Beta
শনিবার, ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
Beta
শনিবার, ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

হামাস হিজবুল্লাহ সিরিয়ার পর নেতানিয়াহুর চোখ কি ইরানে

Israel_Iran_1
[publishpress_authors_box]

গত বছরের অক্টোবরে ফিলিস্তিনের গাজায় যে সামরিক অভিযান ইসরায়েল শুরু করেছিল, এক বছরের কিছু বেশি সময়ের মধ্যে তা লেবানন হয়ে সিরিয়া পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে গাজায় হামাস ও লেবাননে হিজবুল্লাহ সামরিক শক্তি খুইয়ে এখন অনেকটাই দুর্বল। ইরান সমর্থিত এই দুই সশস্ত্র সংগঠনের পাশাপাশি সিরিয়ায় ইরানের ঘনিষ্ঠ মিত্র বাশার আল-আসাদের পতনকেও দেখা হচ্ছে ইসরায়েলের বিজয় হিসেবে।

এদের পাশাপাশি সম্প্রতি ইয়েমেনেও ইরান সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠী হুতিদের ওপর চড়াও হয়েছে ইসরায়েল। এর মধ্য দিয়ে ইরান হামাস, হিজবুল্লাহ, হুতি ও সিরিয়াকে নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলকে ঠেকাতে যে ‘প্রতিরোধের অক্ষ’ গড়ে তুলেছিল তা অনেকটাই মুখ থুবড়ে পড়েছে। এতে মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের শক্তিও খর্ব হয়েছে অনেকাংশে।

এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ইসরায়েল এবার ইরানের ওপরও চড়াও হতে পারে– এমন ইঙ্গিত দিয়ে রয়টার্সের এক বিশ্লেষণ বলছে, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর জন্য ২০২৫ সাল হবে তার দেশের সবচেয়ে বড় শত্রু ইরানের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ হিসাব-নিকাশের বছর।

নেতানিয়াহু তার কৌশলগত লক্ষ্য পূরণের জন্য প্রস্তুত। তিনি গাজায় সামরিক নিয়ন্ত্রণ আরও শক্তিশালী করতে চান। ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ব্যর্থ করাও তার লক্ষ্য। ইসরায়েলের প্রতি ইরানের এই কৌশলগত হুমকি নিষ্ক্রিয় করতে তিনি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।

মধ্যপ্রাচ্যের পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ইরানের সামনে এখন দুটি পথ খোলা আছে। তারা হয় তাদের পারমাণবিক বোমা তৈরির কর্মসূচি চালিয়ে যাবে, নয়তো তা স্থগিত করে আলোচনায় বসবে।

আন্তর্জাতিক ক্রাইসিস গ্রুপের মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা বিভাগের পরিচালক জুস্ট আর. হিল্টারম্যান বলেছেন, “পারমাণবিক কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার কারণে ইরান ইসরায়েলি হামলার শিকার হওয়ার উচ্চঝুঁকিতে রয়েছে।”

তিনি আরও বলেন, “ইসরায়েলের এমন হামলা চালানোর সম্ভাবনা অনেক বেশি। তবে এতে ইরান পুরোপুরি ধ্বংস হবে না।”

ফিলিস্তিনি বিশ্লেষক ঘাসান আল-খতিব বলেন, “ইরান যদি পারমাণবিক কর্মসূচি থেকে পিছু না হটে, তাহলে ট্রাম্প এবং নেতানিয়াহু হামলা চালাতে পারেন। কারণ এখন তাদের থামানোর মতো কিছু নেই।”

তবে তিনি মনে করেন, ইরান অতীতে বাস্তববাদিতা দেখিয়েছে, তাই তারা সামরিক সংঘাত এড়াতে আপস করতে পারে।

২০১৫ সালে ইরান ও ছয় বিশ্বশক্তির মধ্যে যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, ডোনাল্ড ট্রাম্প তার প্রথম মেয়াদেই সেই চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে এনেছিলেন। এবার তিনি ইরানের তেল শিল্পের ওপর আরও কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারেন।

তবে কূটনীতিকেই দীর্ঘমেয়াদে আরও কার্যকর সমাধান হিসাবে দেখছেন সমালোচকরা। তারা ট্রাম্পকে ইরানের সঙ্গে পরমাণু আলোচনায় ফেরার আহ্বানও জানিয়েছেন।


উত্তরাধিকার নির্ধারণ

ইরান ও গাজার সংকটের মধ্যে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর দীর্ঘদিন ধরে চলা দুর্নীতির মামলা তার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। ডিসেম্বরে এই মামলা আবার শুরু হয়েছে।

২০২৩ সালে গাজা যুদ্ধ শুরুর পর এই প্রথম নেতানিয়াহু আদালতে সাক্ষ্যও দিয়েছেন। এই মামলা ইসরায়েলিদের মধ্যে তীব্র মতবিরোধ সৃষ্টি করেছে।

নেতানিয়াহু সম্ভবত ২০২৪ সাল শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হামাসের সঙ্গে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তিও স্বাক্ষর করবেন। এই চুক্তির লক্ষ্য হবে ১৪ মাস ধরে চলে আসা গাজার যুদ্ধ বন্ধ করা এবং গাজায় আটক ইসরায়েলি বন্দিদের মুক্তি নিশ্চিত করা।

তবে যুদ্ধের পর গাজা ইসরায়েলের সামরিক নিয়ন্ত্রণেই থেকে যাবে, যদি না যুক্তরাষ্ট্র নেতানিয়াহুকে গাজার ক্ষমতা ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের (পিএ) কাছে হস্তান্তরে বাধ্য করে। নেতানিয়াহুও এর আগে বারবার তেমন কোনও সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছেন।

আরব দেশগুলোও ইসরায়েলের ওপর চাপ সৃষ্টি বা পিএ’র নেতৃত্ব পরিবর্তনের জন্য কোনও পদক্ষেপ নিচ্ছে না, যাতে তারা দায়িত্ব নিতে পারে।

ফিলিস্তিনি বিশ্লেষক ঘাসান আল-খতিব বলেন, “যুদ্ধবিরতির পরও ইসরায়েল গাজায় তাদের সেনা মোতায়েন রাখবে। কারণ ইসরায়েলের ভয়- তারা সেনা প্রত্যাহার করলে হামাস পুনর্গঠিত হওয়ার সুযোগ পেতে পারে। আর ইসরায়েলের বিশ্বাস, সামরিক অর্জন ধরে রাখার একমাত্র উপায় হলো গাজায় সামরিক উপস্থিতি বজায় রাখা।”

নেতানিয়াহুর জন্য এমন ফলাফল একটি কৌশলগত বিজয় হিসাবে বিবেচিত হবে। এটি তার লক্ষ্য পূরণে সহায়তা করবে। তার লক্ষ্য স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা আটকে দেওয়া এবং গাজা, পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমে দীর্ঘমেয়াদি ইসরায়েলি নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা। আন্তর্জাতিকভাবে এই অঞ্চলগুলোকে ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস যোদ্ধারা ইসরায়েলে হামলা চালানোর পর গাজা যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। হামাসের হামলায় ইসরায়েলে ১,২০০ মানুষ নিহত হয়। এ ছাড়া হামাস ২৫০ জনকে জিম্মি করে ধরে নিয়ে যায়।

ওই হামলার জবাবে ইসরায়েল হামাসের বিরুদ্ধে আকাশ, নৌ ও স্থলপথে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করে। ইসরায়েলের হামলায় এখন পর্যন্ত ৪৫,০০০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। এছাড়া প্রায় ২০ লাখ বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয় এবং অঞ্চলটি প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়।

গাজায় ইসরায়েলি ধ্বংসযজ্ঞ।

আরব ও পশ্চিমা কর্মকর্তারা বলেছেন, যুদ্ধবিরতি চুক্তি গাজায় ইসরায়েলি হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করলেও এতে ফিলিস্তিন-ইসরায়েল দীর্ঘদিনের বিরোধের মূল সমস্যাগুলোর সমাধান হবে না।

মাঠ পর্যায়েও ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা দিন দিন অনিশ্চিত হয়ে উঠছে। নেতানিয়াহুর সরকার বারবার এই ধারণা প্রত্যাখ্যান করেছে। এদিকে ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীরা আশাবাদী যে ট্রাম্প তাদের পক্ষে থাকবেন।

পশ্চিম তীরে ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের আত্মবিশ্বাস বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের আচরণ আরও সহিংস হয়ে উঠছে। সেখানে মহাসড়কের কিছু বিলবোর্ডে আরবি ভাষায় লেখা আছে, ‘ফিলিস্তিনের কোনো ভবিষ্যৎ নেই।’ এটি ফিলিস্তিনিদের ওপর ক্রমবর্ধমান চাপের প্রতিফলন।

ক্রাইসিস গ্রুপের হিলটারম্যান বলেছেন, ট্রাম্প প্রশাসন যদি সংঘাত শেষ করার জন্য উদ্যোগ নেয়, তাহলেও ‘সমাধান হবে ইসরায়েলের শর্তে’। তিনি বলেন, “ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের ব্যাপার শেষ, কিন্তু ফিলিস্তিনিরা এখনও সেখানে রয়ে গেছে।”

ট্রাম্পের আগের শাসনামলে নেতানিয়াহু কয়েকটি কূটনৈতিক বিজয় অর্জন করেছিলেন। এর মধ্যে ছিল ২০২০ সালে ট্রাম্পের প্রস্তাবিত ‘ডিল অফ দ্য সেঞ্চুরি’, যা ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের সমাধানের জন্য যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত একটি শান্তি পরিকল্পনা।

পরিকল্পনাটি যদি কার্যকর হয়, তবে এটি যুক্তরাষ্ট্রের নীতি এবং আন্তর্জাতিক চুক্তির ক্ষেত্রে এক বড় পরিবর্তন হিসাবে বিবেচিত হবে। এটি ইসরায়েলের পক্ষে সরাসরি সমর্থন দেয় এবং ঐতিহাসিকভাবে আলোচনায় ব্যবহৃত ভূমির-বিনিময়ে-শান্তি কাঠামো থেকে সরে যায়।

এই পরিকল্পনা ইসরায়েলকে অধিকৃত পশ্চিম তীরের বড় অংশ নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করার অনুমতি দেবে। এর মধ্যে ইহুদি বসতিগুলো এবং জর্ডান উপত্যকাও থাকবে।

এটি জেরুজালেমকে ‘ইসরায়েলের অবিভক্ত রাজধানী’ হিসাবে স্বীকৃতিও দেবে। এর ফলে ফিলিস্তিনিদের পূর্ব জেরুজালেমকে তাদের রাজধানী হিসাবে দাবির বিষয়টি কার্যত অস্বীকার করা হবে। এই দাবি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রধান লক্ষ্য এবং জাতিসংঘের প্রস্তাব অনুযায়ী স্বীকৃত।


সংকটময় ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে সিরিয়া

ইসরায়েলের সীমান্তের আরেক পাশে সিরিয়া এর ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রেসিডেন্ট আসাদের পতনের পর আহমদ আল-শারা, যিনি আবু মোহাম্মদ আল-জুলানি নামে বেশি পরিচিত, তার নেতৃত্বাধীন হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) বিদ্রোহী বাহিনী সিরিয়ার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেছে।

জুলানির সামনে এখন বিভক্ত সিরিয়াকে ঐক্যবদ্ধ করার বিশাল দায়িত্ব। দেশটির সামরিক ও পুলিশ বাহিনী ভেঙে পড়েছে। এইচটিএসকে শূন্য থেকে শুরু করে দেশকে পুনর্গঠন করতে হবে। তাদের সীমান্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে এবং বিভিন্ন জিহাদি গোষ্ঠী, আসাদ শাসনের অবশিষ্টাংশ ও অন্যান্য প্রতিপক্ষের হুমকি মোকাবিলা করতে হবে।

তবে পর্যবেক্ষকদের সবচেয়ে বড় উদ্বেগ হলো, একসময় আল-কায়েদার সঙ্গে যুক্ত এইচটিএস এখন বৈধতা পেতে নিজেদের সিরিয়ান জাতীয়তাবাদী শক্তি হিসাবে উপস্থাপন করছে। তবে তারা যদি আবার কঠোর ইসলামি মতাদর্শে ফিরে যায়, তাহলে তা সিরিয়ার জন্য বিভাজন সৃষ্টি করবে।

সুন্নি, শিয়া, আলাবি, কুর্দি, দ্রুজ এবং খ্রিস্টানদের মতো বিভিন্ন সম্প্রদায়ের আবাসস্থল সিরিয়ার ভবিষ্যৎ এইচটিএসের এই ভারসাম্য রক্ষার ওপর নির্ভর করছে।

হিলটারম্যান বলেছেন, “তারা যদি সিরিয়ান জাতীয়তাবাদের পথে সফল হয়, তাহলে সিরিয়ার জন্য আশার আলো দেখা যেতে পারে। কিন্তু যদি তারা তাদের আগের কঠোর ইসলামী মতাদর্শে ফিরে যায়, তবে এটি সিরিয়ার জন্য বিভেদমূলক হবে।”

“এতে এমন পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে যেখানে দীর্ঘ সময়ের জন্য সিরিয়া দুর্বল ও বিশৃঙ্খল অবস্থায় থাকবে, ঠিক যেমনটি আমরা লিবিয়া ও ইরাকে দেখেছি।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত