Beta
মঙ্গলবার, ১১ নভেম্বর, ২০২৫
Beta
মঙ্গলবার, ১১ নভেম্বর, ২০২৫

জাকসু ভোটে ছায়া ফেলল শিক্ষকের মৃত্যু

জাকসু নির্বাচন শেষ হওয়ার ২৪ ঘণ্টা পরও চলছিল ব্যালট গণনা। সিনেট ভবনে বসে থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে পড়েন শিক্ষার্থীরা।
জাকসু নির্বাচন শেষ হওয়ার ২৪ ঘণ্টা পরও চলছিল ব্যালট গণনা। সিনেট ভবনে বসে থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে পড়েন শিক্ষার্থীরা।
[publishpress_authors_box]

জাকসু ভোট শেষ হওয়ার ২৪ ঘণ্টা পরও ব্যালট গণনা শেষ করা যায়নি; ফলে পাওয়া যায়নি ফলাফল। তারমধ্যে এক শিক্ষকের মৃত্যুতে শোকের আবহ তৈরির সঙ্গে ক্ষোভের সঞ্চার করেছে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অব্যবস্খাপনা, অভিযোগ আর বর্জনের মধ্যে বৃহস্পতিবার বিকাল ৫টায় জাকসু ও হল ছাত্র সংসদের নির্বাচনে ভোটগ্রহণ শেষ হয়।

তার দুই দিন আগে অনুষ্ঠিত ডাকসুর মতো জাকসুতেও ওএমআর মেশিনে ভোট গণনার প্রস্তুতি ছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের।

কিন্তু জামায়াতে ইসলামীর এক নেতার কোম্পানি থেকে ওই যন্ত্র আনার খবরে সমালোচনা ওঠায় ব্যালট পেপার হাতে গণনার সিদ্ধান্ত হয়। তাছাড়া কিছু ক্ষেত্রে সব প্রার্থীর নাম ব্যালটে না ওঠায় হাতে লিখেও ‘টিক’ দিতে হয়েছে ভোটারদের। ফলে সেগুলোও মেশিনে গণনা সম্ভবপর ছিল না।

২১টি হলে ভোটগ্রহণ শেষে সব ব্যালট বাক্স ক্যাম্পাসের সিনেট ভবনে নেওয়া হয়। তারপর শুরু হয় গণনা। শুক্রবার বিকাল অবধি হল ছাত্র সংসদের ব্যালট গণনা শেষ হলেও কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের ব্যালট গণনা শেষ করা যায়নি।

এতে সংশ্লিষ্ট যে শিক্ষক ও কর্মচারীরা ছিলেন, তারা ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। সেই সঙ্গে ফল জানতে বসে থাকার সময় দীর্ঘ হওয়ায় হতাশ হয়ে পড়েছেন শিক্ষার্থীরা।

ভোট গণনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা ধারণা দিয়েছেন, এটা শেষ করে ফল ঘোষণা করতে শুক্রবার রাত লেগে যেতে পারে।

গত ৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) এবং হল ছাত্র সংসদের নির্বাচন চলার মধ্যে অসুস্থ হয়ে এক সাংবাদিকের মৃত্যু হয়েছিল।

জাকসুতে ভোট গণনা চলার সময় শুক্রবার সকালে সিনেট ভবনে অসুস্থ হয়ে পড়েন চারুকলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জান্নাতুল ফেরদৌস মৌমিতা। হাসপাতালে নেওয়ার পর তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়।

৩১ বছর বছর বয়সী জান্নাতুল ফেরদৌস প্রীতিলতা হলে পোলিং অফিসারের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি বৃহস্পতিবার ওই হলে ভোটগ্রহণ শেষে বাসায় ফিরে গিয়েছিলেন।

চারুকলা বিভাগের সভাপতি শামীম রেজা সাংবাদিকদের বলেন, সকাল ৮টার দিকে ভোট গণনার জন্য জান্নাতুল আবার সিনেট ভবনে আসেন। ভোট গণনা কক্ষের দরজার সামনে হঠাৎ ঢলে পড়ে যান তিনি।  

দুপুরে এই শিক্ষকের জানাজা হয় বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মাঠে। সেখানে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা কান্নায় ভেঙে পড়েন।

জান্নাতুল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের ৪২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। পরে একই বিভাগের শিক্ষক হিসাবে যোগ দেন।

শিক্ষকের মৃত্যুর ঘটনায় শোক প্রকাশ করে হাতে ভোট গণনার সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেন ‘স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী সম্মিলন’ প্যানেলের ভিপি প্রার্থী আব্দুর রশিদ জিতু।

তিনি বলেন, “তথ্য প্রযুক্তির এ যুগে এসেও যদি আমরা ‘ম্যানুয়াল’ পদ্ধতিতে পড়ে থাকি, তাহলে সেটি আমাদের জন্য জটিল হয়ে যায়।

“যদি মেশিনের মাধ্যমে ভোট গণনা করা হত, তাহলে নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে কোনও প্রশ্ন থাকত না বলে আমরা মনে করি। মেশিনে ভোট গণনা হলে হয়ত ম্যামকেও হারাতে হত না।”

হাতে ব্যালট গণনার সমালোচনা করে সাংবাদিকদের সামনে এসে সহকর্মীর মৃত্যুতে ক্ষোভ জানান অধ্যাপক সুলতানা আক্তার।

জান্নাতুলের মৃত্যুর জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে দায়ী করেছেন জাকসু নির্বাচনে নবাব ফয়েজুন্নেসা হলের রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক সুলতানা আক্তার।

ভোট গণনা চলার মধ্যে তিনি শুক্রবার বিকালে সিনেট ভবনে সাংবাদিকদের বলেন, “নির্বাচন কমিশনের অব্যবস্থাপনার জন্যই আমার সহকর্মীর মৃত্যু হয়েছে বলে আমি মনে করি। আমি এ ঘটনার সঠিক বিচার চাই। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে তার ক্ষতিপূরণ দাবি করছি।”

সুলতানা আক্তার বলেন, “তিনি (জান্নাতুল ফেরদৌস) সারাদিন অমানুষিক পরিশ্রম করে চাপ নিয়ে ঘুমাতে গিয়েছিলেন। চাপের কারণে তিনি হয়ত ঘুমাতে পারেননি।

“সকালে অসুস্থতার জন্য তিনি আসতে পারেননি। গার্ড পাঠিয়ে তাকে ডেকে নিয়ে আসা হয়েছে। আসার পর তিনি তিন তলায় উঠতে গিয়ে পড়ে যান। কিছুক্ষণ পরেই তার মৃত্যু হয়; হাসপাতালে নেওয়ার আগেই।”

হাতে ভোট গণনার সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে সুলতানা আক্তার বলছেন, “যে পদ্ধতিতে ভোট গণনা হয়েছে, গণনা হচ্ছে, তাতে করে তিন দিনেও ফল দেওয়া সম্ভব হবে না। আমরা এ পদ্ধতির পরিবর্তন চাই।”

ডাকসুতে মোট ভোট ছিল ৩৯ হাজার। তার মধ্যে ৮০ শতাংশের মতো ভোট গ্রহণ হয়েছিল। সেই হিসাবে ভোট দিয়েছিল ৩১ হাজার শিক্ষার্থী। যন্ত্রে তা গণনার পর ১৬ ঘণ্টার মধ্যে ফল ঘোষণা করা হয়েছিল।

৩৩ বছর পর অনুষ্ঠিত এবারের জাকসু নির্বাচনে ভোটার ছিল ১১ হাজার ৮৪৩ জন। তার মধ্যে ৬৮ শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছে বলে নির্বাচন কমিশন ধারণা দিয়েছে। সেই হিসাবে গণনা করতে হচ্ছে ৮ হাজার ৫৩ ভোট।

বৃহস্পতিবার জাকসু নির্বাচনে ভোটগ্রহণের শুরুতেই অব্যবস্থাপনার নানা ত্রুটি বেরিয়ে আসতে থাকে। কয়েকটি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ দেরিতেও শুরু হয়। প্রার্থীদের নানা অভিযোগের মধ্যে ভোট গ্রহণ চলার পর একে একে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেয় ছাত্রদল, বাম সংগঠনগুলোসহ পাঁচটি প্যানেল।

ডাকসুতে জয়ী ইসলামী ছাত্রশিবির এবং তাদের পাশাপাশি গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ নির্বাচন বর্জনের এই মিছিলে যোগ দেয়নি। তবে গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদেরও নানা অভিযোগ রয়েছে।

গণনার সময় রাতভর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ফটকগুলোতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের, বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মীদের উপস্থিতি প্রশ্ন তৈরি করেছে শিক্ষার্থীদের মনে, যা নিয়ে তারা সোশাল মিডিয়ায় লিখছে।

ভোট গণনাস্থল সিনেট ভবন ঘিরে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা রয়েছে। পুরো ক্যাম্পাসজুড়েই রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। মূল ফটকগুলোতে বিজিবি সদস্যদেরও দেখা গেছে।

৭ প্যানেলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা

কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ অর্থাৎ জাকসুতে ২৫ পদের জন্য লড়াইয়ে রয়েছে ১৭৭ জন। তার মধ্যে ভিপি পদে ৯ জন এবং জিএস পদে ৮ জন প্রার্থী। হল সংসদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে ৪৪৫ জন।

বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন সাতটি প্যানেলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে; এর বাইরে স্বতন্ত্র প্রার্থীও রয়েছে অনেক।

ছাত্রদলের প্যানেলে ভিপি প্রার্থী করা হয়েছে মীর মশাররফ হোসেন হল ছাত্রদলের সভাপতি মো. শেখ সাদী হাসানকে। জিএস প্রার্থী হয়েছেন ১৩ নম্বর ছাত্রী হল ছাত্রদলের সভাপতি তানজিলা হোসাইন বৈশাখী। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (পুরুষ) পদে মো. সাজ্জাদুল ইসলাম এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (নারী) পদে আঞ্জুমান আরা ইকরা ছাত্রদলের প্যানেলে লড়বেন।

ডাকসুতে ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’ প্যানেলে জয়ী ইসলামী ছাত্রশিবির জাকসুতে লড়ছে ‘সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট’ প্যানেলে। তাদের ভিপি প্রার্থী আরিফ উল্লাহ, জিএস প্রার্থী মাজহারুল ইসলাম। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (পুরুষ) পদে লড়বেন ফেরদৌস আল হাসান এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (নারী) পদে লড়বেন আয়েশা সিদ্দিকা মেঘলা।

অভ্যুত্থানকারীদের গড়া দল এনসিপির ছাত্র সংগঠন গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ ‘শিক্ষার্থী ঐক্য ফোরাম’ প্যানেলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। এই প্যানেলে ভিপি প্রার্থী আরিফুজ্জামান উজ্জ্বল, জিএস প্রার্থী আবু তৌহিদ মো. সিয়াম। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (পুরুষ) পদে জিয়া উদ্দিন আয়ান এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (নারী) পদে মালিহা নামলাহ লড়ছেন।

ক্লান্তি নিয়ে জাকসু নির্বাচনের ফলের অপেক্ষা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনে।
ক্লান্তি নিয়ে জাকসু নির্বাচনের ফলের অপেক্ষা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনে।

ছাত্র ইউনিয়নের একাংশ, জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোটের একাংশসহ বেশ কয়েকটি সাংস্কৃতি সংগঠন মিলে ‘সম্প্রীতির ঐক্য’ প্যানেল ঘোষণা করে। এই প্যানেলে ভিপি প্রার্থী অমর্ত্য রায় থাকলেও তিনি লড়াই থেকে বাদ পড়ায় এখন জিএস প্রার্থী থাকছেন জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোটের সাবেক সভাপতি শরণ এহসান।

১১ জন নারী, ৭ জন আদিবাসী, ৬ জন সনাতন ধর্মাবলম্বী, ৩ জন বৌদ্ধ ও ২ জন খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীকে নিয়ে সাজানো এই প্যানেলে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (পুরুষ) পদে প্রার্থী নুর এ তামীম স্রোত এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (নারী) পদে প্রার্থী ফারিয়া জামান নিকি।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক আবদুর রশিদ জিতুর নেতৃত্বে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে ‘স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী সম্মিলন’। এই প্যানেলে ভিপি প্রার্থী জিতুর সঙ্গে জিএস প্রার্থী রয়েছেন শাকিল আলী। এই প্যানেলে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (পুরুষ) পদে প্রার্থী রয়েছেন তৌহিদুল ইসলাম নিবির ভূঁঞা।

ছাত্র ইউনিয়নের একাংশ, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট ও কয়েকটি সাংস্কৃতিক সংগঠন মিলে ‘সংশপ্তক পর্ষদ’ নামে একটি আংশিক প্যানেল দিয়েছে। এই প্যানেলে ভিপি প্রার্থী নেই, জিএস পদে লড়ছেন জাহিদুল ইসলাম ইমন। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (নারী) পদে প্রার্থী হয়েছেন সোহাগী সামিয়া জান্নাতুল ফেরদৌস।

জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোটের একাংশের মুখপাত্র মাহফুজ ইসলাম মেঘের নেতৃত্বে আট সদস্যের ‘স্বতন্ত্র অঙ্গীকার পরিষদ’ নামে আরেকটি আংশিক প্যানেল ভোটের লড়াইয়ে রয়েছে। মাহফুজ এই প্যানেলের ভিপি প্রার্থী, জিএস প্রার্থী তানবীর হোসেন। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (পুরুষ) পদে এই প্যানেলের প্রার্থী নাজমুল ইসলাম।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত