আত্মহত্যার আগে ফেইসবুকে লিখে যাওয়া শিক্ষার্থীর অভিযোগে তোলপাড় চলছে ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন আর মানবাধিকার কমিশনসহ বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিক্রিয়ার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিয়েছে কিছু ব্যবস্থা।
এই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকা শুক্রবার রাতে কুমিল্লায় তার বাড়িতে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেন।
আত্মহত্যর আগে ফেইসবুকে একটি পোস্ট দেন তিনি। সেখানে তিনি সহপাঠী রায়হান সিদ্দিকি আম্মানের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন। সেই অভিযোগের প্রতিবিধান চাইতে গিয়ে সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামের কাছে নিগৃহীত হওয়ার অভিযোগও তোলেন এই শিক্ষার্থী।
তার মৃত্যুর পরপরই সোশাল মিডিয়া সরব হয়ে ওঠে এই আত্মহনন নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও বিক্ষোভে নামে। সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামের আচরণ অবন্তিকাকে আত্মহননে প্ররোচনার শামিল বলে মন্তব্য আসে মানবাধিকার কমিশন থেকেও।
কুমিল্লায় থাকা অবন্তিকার মা তাহমিনা শবনম অভিযোগ করেছেন, মেয়ে যে হেনস্থার শিকার হচ্ছেন, তা বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বশীলদের জানানো হলেও তারা কোনও ব্যবস্থা নেয়নি।
তবে শিক্ষক দ্বীন ইসলামের দাবি, দুই বছর আগে ‘মীমাংসিত’ বিষয়টি নিয়ে অবন্তিকার রেখে যাওয়া ফেইসবুক পোস্টের কারণে অবিচারের শিকার হচ্ছেন তিনি।
সহপাঠি আম্মানও দাবি করছেন, অবন্তিকার বিরুদ্ধে দুই বছর আগে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করেছিলেন এবং অবন্তিকা দোষ স্বীকারও করেছিলেন। তবে এরপর তাদের আরও কোনও যোগাযোগই ছিল না। আর শিক্ষক দ্বীন ইসলামেরও তার পক্ষ নেওয়ার অভিযোগ ঠিক নয়।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ত্রয়োদশ ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন অবন্তিকা। তবে এক বছর বিরতি দিয়ে তিনি চতুর্দশ ব্যাচে আম্মানের সহপাঠি ছিলেন।
কুমিল্লার ওয়াইএমসিএ স্কৃলের সাবেক শিক্ষার্থী অবন্তিকা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর বিভিন্ন সংগঠনে যুক্ত হন। তিনি সেইভ ইয়ুথ- স্টুডেন্টস অ্যাগেইনেস্ট ভায়োলেন্সের নির্বাহী কমিটির সদস্য ছিলেন। রংতুলি ইয়ুথ ফাউন্ডেশনের প্রচার সম্পাদকও ছিলেন তিনি। জাগ্রত মানবিকতাসহ আরও কয়েকটি সংগঠনেও কাজ করতেন তিনি।
গত ২৮ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে মঞ্চে দাঁড়িয়ে সবাইকে আত্মহত্যা না করে দৃঢ় মনোবল নিয়ে এগিয়ে চলার কথা বলেছিলেন অবন্তিকা। তার কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তার এমন মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না শুভাকাঙ্ক্ষীরা।
যার বিরুদ্ধে অবন্তিকার মূল অভিযোগ, সেই আম্মানও ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সংগঠনে যুক্ত। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ডিবেটিং সোসাইটির নির্বাহী কমিটির সদস্য তিনি। রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজের সাবেক ছাত্র আম্মান রেডিও প্রাইমে কাজ করেন।
সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম ব্যবস্থাপনা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই শিক্ষার্থী ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থার সময় ছাত্র বিক্ষোভের সময় গ্রেপ্তার করে কিছু দিন কারাগারে ছিলেন।
যা লিখে গেছেন অবন্তিকা
“আমি যদি কখনও সুইসাইড করে মারা যাই, তবে আমার মৃত্যুর জন্য একমাত্র দায়ী থাকবে আমার ক্লাসমেট আম্মান সিদ্দিকী, আর তার সহকারী হিসেবে তার সাথে ভালো সম্পর্ক থাকার কারণে তাকে সাপোর্টকারী জগন্নাথের সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম। আম্মান যে আমাকে অফলাইন-অনলাইনে থ্রেটের উপর রাখত, সে বিষয়ে প্রক্টর অফিসে অভিযোগ করেও আমার লাভ হয় নাই। দ্বীন ইসলাম আমাকে নানানভাবে ভয় দেখায় আম্মানের হয়ে যে আমাকে বহিষ্কার করা ওনার জন্য হাতের ময়লার মতো ব্যাপার। আমি জানি এখানে কোনো জাস্টিস পাব না। কারণ দ্বীন ইসলামের অনেক চামচা ওর পাশে গিয়ে দাঁড়াবে। এই লোককে আমি চিনতাম ও না। আম্মান আমাকে সেক্সুয়ালি এবিউজিভ কমেন্ট করায় আমি তার প্রতিবাদ করলে আমাকে দেখে নেওয়ার জন্য দ্বীন ইসলামের শরণাপন্ন করায়। আর দ্বীন ইসলাম আমাকে তখন প্রক্টর অফিসে একা ডেকে নারীজাতীয় গালিগালাজ করে। সেটা অনেক আগের ঘটনা হলেও সে এখনো আমাকে নানাভাবে মানহানি করতেছে বিভিন্ন জনের কাছে বিভিন্ন কথা বলে। এই লোক কুমিল্লার হয়ে কুমিল্লার ছাত্র কল্যাণের তার ছেলেমেয়ের বয়সী স্টুডেন্টদের মাঝে কী পরিমাণ প্যাঁচ ইচ্ছা করে লাগায়, সেটা কুমিল্লার কারও সৎসাহস থাকলে সে স্বীকার করবে। এই লোক আমাকে আম্মানের অভিযোগের প্রেক্ষিতে ৭ বার প্রক্টর অফিসে ডাকায় নিয়ে “…. তুই এই ছেলেরে থাপড়াবি বলছস কেন? তোরে যদি এখন আমার জুতা দিয়ে মারতে মারতে তোর ছাল তুলি তোরে এখন কে বাঁচাবে?’
আফসোস এই লোক নাকি ঢাবির খুব প্রমিনেন্ট ছাত্রনেতা ছিল। একবার জেল খেটেও সে এখন জগন্নাথের প্রক্টর। সো ওর পলিটিকাল আর নষ্টামির হাত অনেক লম্বা না হলেও এত কুকীর্তির পরও এভাবে বহাল তবিয়তে থাকে না এমন পোস্টে। কোথায় এই লোকের কাজ ছিল গার্ডিয়ান হওয়া, আর সো কিনা শেষমেশ আমার জীবনটারেই শেষ না হওয়া পর্যন্ত মুক্তি দিলো না।
আমি উপাচার্য সাদেকা হালিম ম্যামের কাছে এই প্রতিষ্ঠানের অভিভাবক হিসেবে বিচার চাইলাম।
আর আমি ফাঁসি দিয়ে মরতেছি। আমার উপর দিয়ে কী গেলে আমার মতো নিজেকে এত ভালোবাসে যে মানুষ, সে মানুষ এমন কাজ করতে পারে! আমি জানি এটা কোনো সলিউশন না। কিন্তু আমাকে বাঁচতে দিতেছে না, বিশ্বাস করেন। আমি ফাইটার মানুষ। আমি বাঁচতে চাইছিলাম! আর পোস্ট মর্টেম করে আমার পরিবারকে ঝামেলায় ফেলবেন না। এমনিতেই বাবা এক বছর হয় নাই মারা গেছেন আমার মা একা। ওনাকে বিব্রত করবেন না। এটা সুইসাইড না, এটা মার্ডার। টেকনিক্যালি মার্ডার। আর আম্মান নামক আমার ক্লাসমেট ইভটিজারটা আমাকে এটাই বলছিল যে আমার জীবনের এমন অবস্থা করবে যাতে আমি মরা ছাড়া কোনো গতি না পাই। তাও আমি ফাইট করার চেষ্টা করছি। এখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে সহ্য ক্ষমতার।”
মায়ের কান্না
কিছু দিন আগে স্বামীকে হারানো তাহমিনা শবনম এবার মেয়েকে হারিয়ে ভেঙে পড়েছেন। কুমিল্লায় নিজ বাড়িতে শনিবার তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে সাংবাদিকদের বলেন, “আমার এখন কিচ্ছু নাই। আমি নিজে সুইসাইড করে ফেললেও কিচ্ছু না ….”
তিনি বলেন, “আমি বিচার দিয়ে যাচ্ছি। জগতের কাছে বিচার দিয়ে যাব। আমার মেয়ের কি অপরাধ ছিল? আমার মেয়ে ভালো স্টুডেন্ট, এটাই কি তার অপরাধ? আমার মেয়ে ডিপার্টমেন্টে ফার্স্ট ছিল, এটাই তার অপরাধ? যেই মেয়ে ডিপার্টমেন্টে ফার্স্ট, সে কীভাবে আত্নহত্যা করে?
“আমি তো চেয়ারম্যানকে জানাইছি। আমি প্রক্টরকে জানিয়েছি। সে দেখে নাই। এখনে তো বিচার দাবি করছি। সবাইকে জানিয়েছি। কী ব্যবস্থা নিয়েছে তার? তারা ব্যবস্থা নেওয়ার পরে আমাদেরকে সরি বললো। যে আর এগুলো হবে না। তারপর রাফি নামের একটা ছেলে স্ট্যাটাস দিল, হাত-পা গুঁড়াইয়া শেষ করে দিবো। তারপর আমি দ্বীন ইসলাম নামে এক টিচারকে জানিয়েছি। ও আমার মেয়েকে বিরক্ত করে।”
আম্মান যা বলছেন
অবন্তিকার মৃত্যুর পর ফেইসবুকে দীর্ঘ এক পোস্টে দুই বছর আগে ঘটনার শুরু থেকে বর্তমান পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে নিজের দায় অস্বীকার করেন।
শুধু অবন্তিকার ফেইসবুক পোস্ট দেখে কাউকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না নেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে তিনি িলখেছেন, “ঘটনার সূত্রপাত ০৪.০৮.২০২২ সালে। একটা ফেইক আইডি থেকে আমাদের ১৪ জন শিক্ষার্থীর নামে গুজব ছড়িয়ে কয়েকজন বন্ধুদের কাছে পাঠানো হয়। যেখানে আমার নামেও অনেক মিথ্যা অপবাদমূলক কথা ছিল। এমনকি অবন্তীর নিজের নামও সেই টেক্সটের মধ্যে ছিল।
“যখন এমন মেসেজ সামনে আসলো, আমি সবাইকে নিয়ে কোতোয়ালি থানায় যাই। সেখানে অবন্তী নিজেও উপস্থিত ছিল। পরবর্তীতে জিডি করা হয়। জিডি করে ফেরার সময় অবন্তী স্বীকার করে যে ওই ফেইক আইডিটা সে নিজে খুলেছে। অন্য একটি মেয়েকে ফাঁসানোর জন্য সে এই কাজটি করেছে।
পরবর্তী দিন আইও (কোতোয়ালি থানা)কে আমরা জানাই যে আমাদেরই এক ফ্রেন্ড ঘটনাটি ঘটিয়েছে। এসআই আমাদের থেকে অবন্তীর আম্মুর ফোন নাম্বার নিয়ে কল করেন। কল ধরেন অবন্তীর বাবা। সেখানে এসআই ভাই বলেন, ‘আপনার মেয়ের বন্ধুদের মধ্যেই যেহেতু বিষয়টি ঘটেছে, সেহেতু নিজেরা বসে মিউচুয়াল আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ের মাধ্যমে সমাধান করে ফেলেন’। আমরা সবাই যেহেতু জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, সেহেতু প্রক্টর স্যারের কাছেও আমরা ব্যাপারটা অবহিত করি, যাতে অপ্রীতিকর কিছু ঘটলে যেন প্রক্টরিয়াল বডি বিষয়টা সম্পর্কে অবগত থাকেন।”
আম্মান লিখেছেন, “অবন্তী এই ঘটনার আগ পর্যন্ত আমার বা আমাদের বেশ ভালো বন্ধুই ছিল। যাই হোক, প্রক্টর অফিস থেকে ওর পরিবারের কাছে চিঠি যায়। তার পরিপ্রেক্ষিতে অবন্তীর বাবা-মা ক্যাম্পাসে আসেন। প্রক্টরিয়াল তদন্ত কমিটির সামনে পুরো ঘটনার বিস্তারিত স্বীকার করে অবন্তী এবং একটা মুচলেকা দেয়। সেই দিনই অবন্তীর আম্মা আমাদের সবার সাথে বাইরে এসে কথা বলেন এবং বলেন ভালোভাবে বাকি সময়টা যেন আমরা মিলে-মিশে পার করি। উনি ওইদিন আমাদের সবাইকে কেকও কিনে খাওয়ান। তার পরবর্তী সময়ে আমি অবন্তিকার সাথে কোনো কথা বলিনি। আর ফেইসবুকে তার সাথে আমার তারপর থেকে কোনও যোগাযোগই হয়নি। এমনকি তার সাথে আমার ওই ঘটনার পরে কোনো মাধ্যমেই যোগাযোগ হয়নি।”
আত্মপক্ষ সমর্থনে আম্মান বলেন, “যারা (অবন্তিকার) পোস্টটি পড়ে একতরফা চিন্তা করছেন, তারা একটু ঠাণ্ডা মাথায় এটা পড়বেন। একজন মারা গেছে, তার জন্য দুঃখ পাওয়াটা অবশ্যই যৌক্তিক এবং স্বাভাবিক। আমি নিজেও ব্যথিত এবং মানতে কষ্ট হচ্ছে যে এমন একটা তুচ্ছ ঘটনাকে মাথায় রেখে ২ বছর পরে এসে এমন একটা কাজ অবন্তী করবে।
“তবে একটু ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখেন। এবং আমার কাছে প্রত্যেকটা বিষয়েরই ডকুমেন্টস আছে। সবাই যদি ডকুমেন্টসগুলোও স্পষ্ট করে দেখেন তাহলে হয়ত বুঝতে পারবেন। আর একটা প্রশ্ন কি আপনাদের মাথায় আসছে না যে মেয়েটিকে যদি আমি অনলাইনে কোনোভাবে ডিস্টার্ব করতাম, তবে সে সেটার স্ক্রিনশট অবশ্যই দিতে পারতো। সে সেটা কেন দিল না? তাকে কোনোভাবেই ডিস্টার্ব করার মতো মানসিকতা আমার কখনোই ছিল না। সে আমাকে ব্লক করে রেখেছিল। তার সাথে আমি আজকে পর্যন্তও ফেইসবুকে বা অন্য কোনও মাধ্যমে কথাই বলিনি।”
“উপরন্তু বলে রাখা ভালো, এই ঘটনার কয়েক মাস পরে অবন্তিকার বাবা মারা যান। হতে পারে অবন্তিকা তার মনে ক্ষোভ বেঁধে রেখেছিলো যে আমাদের কারণেই তার বাবা কষ্ট পেয়ে মারা গেছেন। হতে পারে এই ভাবনা থেকে অবন্তিকার মনে আমার বিরুদ্ধে ক্ষোভের সৃষ্টি হয় এবং তীব্র প্রতিশোধ প্রবণ চেতনা থেকেই হয়ত আজকের এই ঘটনা ঘটানো তার দ্বারা।”
শিক্ষক দ্বীন ইসলামের সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাখ্যায় আম্মান লিখেছেন, “দ্বীন ইসলাম স্যারের সাথে আমার একজন শিক্ষার্থী হিসেবে যতটুকু সালাম বিনিময় যোগ্য সম্পর্ক, ততটুকুই ছিল। এর বাইরে খুব বেশি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল না যে স্যার আমার হয়ে অবন্তীকে কয়েকটা কটূ বাক্যও বলতে পারে।
“সবাই আমার দিকটাও ভাববেন। ভাববেন আমি ওর সাথে কোনও যোগাযোগ না রেখেও অযথা একটা ভুল বোঝাবুঝির স্বীকার হচ্ছি,” লিখেছেন তিনি।
দোষ থাকলে মাথা পেতে নেব : দ্বীন ইসলাম
সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম দাবি করছেন, অবন্তিকা যে বিষয়টি তুলেছেন, তা দেড় বছর আগে মীমাংসা হয়ে গিয়েছিল।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমি দোষী হলে দোষ মাথা পেতে নেব। আর নির্দোষ হলে বেরিয়ে যাব।”
২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে গ্রেপ্তার হয়ে ৫ মাস ২২ দিন কারাগারে ছিলেন এবং বন্দি থেকেই পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন বলে জানান তিনি।
দ্বীন ইসলাম সংবাদমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে ঘটনার পূর্বাপর তুলে ধরেন। আম্মানদের জিডির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ভুয়া অ্যাকাউন্টের কথা স্বীকার করার পর তার বন্ধুরা তাকেসহ প্রক্টর অফিসে নিয়ে এসে অবন্তিকার বিরুদ্ধে ২০২২ সালের ৮ আগস্ট একটা লিখিত অভিযোগ দেয়।
“পরে গত ১৬.০৮.২০২২ ইং তারিখে প্রক্টর স্যারের উপস্থিতিতে আমি এবং সহকারী প্রক্টর গৌতম কুমার সাহা অবন্তিকা এবং অবন্তিকার অভিভাবকদের প্রক্টর অফিসে আসার জন্য আহ্বান করি। পরে অবন্তিকার মা মিটিং এ আসে এবং এখানে অবন্তিকার ক্লাসমেটসসহ (অভিযোগকারীরা) সবাই উপস্থিত ছিল। তখন অবন্তিকার মা তার ব্যাচমেট (যারা এ অভিযোগ করেছে) তাদের কাছে ঘটনার সত্যতা শুনে বলে যে, আমার মেয়ে যা করেছে ভুল করেছে। ঘটনার জন্য অভিযোগকারী সকলের কাছে আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করে এবং ভবিষ্যতে আমার মেয়ে আর এই ধরনের কাজ করবে না বলে প্রতিশ্রুতি দেয়। এবং বলেন, আমার মেয়ে ভালো শিক্ষার্থী, কিন্তু সে কয়েকদিন ধরে মানসিকভাবে অসুস্থ এবং ওষুধ খাচ্ছে। তখন তার ব্যাচমেটরা বিষয়টা মানবিক এবং ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখেন। এভাবে বিষয়টা প্রাথমিকভাবে মীমাংসা করা হয়।”
তবে ওই জিডি প্রত্যাহার করা হয়নি জানিয়ে দ্বীন ইসলাম বলেন, “অবন্তিকার মা জিডিটা তুলে নেওয়ার জন্য অভিযোগকারীদের বারবার অনুরোধ করেন। কিন্তু অভিযোগকারীরা জিডি তুলে নিতে অসম্মতি জানায়, কারণ তাদের ধারণা অবন্তিকা ভবিষ্যতে এ ধরনের আচরণ আবারও করতে পারে। তখন আর জিডিটা সঙ্গে সঙ্গেই তোলা সম্ভব হয়নি।”
কিছুদিন পরে অবন্তিকা ও তার মা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন জানিয়ে সহকারী প্রক্টর বলেন, “যেহেতু তিনি আমার এলাকার এবং তিনি একজন অভিভাবক, আমি আমার জায়গা থেকে সর্বোচ্চটুকু দিয়ে আপ্যায়ন করি। ওইদিন অবন্তিকার মা আমাকে জানান, অবন্তিকার হলের বন্ধুরা ওর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করছে না। এতে অবন্তিকা মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছে। তখন আমি তাদেরকে প্রক্টর অফিসে লিখিতভাবে অভিযোগ করার পরামর্শ দিই। অবন্তিকার মা বলে, যা হওয়ার হয়ে গেছে এখন আর এ বিষয় নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে চাচ্ছি না। আমি আমার মেয়েকে হলে রাখব না, এতে করে তার পড়াশোনা খারাপ হয়ে যাবে এবং সে মানসিকভাবে আরও ভেঙে পড়বে। তখন আমি তাকে বলি আপনি অভিভাবক, যা ভালো মনে করেন সেটাই করেন।”
অবন্তিকার পাশাপাশি তার বাবারও ডিপ্রেশনে ভোগার কথা তার মায়ের কাছে শুনেছিলেন বলে দাবি করেন দ্বীন ইসলাম। তিনি বলেন, গত বছরে অগাস্টের পর অবন্তিকা কিংবা তার পরিবারের কারও সঙ্গে এ বিষয়ে তার কোনও কথা হয়নি।
একটি ফেইসবুক স্ট্যাটাস দেখে কাউকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না নেওয়ার অনুরোধ রেখে দ্বীন ইসলাম লিখেছেন, “প্রথমত আমি একজন মানুষ, দ্বিতীয়ত আমি একজন শিক্ষক, তৃতীয়ত আমি দুজন কন্যাসন্তানের বাবা। আপনাদের কাছে অনুরোধ আপনারা আমার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনুন এবং প্রকৃত ঘটনাটা জানুন। দয়া করে আমার জীবনটাকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়ে আমার সন্তানদের এতিম করবেন না।”
বিক্ষোভের পর বহিষ্কার
অবন্তিকার আত্মহত্যার থবর শুনেই শুক্রবার রাত সাড়ে ১১টার পর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ শুরু করে এক দল শিক্ষার্থী। তারা দায়ীদের শনিবার দুপুরের মধ্যে শাস্তির দাবি জানায়।
তাদের ছয় দফা দাবি হলো- অবন্তিকার মৃত্যুর সুষ্ঠু তদন্ত করতে হবে; দ্বীন ইসলাম ও আম্মানকে গ্রেপ্তার করে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে; অভিযুক্ত দুইজনকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করতে হবে; ভিক্টিম ব্লেমিং যারা করছেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে; অবন্তিকার পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে; বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বাদী হয়ে মামলা করতে হবে এবং নারী নিপীড়ন সেলকে আরও সক্রিয় করতে হবে।
এসব দাবি পূরণ না হলে আগামী সোমবার (১৮ মার্চ) সকালে উপাচার্যের কার্যালয় ঘেরাও করার হুঁশিয়ারি দেন তারা।
এরপর শনিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, অবন্তিকার মৃত্যুর কারণ হিসেবে শিক্ষার্থী রায়হান সিদ্দিকী আম্মানকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। তাকে গ্রেপ্তারের নির্দেশও দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
এছাড়া সহকারী অধ্যাপক দ্বীন ইসলামকে সাময়িক বরখাস্ত এবং সহকারী প্রক্টরের পদ থেকে তাৎক্ষণিক অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে বলে জানানো হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, ঘটনা তদন্তে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির অধ্যাপক ড. মো. জাকির হোসেনকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটিকে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে দ্রুত উপাচার্যের কাছে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
এদিকে শিক্ষক দ্বীন ইসলাম এবং শিক্ষার্থী আম্মানকে আটকের খবর শনিবার রাতে দিয়েছে পুলিশ।