Beta
রবিবার, ১৯ জানুয়ারি, ২০২৫
Beta
রবিবার, ১৯ জানুয়ারি, ২০২৫

নিষিদ্ধ জামায়াতের ফেরার পথ কি রয়ে গেল

২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চ থেকে বিচারের মাধ্যমে জামাাতে ইসলামীকে নিষিদ্ধের দাবি উঠেছিল। ফাইল ছবি
২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চ থেকে বিচারের মাধ্যমে জামাাতে ইসলামীকে নিষিদ্ধের দাবি উঠেছিল। ফাইল ছবি
[publishpress_authors_box]

একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের জন্য জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধের দাবি ছিল; কিন্তু ‘সন্ত্রাসী’ সংগঠন হিসাবে সরকারের নির্বাহী আদেশে সেই পদক্ষেপ নেওয়ায় দলটির ফেরার পথও থেকে যাচ্ছে বলে মনে করছেন আইনজ্ঞরা।

আবার আওয়ামী লীগ সরকারের জামায়াত নিষিদ্ধের এই পদক্ষেপের সময় নিয়ে প্রশ্ন ‍তুলেছেন এমন অনেকে, যারা যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতকে নিষিদ্ধের দাবিতে সোচ্চার।

কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সংঘাত-সহিংসতার জন্য জামায়াতকে দায়ী করে বৃহস্পতিবার দলটি এবং এর সহযোগী সব সংগঠনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। তবে দলটি কোনও ধরনের সন্ত্রাসী কাঝে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করছে।

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতার পাশাপাশি বাঙালি নিধনে পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে নামা জামায়াতকে নিষিদ্ধের দাবি বাংলাদেশে দীর্ঘদিনের।

গত শতকের নব্বইয়ের দশকে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে আন্দোলনের সময় দাবিটি জোরাল হয়ে উঠেছিল। পরে ২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনে তা আরও জোর পায়।

একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে জামায়াতকে ‘ক্রিমিনাল দল’ আখ্যায়িত করার পর দল হিসাবে তাদের বিচারের দাবিও উঠেছিল শাহবাগ আন্দোলন থেকে।

সেই বিচারের পথ তৈরি করতে আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়ার কথা আওয়ামী লীগ সরকার বললেও এক দশকেও তা হয়নি।

এর মধ্যে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সহিংসতার জন্য জামায়াত-শিবিরকে দায়ী করে গত সোমবার আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের বৈঠকে দলটিকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত আসে।

এরপর নিষিদ্ধের প্রক্রিয়া শুরু করে সরকার। নির্বাহী আদেশে দলটিকে নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তের পর দুদিনে আইন মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নথি চালাচালির পর প্রজ্ঞাপন আসে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে জামায়াকে নিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিভিন্ন রায় এবং নিবন্ধন বাতিল করে হাইকোর্টের রায়ের বিষয়গুলো উল্লেখ করা হয়।

এরপর বলা হয়, সাম্প্রতিক ‘সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে’ জামায়াত ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের জড়িত ছিল বলে সরকার বিশ্বাস করে এবং সেই কারণে জামায়াতসহ এর সব অঙ্গ সংগঠনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো।

আগুন আর হামলার চিহ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেতু ভবন। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
কোটা সংস্কারের আন্দোলনের মধ্যে আগুন আর হামলার চিহ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেতু ভবন। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

২০০৯ সালে প্রণীত সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ১৮ অনুচ্ছেদ ব্যবহার করে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করেছে সরকার। আবার এই অনুচ্ছেদেই আছে, সরকার চাইলে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিতে পারে।

এই বিষয়টিই তুললেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সাবেক প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ।

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “নির্বাহী আদেশে জামায়াত নিষিদ্ধ করা হলে আসলে কী হবে? অন্য সরকার আসলে আবার জামায়াত আসবে। এটাতে কিন্তু সমস্যাটা সমাধান হবে না।”

আইনজীবীরা বলছেন, নিষেধাজ্ঞার নির্বাহী আদেশ চ্যালেঞ্জ করে আদালতে যাওয়ার সুযোগও থেকে যাচ্ছে জামায়াতের।

জামায়াত নিষিদ্ধের দাবি জানিয়ে আসা বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশিদ ফিরোজ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “কোর্টে গেলেই তো এই সিদ্ধান্ত বাতিল হয়ে যাবে।”

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতিতে নেতৃত্ব দেওয়া আওয়ামী লীগ সমর্থক দুই আইনজীবী নেতা মোমতাজ উদ্দিন ফকির এবং আব্দুর নুর দুলাল সরকারের সিদ্ধান্তকে স্বাগতই জানাচ্ছেন।

বিএনপি সমর্থিত জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সভাপতি, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি জয়নুল আবেদীন অবশ্য জামায়াত নিষিদ্ধ করা নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি।

বারের সাবেক সভাপতি মোমতাজ ফকির সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “সরকার হয়ত অনেক বিবেচনা করেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সরকার দেশ চালায়, সরকার বুঝে শুনেই এটা করেছে। এই যে দেশে ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছে, সবকিছুর প্রয়োজনের তাগিদেই সরকার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।”

নিষিদ্ধের ক্ষেত্রে আইনি কোনও ফাঁক না দেখার কথা জানিয়ে সাবেক সম্পাদক আব্দুন নুর দুলাল সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “সরকার যা করেছে, আইনসম্মতভাবেই করেছে। দীর্ঘ দিন ধরে জামায়াত যে কার্যক্রম করে আসছে, এই সময়ে তাদের যে রূপ জাতির কাছে প্রকাশিত হয়েছে, সেই হিসেবে এটা সঠিক হয়েছে।”

তবে নিষিদ্ধের এই সিদ্ধান্ত আরও আগেই আসা দরকার ছিল বলে মনে করেন তিনি।

দেরির পাশাপাশি এখনই বা কেন হলো- সেই প্রশ্ন রেখেছেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না।

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “তার মানে কি এতদিন করে নাই আওয়ামী লীগ তার সঙ্গে সমঝোতার কারণে, এখন সমঝোতা ভাঙল?

“প্রশ্ন হচ্ছে আপিল বিভাগ যেখানে (নিবন্ধন) বাতিল করেছে, তারপর এতদিন সময় লাগল কেন? আর একটি দলের নিবন্ধন বাতিল করলে দলের আর কিছু থাকে কি?”

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) চেয়ারম্যান জেড আই খান পান্না আওয়ামী লীগের উদ্দেশ্য নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেন।

তিনি বলেন, “একদিকে জামায়াত নিষিদ্ধ করলেও আরেক দিকে আওয়ামী লীগ ধর্মভিত্তিক দল খেলাফতের সঙ্গে আঁতাত করে চলছে। অনেক ধর্মভিত্তিক দল মুক্তিযুদ্ধবিরোধী হলেও তাদেরকে সরকার বাতিল করে নাই।”

কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে সরকারের এই পদক্ষেপ নিয়েও তিনি বলেন, “এই মুহূর্তে জামায়াত নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া মানে আগুনে ঘি ঢালার মতো অবস্থা হবে না?”

আওয়ামী লীগের জোটসঙ্গী দল ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননও পদক্ষেপটি সময়োচিত বলে মনে করছেন না।

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “উল্টো পরিবেশে করা হলো, যার ফলে কিছু লোকজনের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হবে। অনেকেই বলা শুরু করেছে- এটা এই সময়ে কেন? (অথচ) যারা বলছে, তারাও এটা চায়।”

জামায়াত নিষিদ্ধের দাবি তুলে আসা গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকারও মনে করছেন, এই সিদ্ধান্ত আরও আগেই নেওয়া দরকার ছিল।

জামায়াতের একটি বিক্ষোভ মিছিল।
জামায়াতের একটি বিক্ষোভ মিছিল। ফাইল ছবি

নিষিদ্ধ দল হিসাবে এখন জামায়াত নিজ নামে কোনও কার্যক্রম চালাতে পারবে না। তবে দলটির নেতা-কর্মীরা নিষ্ক্রিয় থাকলে তাদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা সরকার নিতে পারবে না।

জামায়াতের নেতা-কর্মীদের কী হবে- এই প্রশ্নে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেছেন, “গণহারে তাদের বিচার করা হবে না। ১৯৭১ সালের পরে যারা জন্ম নিয়েছে, তাদের বিচার করা হবে না। বাংলাদেশে আইন আছে, তারা যদি কোনও অপরাধ করে, সেক্ষেত্রে আইন অনুযায়ী বিচার হবে।”

ফলে জামায়াতকে ‘সন্ত্রাসী দল’ হিসাবে নিষিদ্ধ করায় তাদের একাত্তরের অপরাধকর্ম লঘু হয়ে গেল বলে মনে করেন অনেকে।

জামায়াত নিষিদ্ধের দাবি জানিয়ে আসা বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি শাহ আলম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “কিন্তু নানান রাজনৈতিক সমীকরণে এতদিন তা করেনি সরকার। এখন যে নিষিদ্ধ করল, তাতেও নানান রকমের সমীকরণ রয়েছে। জামায়াতকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে নয়, যুদ্ধাপরাধী সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ করতে হবে।”

যুদ্ধাপরাধী হিসাবে জামায়াতের বিচারের প্রক্রিয়া ঝুলে আছে এক দশক ধরে। দল হিসাবে জামায়াতের বিচার করতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালস আইন সংশোধন করতে হবে।

জামায়াত নিষিদ্ধের দাবি ছিল শাহবাগ আন্দোলন থেকে।

দল হিসাবে জামায়াতের বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা ২০১৪ সালে তদন্ত শেষে প্রতিবেদন প্রসিকিউশন বিভাগে জমা দিয়েছিল। এরপর তৎকালীন প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজকে প্রধান করে সাত সদস্যদের একটি প্রসিকিউশন দলও গঠন করা হয়েছিল।

ট্রাইব্যুনালের সাবেক প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ বলেন, “আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিলের জন্য আমাদের যাবতীয় প্রস্তুতিও নিয়েছিলাম। কিন্তু আইন সংশোধনের কথা বলে ২০১৪ সালের ২৬ জুন এক ঘোষণা দেওয়া হয়। তারপর আর আলোর মুখ দেখেনি মামলাটি।”

নির্বাহী আদেশে নিষিদ্ধের পরিবর্তে যুদ্ধাপরাধী দল হিসাবে জামায়াতের বিচারের পক্ষপাতি ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির আইন সম্পাদক তুরিন।

তিনি বলেন, “আমরা যদি মনে করি, জামায়াতের আদর্শটাই ঠিক না, দেশবিরোধী; তাহলে কিন্তু ট্রাইব্যুনালে মামলা নিয়ে বিচারের মাধ্যমে সম্পন্ন করতে হবে।”

নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালের উদাহরণ দিয়ে এই আইনজীবী বলেন, “সেখানে দলের শীর্ষ নেতাদের বিচার হয়ে ফাঁসি হয়েছে। আবার কতগুলো সংগঠনেরও বিচার হয়েছে।

“একই সাথে তারা যেটি করেছে, সেটা হলো দীর্ঘ সময় ধরে সমূলে উৎপাটনের ব্যবস্থা করেছিল সেখানকার সরকার। আমরা কিন্তু তার কিছুই করি নাই।”

সরকারের বর্তমান পদক্ষেপ যুদ্ধাপরাধী দল হিসাবে জামায়াতের বিচারের পথ আটকে দেবে কি না- সাংবাদিকরা এই প্রশ্নও রেখেছিল আইনজীবী আনিসুল হকের কাছে।

উত্তরে তিনি বলেন, “নিষিদ্ধ করলেও আদালতে শাস্তি দেওয়া যাবে না, এমনটি নয়। তবে যেহেতু ব্যান হয়ে গেছে, তাই হয়ত আর ব্যান করার ব্যাপারটা আর সাজার মধ্যে আসবে না।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত