স্বল্পবসনা নারী আপবিটের সঙ্গে উদ্দাম নেচে যাচ্ছেন। তাকে ঘিরে আছে আছে জনা দশেক পুরুষ। আশপাশ থেকে ভেসে আসছে পুরুষদের ছুঁড়ে দেওয়া সিটি। আপবিট বাদ্যের তালে তালে ক্যামেরার ক্লোজ শর্টগুলো খুঁজে নিচ্ছে ‘আইটেম গার্ল’ এর শরীর।
এটি বলিউডের যে কোন আইটেম সং এর অতি সাধারণ একটি দৃশ্য।
বলিউডকে বলা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় মুভি ইন্ডাস্ট্রি। বাণিজ্যিক ধারার বলিউড সিনেমা মানেই তাতে ‘আইটেম সং’ থাকাটা যেন রেওয়াজে পরিণত হয়েছে।
‘আইটেম সং’ শব্দ বন্ধটির উৎপত্তি ‘আইটেম’ থেকে, যা কিনা বলিউডের একটি বহুল ব্যবহৃত শব্দ। ‘যৌনাবেদনময়ী নারী’ বোঝাতেই ‘আইটেম’ শব্দটি সেখানে ব্যবহার করা হয়। তার মানে ‘যৌনাবেদনময়ী নারী’ যে গানে নেচে অন্যকে বিনোদিত করবে তাই ‘আইটেম সং’। আর ‘আইটেম’ অভিহিত এই নারীদের গোটা সিনেমায় কোন চরিত্রে অভিনয় করতে দেখা যায় না। তাদের একমাত্র কাজ হলো গানে নেচে-কুদে দর্শকদের বিনোদিত করা।
‘আইটেম সং’ এর সঙ্গে গল্পের সম্পর্ক থাকা একেবারেই জরুরি নয়। বরং খানিকটা জোর করেই যেন কাহিনীর কোন এক ফাঁকে জুড়ে দেওয়া হয় এই আইটেম সং। যাতে থাকে উদ্দাম নৃত্য। নৃত্যের কেন্দ্রে থাকেন একজন ‘আইটেম’ বা আবেদনময়ী নারী। আর এইসব নৃত্যের দৃশ্যে দেখানো হয় বার কিংবা নাইট ক্লাব।
বলিউডে যেভাবে ‘আইটেম সং’ এল
বলিউডে আইটেম সং জনপ্রিয় হয়ে ওঠে কিংবদন্তী নায়িকা হেলেনকে দিয়ে। মিয়ানমার মানে সাবেক বার্মায় জন্ম নেওয়া হেলেনকে বলিউডে নিয়ে আসেন আরেক নৃত্যশিল্পী কাক্কু মোরে। সে সময় আজকের আইটেম সং কে বলা হতো- ক্যাবারে। এই কাক্কু মোরে ছিলেন একজন ক্যাবারে ড্যান্সার। ফলে হেলেনই প্রথম ‘আইটেম গার্ল’ কিনা এ নিয়ে আছে বিতর্ক। যদিও আজকের দিনের পরিবেশিত ‘আইটেম সং’-গুলোর সঙ্গে হেলেন অভিনীত ‘আইটেম সং’-গুলোরই বেশি মিল পাওয়া যায়।
বলিউড সিনেমায় ‘আইটেম গার্ল’ হিসেবে হেলেন এতই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন যে তাকে ছাড়া কোনও সিনেমা কল্পনা করাই কঠিন পড়ে সেই সময়। ‘হাওড়া ব্রিজ’ (১৯৫৮) সিনেমায় ‘মেরা নাম চিন চিন চু’ গানটিতে তার পারফরমেন্স ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। পরে আইটেম গার্ল থেকে অভিনয়েও নাম লেখান পদ্মশ্রী পদকে ভূষিত এই অভিনেত্রী।
সেই ১৯৫৮ সাল থেকেই দর্শক আকৃষ্ট করার একটি মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে ‘আইটেম সং’। সাধারণত সিনেমা মুক্তির আগেই মুক্তি দেওয়া হয় এইসব ‘আইটেম সং’। সিনেমাকে দর্শকপ্রিয় করার এক মোক্ষম অস্ত্র হিসেবেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে ‘আইটেম সং’-গুলো।
তবে ‘আইটেম সং’ নিয়ে আছে নানা মত।
অনেকের মতে – এই আইটেম গানগুলোয় নারীর পণ্যায়নই ঘটছে আগাগোড়া। যা কি না মানুষ হিসেবে নারীর মর্যাদা আরও খর্ব করছে। নারীকে গণ্য করা হচ্ছে না মানুষ হিসেবে। তাদের মতে, ভারতীয় সমাজে নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গী বেশ পোক্তভাবেই টিকে আছে। তার উপর এইসব ‘আইটেম সং’ এর জনপ্রিয়তা সমাজে নারীর অবস্থানকে আরও দুর্বল করে তুলছে।
ভিন্নমতও আছে।
অনেকের যুক্তি, আইটেম গানে নারীর সদর্প উপস্থিতি মূলত তার ক্ষমতায়নেরই প্রতিরূপ।
অনেকেই যদিও প্রশ্ন তুলেছেন- বলিউডের এইসব ‘আইটেম সং’ এর সঙ্গে ভারতীয় সমাজ কিংবা সংস্কৃতির আদৌ কোন সম্পর্ক আছে কিনা এই বলে।
আবার কারও কারও প্রশ্ন – আইটেম গানগুলো কি ভারতীয় সমাজ এবং সংস্কৃতির ভুল উপস্থাপন করছে?
নাকি উলটো ভারতীয় সমাজেরই প্রতিফলন ঘটছে আইটেম গানে?
নারীর পণ্যায়ন
মার্কেটিং স্পেশালিস্ট এবং গ্রাফিক ডিজাইনার জাহাবিয়া স্লেটওয়ালা পড়াশোনা করেছেন আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অব সাউথ ফ্লোরিডায়। তার মাস্টার্স এর সন্দর্ভের শিরোনাম ছিল ‘অবজেক্টিফিকেশন অব উইমেন ইন বলিউড আইটেম নাম্বার্স’।
সন্দর্ভে জাহাবিয়া উৎসগতভাবেই আইটেম সং-কে সমস্যাজনক মনে করছেন। তার মতে, মুম্বাই ফিল্মের ‘আইটেম’ শব্দটি প্রধানত নারী শিল্পীদের রগড় করে অভিহিত করা হয়। যার পেছনে লুকিয়ে আছে ‘উইমেন সেক্সুলাইজেশন’ বা নারীকে একটি যৌন বস্তুর অধিক কিছু মনে না করার মানসিকতা।
তার মতে, আইটেম নাম্বার বা আইটেম সং এর আসল মানেই হলো এমন গান যা মূখ্যত যৌনতাপূর্ণ। যেখানে নারী যৌন বস্তুর অধিক কিছু নয়। যেখানে নারী তার ব্যক্তি পরিচয় ছাপিয়ে কেবল যৌন আনন্দ প্রদানকারী একটি বস্তুতে পরিণত হয়।
তত্ত্বে নারীর পণ্যায়ন, যুক্তি তর্ক
সন্দর্ভে জাহাবি স্লেটওয়ালা আরও দাবি করেছেন বলিউডের ‘আইটেম সং’ দীর্ঘকাল ধরে নারীদের ইভটিজিং এর ব্যাপারে উৎসাহিত করে আসছে। এর কারণ সে-ই একই। আইটেম গানে নারীর পণ্যায়ন বা যৌন বস্তুতে পরিণত করা।
দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট এর মতে, “পণ্যায়নের মাধ্যমে একজন ব্যক্তিকে বস্তুর স্তরে নামিয়ে আনা হয়।”
বারবারা এল ফ্রেড্রিকসন এবং টমি অ্যান রবার্টস ১৯৯৭ সালে সর্বপ্রথম ‘অবজেক্টিফিকেশন থিওরি’ বা পণ্যায়নের তত্ত্বটি হাজির করেন। এই তত্ত্বের মাধ্যমে তারা দেখান যে বিনোদন মাধ্যম কিভাবে নারীদের যৌন বস্তু হিসেবে উপস্থাপন করে। যার ফলে নারীরা পুরুষদের কাছে মহামূল্যবান বস্তু হিসেবেই বিবেচিত হন।
জেনেফার স্টিভেন্স অবরি এবং সিনথিয়া এম ফ্রিসবির এক যৌথ গবেষণা নিবন্ধে উঠে এসেছে কিছু চমকপ্রদ বিষয়।
নিবন্ধটির নাম ‘সেক্সচুয়াল অবজেক্টিফিকেশন ইন মিউজিক ভিডিওস: আ কনটেন্ট অ্যানালাইসিস কমপেয়ারিং জ়েন্ডার অ্যান্ড জনরা, মাস কমিউনিকেশন অ্যান্ড সোসাইটি’।
নিবন্ধে তারা লিখেছেন, নারীর পণ্যায়ন এর সঙ্গে যুক্ত এমন কোনও মিউজিক ভিডিওতে নারীর শারীরিক অংশগ্রহণের প্রতিক্রিয়ায় ঘটে যায় আরেকটি ঘটনা।
এ ধরনের ভিডিওগুলো উঠতি তরুণদের বিশ্বাস করতে প্ররোচিত করে যে, পুরুষালী কামুক দৃষ্টি নারীর অতি আকাঙ্ক্ষিত এবং অনুমোদিত একটি বিষয়।
এমন কামুক দৃষ্টিকে (মেল গেইজ) তারা ব্যাখ্যা করছেন পুরুষের ক্ষমতা প্রদর্শনের শারীরিক উপায় হিসেবে।
চলচ্চিত্র তাত্ত্বিক লোরা মালভে একে নারী এবং পুরুষের মধ্যকার ক্ষমতা সম্পর্কের বহিঃপ্রকাশ হিসেবেও দেখছেন।
পাল্টা যুক্তি
ফ্যাশন ম্যাগাজিন ‘ভোগ’ ইন্ডিয়াতে ভারতীয় সাংবাদিক বারিষা তারিকের বলিউড আইটেম সং নিয়ে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়।
প্রবন্ধটির নাম ‘বলিউড আইটেম সংস আর বিং রিক্লেইমড বাই উইমেন টু স্ট্রিপ দেম অব দেয়ার সেক্সিজম’।
প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন “এই গানগুলো নাকি পুরুষের চাহিদা মেটাতেই তৈরি করা। অথচ আমরা গার্লস স্কুলের মেয়েরা, আমাদের স্কুলের ড্যান্স পার্টিতে এই গানগুলোই শুনে বড় হয়েছি। এমনকি নাচের প্রতিটি স্টেপ, কোথায় সবাই মিলে চিৎকার করতে হবে, কখন একজনকে মাঝে রেখে ঘুরে ঘুরে নাচতে হবে তার সবই আমাদের মুখস্থ ছিল। এই গানগুলো আমাদের নিজেদের মতো বাঁচার স্বাদ দিত। এতে করে কেউ আমাদের কামনা করছে কি করছে না, তা আমাদের কাছে কখনওই গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। পুরুষের কামুক দৃষ্টির সীমা ছাড়িয়ে গানগুলো নারীর যৌনতাকে যথার্থভাবেই উদযাপন করতে পারে। নারীর ক্ষমতায়নের সুরেই যেন বাধা গানগুলো।”
পদ্মভূষণ পুরস্কারপ্রাপ্ত ভারতের কিংবদন্তী অভিনেত্রী শাবানা আজমি অবশ্য ঢালাওভাবে আইটেম সং সম্পর্কে ইতিবাচক মত দিচ্ছেন না। তিনি মনে করেন কিছু কিছু ‘আইটেম সং’ বেশ আপত্তিকর। বিশেষত যেসব গানে নারীর শরীরের বিশেষ অঙ্গগুলো বার বার দেখানো হয়। তার মতে এগুলো ‘পুরুষের আকাঙ্ক্ষা জাগাতেই’ বানানো।
শাবানা আজমি আরও মনে করেন, সিনেমায় এবং বিজ্ঞাপনে নারীর পণ্যায়ন নারীদের এসব ক্ষেত্রে কাজ করতে আদতে উৎসাহিত করে না।
তবে তিনি এ-ও বলেন, “সব আইটেম নাম্বার কিন্তু খারাপ নয়। যেমন ওমকারা সিনেমার ‘বিড়ি জ্বালায়লে জিগার সে পিয়া’ গানে নারীকে কিন্তু শক্তিশালী চরিত্রে উপস্থাপন করা হয়েছে।”
কালচার এবং লাইফস্টাইল বিষয়ক লেখক মেহেক কাপুর বলিউড ‘আইটেম সং’ নিয়ে একটি প্রবন্ধ লেখেন। যেটি মিডিয়াম ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়।
‘ডিকোডিং দ্য আইটেম সংসস ইন ইন্ডিয়ান্স ফিল্মস’ নামের ওই প্রবন্ধে তিনি উল্লেখ করেন, “যতক্ষণ আইটেম গান কিংবা পর্নগ্রাফি সম্মতি নিয়ে তৈরি করা হচ্ছে, ততক্ষণ এইসব নিয়ে আমার কোনও সমস্যা নেই”।
তার মতে, আইটেম গানগুলো শীর্ষ অভিনেত্রীদের সম্মতিতে তাদের অংশগ্রহণে তৈরি করা হয়। মাত্র পাঁচ মিনিটের একটি আইটেম গানের জন্য তারা নেন লাখ কোটি টাকা। যেহেতু সম্মতি সাপেক্ষেই এটি হচ্ছে ফলে অন্যদের কেন এতে আপত্তি থাকবে?
আইটেম গান প্রশ্নে নৈতিকতার বিষয়টি তিনি একেবারেই উড়িয়ে দেন।
তার ভাষায়, নৈতিকতা খুবই ব্যক্তিগত বিষয় এবং এটি একেকজনের কাছে একেকরকম।
ভারতে ধর্ষণের ঘটনা এবং আইটেম সং
ভারতে ক্রমবর্ধমান ধর্ষণের ঘটনাকে কোন কোন সমাজ বিশ্লেষক, বলিউডের আইটেম সং- এ নারীর পণ্যায়নের তীব্র ও ক্রমবর্ধমান চিত্রের সঙ্গে মিলিয়ে পাঠ করতে চেয়েছেন।
এই আলোচনায় যাওয়ার প্রয়োজনে জাহাবিয়া স্লেটওয়ালার সন্দর্ভের (অবজেক্টিফিকেশন অব উইমেন ইন বলিউড আইটেম নাম্বার্স) দিকে আরেকবার ফিরে তাকাতে হয়।
জাহাবিয়া তার সন্দর্ভে বলিউড আইটেম সং এর দশক ভিত্তিক একটি তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরে। যেখানে দেখা যায়, ২০০০ সালে বলিউডের ‘আইটেম সং’ এক নতুন যুগে প্রবেশ করে। এ দশক থেকে নারীর খোলামেলা শরীর প্রদর্শন আগের যে- কোন দশকের চেয়ে তীব্র হয়। আর ২০১০ সাল থেকে বলিউড ইন্ডাস্ট্রি এই ধারাকেই একটু ভিন্নভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকে। এই দশকে আইটেম গানগুলো গল্পের প্লটের সঙ্গে কোন সম্পর্ক ছাড়াই সিনেমায় ব্যবহৃত হতে থাকে। সেই সঙ্গে শরীর প্রদর্শনে ক্যামেরাকে তীব্রভাবে প্ররোচকের ভূমিকায় হাজির করা হয়। নৃত্যরত অভিনেত্রীর ঠোঁট, পেট এবং নিতম্বে ক্যামেরা আরও বেশি করে জুম ইন আউটের ব্যবহার করতে থাকে। একই সময়ে ভারতে ‘আইটেম নাম্বার’ কিংবা গানে নারীর পণ্যায়ন নিয়ে আলোচনাও বাড়তে থাকে। আন্তর্জাতিক জার্নাল টার্কিশ জার্নাল অব কমপিউটার অ্যান্ড ম্যাথমেটিক্স এডুকেশনে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনেও এমন প্রমাণ পাওয়া যায়।
‘কন্টেন্ট অ্যানালাইসিস অব আইটেম সংস: রিফ্লেকশন অব আ টক্সিক সোশিও-কালচারাল মিলিয়া’ নামের ওই প্রতিবেদনে আইটেম সং এর লিরিক্স পুঙ্খানুপুঙ্খ ব্যাখ্যা করে উপস্থাপন করা হয়। আর তাতে দেখা যায়, ২০১০ সাল থেকে বলিউড আইটেম নাম্বারে পুরুষের যৌন আকাঙ্ক্ষা এবং কামুক দৃষ্টির উপস্থাপন ও নারী শরীরের যৌনায়ন এবং পণ্যায়ন ভয়াবহভাবে তীব্র হয়েছে।
ড. শিবালি শর্মা এবং ড. অনু দানদোনা যৌথভাবে এই গবেষণা করেন।
ঠিক এই সময়ে, ২০১২ সালে ভারতের সবচাইতে আলোচিত ধর্ষণের ঘটনাটি ঘটে।
২২ বছরের তরুণী জ্যোতি সিং তার বন্ধু অবীন্দ্র প্রতাপ পাণ্ডের সঙ্গে বাড়ি ফেরার পথে দিল্লীর বাসে গণধর্ষণের শিকার হন। তার বন্ধু প্রতাপ পান্ডে হন গুরুতর আহত। জ্যোতি সিং এর অবস্থা এতটাই গুরুতর ছিল যে তাকে বাঁচাতে সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হসপিটালে পাঠানো করা হয়। কিন্তু তাকে আর বাঁচানো যায়নি। মাউন্ট এলিজাবেথেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে জ্যোতি।
২০২৩ সালে নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ ভারতীয় সাংবাদিক বিদ্যা কৃষ্ণান এর একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়।
‘ইন ইন্ডিয়ান গ্যাং রেপ কালচার, অল উইমেন আর ভিকটিম’ নামের ওই লেখায় বিদ্যা ভারতে ধর্ষণের হারের উর্ধ্বগতির বিষয় উল্লেখ করেন।
ওই প্রবন্ধ হতে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ভারতে ২০১১ সালে, প্রতি ২০ মিনিটে একজন নারী ধর্ষিত হতেন। আর ২০২১ সালের ভেতরে তা গিয়ে দাঁড়ায় ১৬ মিনিটে একজন। এই এক দশকে ভারতে প্রতি বছর গড়ে ৩ লাখ ১০ হাজারের মতো ধর্ষণের ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে।
২০২০ সাল থেকে ২০২১ সালে ধর্ষণের হার ২০ শতাংশ বেড়ে যায়।
২০২১ সালে ভারতে গণধর্ষণের সংখ্যা ছিল ২,২০০।
গবেষণায় বলা হচ্ছে, ‘আইটেম সং’ এর সাথে আজকাল সিনেমার গল্পের কোন প্রাসঙ্গিকতা থাকছেনা। সে না থাকতেই পারে।
কিন্তু ভারতীয় সমাজের ক্রমবর্ধমান ধর্ষণের ঘটনার সঙ্গে এর প্রাসঙ্গিকতা একেবারেই যে নেই- তা কি বলা যাচ্ছে?
তবে কী ‘আইটেম সং’- এর চরিত্র বদলের ঘটনা সমাজকে প্রভাবিত করছে নাকি সমাজেই তৈরি হচ্ছে এমন আইটেম সং এর শর্ত।
বিশ্বায়নের হাওয়া এবং ভারতীয় চলচ্চিত্র
ভারতীয় সিনেমা নিয়ে টাটা ইন্সটিটিউট অব সোশ্যাল সায়েন্সের সহকারী অধ্যাপক পল্লবী ঝা ‘রিপ্রেজেন্টেশন অব উইমেন ইন ইন্ডিয়ান সিনেমা: অ্যানালাইসিস অব আইটেম সংস’ শিরোনামে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেন।
২০১৪ সালে প্রকাশিত এই গবেষণায় উঠে এসেছে ভারতীয় সিনেমার গুরুত্বপূর্ণ কিছু দিক।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে- বিগত তিন দশকে বিশ্বায়ন ভারতীয় সিনেমার গতিপথ নির্ধারণ করেছে। বিশ্বায়নের হাওয়া ভারতীয় সমাজে আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে প্রবেশ করে। এ সময় নয়া উদারতাবাদী অর্থনীতি বিশ্বায়নের হাত ধরে ভারতে প্রবেশ করতে থাকে। নতুন এই রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ভারতীয় সমাজ এবং চলচ্চিত্র শিল্পের উপর ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলতে শুরু করে। সোজা ভাষায়, পশ্চিমের আধিপত্যবাদী পুঁজিবাদী নন্দন ধারণা ভারতীয় চলচ্চিত্র শিল্প এবং তার নান্দনিকতাকে ভেতর থেকে বদলে দিতে থাকে।
আর এই প্রেক্ষাপটে চলচ্চিত্র নির্মাণে খরচ হতে থাকে কোটি কোটি টাকা। গল্পের চাইতেও সিনেমার বাণিজ্যিক দিকটি এ-সময় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে থাকে। দুঃখজনকভাবে, এটি ভারতীয় দর্শকদের সংবেদনশীলতায় বড় পরিবর্তন নিয়ে আসে।
নারীবাদী বয়ান
ডয়েচেভেলের এক প্রতিবেদনে উঠে আসে, ভারতে ক্রমবর্ধমান ধর্ষণ সংস্কৃতির কারণ। সাংবাদিক নেহাল জোহরির ওই প্রতিবেদনে ভারতের নারী অধিকার কর্মী ড. শ্রুতি কাপুরের বক্তব্য উল্লেখ করা হয়-
“ভারতীয় সমাজ একটি পিতৃতান্ত্রিক সমাজ। যে সমাজ পুরুষকেই বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকে। এখানে নারীরা সাধারণত দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক।”
তিনি আরও যোগ করেন, “শিশুরা খুব অল্প বয়সেই জেনে যায় যে একটি মেয়ের ইচ্ছা এবং মতামত কখনোই ছেলের মত গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে বিবেচিত হয় না। মেয়ে শিশু শুরু থেকেই পরাধীন হতে শেখে”।
কাপুরের এই বক্তব্যকে শখানেক পুরুষ ঘিরে থাকা ‘আইটেম গার্ল’ এর সঙ্গে মিলিয়ে দেখা যেতে পারে। উলটে পালটে দেখা যেতে পারে ‘আইটেম গার্ল’ এর সঙ্গে নারীর ক্ষমতায়নের বয়ানকে।
তাতে কথিত ক্ষমতায়িত নারী হিসেবে উপস্থাপিত ‘আইটেম গার্ল’ নিজেই নিজের ইচ্ছার চরিতার্থ করছেন নাকি পুরুষের পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রসূত (মেল গেজ) কামনার ‘আইটেম’ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছেন। আর এতে কী আসলেই তার নিজের মতামতের প্রতিফলন ঘটছে নাকি তিনি পুরুষের আকঙক্ষার বলি হচ্ছেন?
টাইমস অব ইন্ডিয়াতে সাংবাদিক অজয় দেব বার্মা লেখেন, “ভারতীয় চলচ্চিত্রে নারীর যে চিত্রায়ন আমরা দেখতে পাই তার বাস্তব উদাহরণ সমাজেই আছে। নারী শুধু চলচ্চিত্রেই নয়, সমাজেও পণ্যায়নের শিকার। চলচ্চিত্রে নারীর পণ্যায়ন অল্পবয়সী ছেলে-মেয়েদের এই বার্তা পাঠায় যে নারীকে বস্তু হিসেবে বিবেচনা করা খুবই গ্রহণযোগ্য। এটি লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতা, হয়রানি এবং বৈষম্যের দিকে সমাজকে নিয়ে যায়।”
অজয় দেবের এই প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘ব্রেকিং দ্য স্টেরিওটাইপস: দ্য হার্মফুল অব্জেক্টিফিকেশন অ্যান্ড সেক্সচুয়ালাইজেশন অব উইমেন ইন ইন্ডিয়ান সিনেমা’।
কারান জোহরের স্বীকারক্তি
বলিউডের পরিচালক কারান জোহর শি দ্য পিপল ডট টিভিতে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “যে মুহূর্তে সিনেমায় আপনি একজন নারীকে হাজার হাজার কামুক দৃষ্টি দেওয়া পুরুষের মাঝে নিক্ষেপ করেন, তখনই এটা একটা ভুল উদাহরণ তৈরি করবে।”
তিনি বলেন, “একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে এই ভুল আমি করেছি এবং এ-কাজ আমি আর কখনও করব না।”