Beta
বুধবার, ২২ জানুয়ারি, ২০২৫
Beta
বুধবার, ২২ জানুয়ারি, ২০২৫

জেল হত্যা দিবস : বনানী কবরস্থান ঘিরে পুলিশ, প্রবেশে বাধা

বনানী কবরস্থানের সামনে সকালে পুলিশের অবস্থান।
বনানী কবরস্থানের সামনে সকালে পুলিশের অবস্থান।
[publishpress_authors_box]

জেল হত্যা দিবস রবিবার (৩ নভেম্বর)। প্রতিবছরের মতো এবারও দিবসটি পালনে দলীয়ভাবে কর্মসূচি দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। তবে দিবসটি পালনে বাধা দেওয়ার অংশ হিসেবে পুলিশ ও জামায়াত-শিবিরের লোকজন ঢাকার বনানী কবরস্থান ঘিরে রেখেছে বলে অভিযোগ করেছে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট রাষ্ট্রক্ষমতা হারানো দলটি।

রবিবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে আওয়ামী লীগের ফেরিফায়েড ফেইসবুক পেইজে এমন অভিযোগ করা হয়।

এর আগে শনিবার একই পেইজ থেকে দলীয়ভাবে জেল হত্যা দিবসের কর্মসূচি পালনের ঘোষণা আসে, যেখানে বলা হয়, জেল হত্যা দিবসের স্মরণে বনানী কবরস্থানে সৈয়দ নজরুল, তাজউদ্দীন ও মনসুর আলীর কবরে শ্রদ্ধা নিবেদন করবে আওয়ামী লীগ। পাশাপাশি রাজশাহীতে কামারুজ্জামানের কবরেও ফুল দেওয়া হবে।

এছাড়া জাতীয় চার নেতাসহ মুক্তিযুদ্ধ এবং দেশের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের আন্দোলনে শহীদ সবার স্মরণে দোয়া-মোনাজাত অনুষ্ঠিত হবে।

এরপর রবিবার সকালে আওয়ামী লীগের ফেরিফায়েড পেইজ থেকে তাদের কর্মসূচিতে বাধা দেওয়ার অংশ হিসেবে পুলিশ ও জামায়াত-শিবিরের লোকজনের বিরুদ্ধে বনানী কবরস্থান ঘিরে রাখার অভিযোগ আসে।

এর আগে গত ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী ঘিরে শোকের কর্মসূচি পালনের অংশ হিসেবে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে গিয়ে ছাত্র-জনতার বাধার মুখে পড়েছিলেন আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকেরা। সেদিন সকালে যারাই বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে যেতে চেয়েছেন, তাদের প্রত্যেককে বাধা দেওয়ার পাশাপাশি মোবাইল ফোন ও মানিব্যাগে তল্লাশি চালানো হয়; আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্টতা পেলে করা হয় নাজেহাল। সেদিন অন্তত ২০ জনকে আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্টতার কারণে মারধর ও আটকের খবর আসে।

রবিবার সকালে জেল হত্যা দিবস ঘিরে আওয়ামী লীগের ফেইসবুক পোস্টে বলা হয়, “আজ ০৩ নভেম্বর, জেল হত্যা দিবস পালনে আওয়ামী লীগকে বাধা দেওয়ার অংশ হিসেবে বনানী কবরস্থান এলাকা পুলিশ এবং জামায়াত-শিবিরের লোকজন ঘিরে রেখেছে। সময় সকাল ৫.৪০ মিনিট!”

বর্তমান সরকার ও তাদের মিত্রদের আওয়ামী লীগকে ‘ফ্যাসিস্ট’ হিসেবে আখ্যায়িত করার কথা উল্লেখ করে পোস্টে বলা হয়, “আওয়ামী লীগকে ফ্যাসিস্ট বলে অবৈধ সরকার আর তার সহযোগী জামায়াত – আসলে ফ্যাসিস্ট কারা? এর বিচার বাংলাদেশের জনগণ করবে। স্বাধীনতাবিরোধীদের আস্ফালন মেনে নেবে না বাংলাদেশ।”

সকাল সাড়ে ৮টার পরপরই সরেজমিনে বনানী কবরস্থানে গিয়ে আওয়ামী লীগের অভিযোগের সত্যতাও মিলেছে অনেকাংশে। কবরস্থান ঘিরে অবস্থান করতে দেখা গেছে পুলিশ সদস্যদের। তাদের কাছাকাছি কিছু মানুষকে জটলা পাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেও দেখা গেছে। তবে তারা কোনও রাজনৈতিক দল বা জামায়াত-শিবিরের লোকজন কি-না তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

সংবাদ সংগ্রহের জন্য এই প্রতিবেদক বনানী কবরস্থানে ঢুকতে সক্ষম হলেও নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে তাকে বেশিক্ষণ সেখানে থাকতে দেয়নি পুলিশ। এর আগে সকালে আরেকজন সাংবাদিক কবরস্থানে গেলে লোকজন তাকে ঘিরে ধরেছিল জানিয়ে সেখানে অবস্থানরত পুলিশ সদস্যরা ‘কোনোমতে’ তাকে রক্ষা করার কথা জানিয়েছেন।

পুলিশের বাধার মুখে পড়ার আগে বনানী কবরস্থানের দেখভালের দায়িত্বে থাকা আমির হোসেন সঙ্গে দুই-তিন মিনিটের জন্য কথা হয় এই প্রতিবেদকের।

বনানী কবরস্থানের বাইরে লোকজনের জটলা।

জেল হত্যা দিবস ঘিরে সকাল থেকে কেউ কোনও কর্মসূচি পালনে কবরস্থানে এসেছিল কিনা জানতে চাইলে কোনও উত্তর দেননি ৪২ বছর ধরে এই কবরস্থান দেখভাল করে আসা আমির হোসেন। পরে ‘প্রতিবছর তো অনেক লোক আসে’– এই প্রতিবেদকের এমন মন্তব্যে তিনি বলেন, “হুম।”

দিবসটিকে ঘিরে আওয়ামী লীগের কর্মসূচি রয়েছে জানানোর সঙ্গে সঙ্গে আমির হোসেন বলেন, “নিষেধ। নিষেধ। পুরো নিষেধ।”

এই পর্যায়ে ‘দেখা যাক কয়জনকে আসতে দেয়’– প্রতিবেদকের এমন মন্তব্যের জবাবে তিনি বলেন, “না। দিব না। দেহেন না পুলিশগুলো।”

তখন এই প্রতিবেদক তার নিজের কবরস্থানে ঢুকতে পারার কথা উল্লেখ করলে আমির হোসেন মুচকি হেসে বলেন, “হায়রে… আপনি আইছেন একলা মানুষ।”

ব্যানার নিয়ে এলে কি ঝামেলা করতে পারে– এমন প্রশ্নে আমির বলেন, “বাইন্ধা নিব গা।”

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর বন্দি করা হয়েছিল তার ঘনিষ্ঠ চার সহচর সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে।

বঙ্গবন্ধুর খুনিরাই ওই বছরের ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ঢুকে হত্যা করে এই জাতীয় চার নেতাকে। পঁচাত্তরের খুনিদের দায়মুক্তিও দিয়েছিল তৎকালীন সরকার।

১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হয়ে পাকিস্তানে থাকার মধ্যে তার ঘনিষ্ঠ সহচর এই চার নেতাই স্বাধীনতা যুদ্ধ এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। সৈয়দ নজরুল ছিলেন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দীন ছিলেন প্রধানমন্ত্রী, মনসুর আলী ছিলেন অর্থ, বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী, কামারুজ্জামান ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

যে চেতনায় মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল, পঁচাত্তরের পট পরিবর্তনে তার উল্টো যাত্রা শুরু হয়েছিল বলে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে জেল হত্যাকাণ্ডের দিনটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। আওয়ামী লীগের শাসনকালে জেল হত্যা দিবস জাতীয়ভাবে পালিত না হলেও দিনটিতে দলীয় কর্মসূচি থাকত।

পঁচাত্তরে কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে হত্যার ৪৯ বছর পর দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদের কবরের সামনে দাঁড়িয়ে আমির হোসেনের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথোপকথন চলার মধ্যেই পুলিশের পোশাক পরিহিত এসআই পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা এবং বেগুনি রংয়ের পাঞ্জাবি পরিহিত দুজন দূর থেকে ইশারায় এই প্রতিবেদক ও আমির হোসেনকে ডাকতে থাকেন।

ঘড়ির কাঁটা তখন সকাল ৮টা ৩৯ মিনিট। পুলিশের সেই এসআই এসে দুজনকেই প্রশ্ন ছুড়ে দেন, “ভাই আপনারা নিজেদের সমস্যা কেন তৈরি করেন। ওইখানে কেন গেছেন?”

সকাল সন্ধ্যার এই প্রতিবেদক এ সময় নিজের পরিচয় দেওয়ার পর পুলিশের ওই কর্মকর্তা বলেন, “যেটাই হোক!’’

তখন এই প্রতিবেদক পাল্টা প্রশ্ন করেন– “কেন আসা নিষেধ আছে?” জবাবে পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, “শোনেন হ্যাঁ। বাইরে ওই যে ছেলেপেলে আছে। অন্য পোলাপান আছে– টার্গেট করতেছে।”

এই প্রতিবেদক তখন সেখানে যাওয়ার কারণ হিসেবে পেশাগত দায়িত্ব পালনের কথা বললে পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, “সকালে একজন রিপোর্টার আসছিল… তারে সবাই ঘিরে ধরছে। কোনোমতে তারে রক্ষা করতে পারছি। আপনি এখানে থেকে বাইরে গেলে যদি আপনাকে মারে তখন কি করবেন? পুলিশ নিরাপত্তা দিতে পারবে?”

এই পরিস্থিতিতে এই প্রতিবেদক সেখান থেকে চলে আসতে বাধ্য হন।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত