ করে থাকব না।”
ইসরায়েলের হামলার কয়েক ঘণ্টা আগে ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র এসমাইল বাকাই বলেন, “ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের যেকোনো হামলার কঠোর জবাব দেওয়া হবে। ইরান ইসরায়েলের সীমিত হামলার জবাব দেবে না, এই ধারণা সম্পূর্ণ বিভ্রান্তিকর ও ভিত্তিহীন।”
এক বিবৃতিতে ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জাতিসংঘ সনদের ৫১ ধারা উল্লেখ করে জানিয়েছে, ইরান বিশ্বাস করে বিদেশি আগ্রাসনের জবাব দেওয়া তার অধিকার ও দায়িত্ব।
প্রাণঘাতী সংঘর্ষ
ইসরায়েল গত বসন্ত থেকেই উত্তেজনা বাড়িয়ে চলেছে। দেশটি ইরানকে হামাসের আক্রমণের গুরুত্বপূর্ণ সমর্থক হিসেবে বিবেচনা করে। তবে ইরান কিন্তু একাধিকবার বলেছে যে, তারা ইসরায়েলের সঙ্গে পূর্ণ মাত্রায় যুদ্ধ চায় না। অবশ্য এর মানে এই নয় যে, ইরান ইসরায়েল ও তার মিত্রদের ওপর চাপ দেওয়া বন্ধ করতে প্রস্তুত।
তেহরানের নেতারা ভেবেছিলেন, তারা যুদ্ধের চেয়ে ভালো পরিকল্পনা এটেছেন। দেশটি তার ‘প্রতিরোধের অক্ষ’ নামে পরিচিত মিত্রদের ব্যবহার করে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে হামলা চালায়। ইয়েমেনের হুতিরা লোহিত সাগরে নৌযান চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে। লেবাননের হিজবুল্লাহর রকেট হামলা থেকে বাঁচতে এরই মধ্যে অন্তত ৬০ হাজার ইসরায়েলি নিজেদের বাড়ি ছেড়েছে।
ইসরায়েলের প্রতিশোধ নেওয়া থেকে বাঁচতে ওদিকে কয়েক লাখ লেবানিজ তাদের বাড়িঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। ইসরায়েল সতর্ক করে দিয়েছিল যে, হিজবুল্লাহ ইসরায়েলে হামলা বন্ধ ও সীমান্ত থেকে পিছু না হটলে তারা ব্যবস্থা নেবে।
ইরান ইসরায়েলের সতর্কবার্তা শোনেনি। ফলে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে ইসরায়েল। আর এই কারণেই ইরানের নেতাদের সামনে এখন কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়া ছাড়া বিকল্প খুব কম।
পূর্ণ যুদ্ধে না জড়াতে ইরানের সিদ্ধান্তকে দুর্বলতা হিসেবে দেখেছিল ইসরায়েল। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও তার সামরিক নেতারা ঝুঁকি নিতে চেয়েছিলেন। কারণ তাদের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সমর্থন ছিল। শুধু বিপুল পরিমান অস্ত্র সরবরাহ করেই নয়, মধ্যপ্রাচ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সেনা পাঠিয়েও এই সমর্থন বজায় রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র।
ইসরায়েলের বিমান হামলায় গত ১ এপ্রিল সিরিয়ার দামেস্ক শহরে ইরানের একটি ভবন ধ্বংস হয়। এতে ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোরের একজন শীর্ষ কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ রেজা জাহেদিসহ বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নিহত হন।
ওই হামলার খবর ইসরায়েল আগে যুক্তরাষ্ট্রকে জানায়নি। এজন্য তখন ক্ষুব্ধ ছিল ওয়াশিংটন। কিন্তু তা সত্ত্বেও ১৩ এপ্রিল ইরান যখন ইসরায়েলে হামলা চালায়, তখন ইরানের ক্ষেপণাস্ত্রগুলো প্রতিহত করতে যুক্তরাষ্ট্রও এগিয়ে এসেছিল।
অগ্রগামী প্রতিরক্ষা হিসেবে বহু বছর ধরে লেবাননে হিজবুল্লাহকে সমরাস্ত্রে সজ্জিত করেছে ইরান। সেই প্রতিরক্ষার ওপর হামলা করেছে ইসরায়েল। অথচ ইরান ভেবেছিল যে, লেবাননের সীমান্তে ইসরায়েলকে আক্রমণ করতে পারবে হিজবুল্লাহ।
কিন্তু ইসরায়েল আগে পদক্ষেপ নেয়। তারা হিজবুল্লাহকে ঠকিয়ে কেনানো বোমা পেতে রাখা পেজার ও ওয়াকিটকিতে বিস্ফোরণ ঘটায়। হিজবুল্লাহপ্রধান হাসান নাসরাল্লাহকে হত্যা করে।
হিজবুল্লাহ এখনও লেবাননের ভেতরে ইসরায়েলি সেনাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে এবং রকেট ছুঁড়ছে। তবে তারা তাদের নেতা ও অনেক অস্ত্রশস্ত্র হারিয়ে বিপর্যস্ত অবস্থায় রয়েছে।
হিজবুল্লাহ ব্যর্থ হওয়ার পর ইরান পাল্টা প্রতিরোধের সিদ্ধান্ত নেয়। কারণ তার মিত্রদের পাশে দাড়িয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া না জানালে তা ওই অঞ্চলে দেশটির ইসরায়েল ও পশ্চিমাবিরোধী শক্তির নেতা হিসেবে অবস্থান নষ্ট হয়ে যাবে। এজন্যই তারা ১ অক্টোবর ইসরায়েলে ব্যালিস্টিক মিসাইল হামলা চালায়।
এরপর কিছুটা দেরিতে হলেও ২৫ অক্টোবর ইরানে হামলা করে ইসরায়েল। বলা হয়, ইরানে হামলায় ইসরায়েলের পরিকল্পনা ফাঁস হওয়ার কারণেই এই দেরি হয়েছে।
এত কিছুর মধ্যেও ইসরায়েল কিন্তু থেমে নেই। প্রতিদিন উত্তর গাজায় ইসরায়েলি হামলায় অনেক ফিলিস্তিনি মারা যাচ্ছে।
পাল্টাপাল্টি বন্ধে পদক্ষেপ
অব্যাহত উত্তেজনা থামানো কঠিন। কারণ সংশ্লিষ্ট দেশগুলো মনে করে, তারা প্রতিক্রিয়া না দেখালে তাদের অন্যরা দুর্বল ভাববে। আর এভাবেই যুদ্ধের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে।
এখন প্রশ্ন হলো, ইরান যুদ্ধের এই পর্যায়ে ইসরায়েলকে চরমপত্র দেবে কি না।
প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ১ অক্টোবরের পর ইসরায়েলের প্রতিশোধমূলক সিদ্ধান্তের সমর্থন করেন। তবে তিনি উত্তেজনা এড়াতে চেষ্টা করেন এবং প্রকাশ্যেই ইসরায়েলকে বলেছিলেন যে তারা ইরানের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ, যেমন পারমাণবিক, তেল ও গ্যাস স্থাপনাগুলোকে যেন বোমাবর্ষণ না করে। তিনি ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাড়ানোর জন্য সেখানে থাড অ্যান্টি-মিসাইল সিস্টেম মোতায়েন করেন। আর নেতানিয়াহু তার পরামর্শ গ্রহণও করেন।
আসছে নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এর ফল ইসরায়েল ও ইরানের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে। ট্রাম্প নির্বাচনে জিতে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসলে তিনি ইরানের পরামাণবিক, তেল ও গ্যাস স্থাপনায় হামলাও চালাতে পারেন।
মধ্যপ্রাচ্য এখন অপেক্ষা করে আছে। ইসরায়েল ইরানের মূল্যবান সম্পদকে লক্ষ্যবস্তু করতে চাইছে না। এতে প্রতিক্রিয়া জানানোর কিছু সময় পাবে ইরান। অন্তত কূটনৈতিক পর্যায়ে আলোচনার জন্য এই সময়টা গুরুত্বপূর্ণ। এখানে উল্লেখ্য যে, গত মাসে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ইরান বলেছিল যে তারা নতুন করে পারমাণবিক আলোচনা শুরু করতে প্রস্তুত।
বিশ্বের জন্য এই সময়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ইরান সবসময়ই পারমাণবিক বোমার বিরোধীতা করেছে। কিন্তু তাদের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ প্রকল্প মূলত পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির খুব কাছে নিয়ে গেছে। দেশটির নেতারা হয়তো তাদের শত্রুদের মোকাবেলায় নতুন উপায় খুঁজছেন। নিজেদের ব্যালিস্টিক মিসাইলের জন্য একটি পারমাণবিক ওয়্যারহেড তৈরির পরিকল্পনাও থাকতে পারে তাদের।
তথ্যসূত্র : বিবিসি।