Beta
বৃহস্পতিবার, ১৫ মে, ২০২৫
Beta
বৃহস্পতিবার, ১৫ মে, ২০২৫

জামায়াত : বিশ্বাসে নিষিদ্ধ, আবার বিশ্বাসেই সিদ্ধ

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জামায়াতে ইসলামীর সক্রিয়তা এখন দৃশ্যমান।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জামায়াতে ইসলামীর সক্রিয়তা এখন দৃশ্যমান।
[publishpress_authors_box]

পতনের মাত্র ৫ দিন আগে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার; সেই নিষেধাজ্ঞা টিকল মাত্র ২৭ দিন। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে ক্ষমতায় আসা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে নিল।

গত ১ আগস্ট নির্বাহী আদেশে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করেছিল শেখ হাসিনার সরকার। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে দাবি জানিয়ে আসা ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে তখনই বলা হচ্ছিল, এই প্রক্রিয়ায় নিষেধাজ্ঞা নাও টিকতে পারে।

কারণ যে আইনে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, সেই সন্ত্রাসবিরোধী আইনের একই ধারায় বলা আছে, সরকার চাইলে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য যেমন কোনও দলকে নির্বাহী আদেশে নিষিদ্ধ করতে পারে, তেমনি চাইলে সেই নিষেধাজ্ঞা তুলেও নিতে পারে।

জামায়াতকে নিষিদ্ধের ক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছিল, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জামায়াত জড়িত রয়েছে বলে সরকার বিশ্বাস করে।

তাতে বলা হয়, “যেহেতু, সরকারের নিকট যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ রহিয়াছে যে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং উহার অঙ্গ সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির সাম্প্রতিককালে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ, ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সরাসরি এবং উসকানির মাধ্যমে জড়িত ছিল এবং যেহেতু, সরকার বিশ্বাস করে যে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ উহার সকল অঙ্গ সংগঠন সন্ত্রাসী কার্যকলাপের সহিত জড়িত রহিয়াছে।

“সেহেতু সরকার সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯ এর ধারা ১৮(১) এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ উহার সকল অঙ্গ সংগঠনকে রাজনৈতিক দল ও সংগঠন হিসাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করিল এবং উক্ত আইনের তফসিল-২ এ বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ উহার সকল অঙ্গ সংগঠনকে নিষিদ্ধ সত্তা হিসাবে তালিকাভুক্ত করিল। ইহা অবিলম্বে কার্যকর হইবে।”

রাষ্ট্রপতির (মো. সাহাবুদ্দিন) আদেশক্রমে ১ আগস্টের সেই প্রজ্ঞাপনে স্বাক্ষর করেছিলেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্র সচিব জাহাংগীর আলম।

২৭ আগস্ট, বুধবার সেই প্রজ্ঞাপন বাতিলের প্রজ্ঞাপনটি এসেছে সেই রাষ্ট্রপতির (মো. সাহাবুদ্দিন) আদেশক্রমেই; তবে স্বাক্ষর বদলেছে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে পর প্রশাসনে পরিবর্তনে জননিরাপত্তা বিভাগের নতুন সচিব মোহাম্মদ আবদুল মোমেনের স্বাক্ষরে এসেছে এই প্রজ্ঞাপন।

প্রজ্ঞাপনের ভাষায় খুব একটার বদল আসেনি; শুধু বিশ্বাসের জায়গায় এসেছে পরিবর্তন।

এবারের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, “যেহেতু বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং উহার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ উহার সকল অঙ্গ সংগঠনের সন্ত্রাস ও সহিংসতায় সম্পৃক্ততার সুনির্দিষ্ট কোনও তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায় নাই এবং

“যেহেতু সরকার বিশ্বাস করে যে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং উহার ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ উহার সকল অঙ্গ সংগঠন সন্ত্রাসী কার্যকলাপের সাথে জড়িত নহে; সেহেতু সরকার, সন্ত্রাস বিরোধী আইন, ২০০৯ এর ধারা ১৮ এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং উহার ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ উহার সকল অঙ্গ সংগঠনকে রাজনৈতিক দল ও সংগঠন হিসাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা সংক্রান্ত এ বিভাগের বিগত ১৭ শ্রাবণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ মোতাবেক ০১ আগস্ট ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ তারিখের প্রজ্ঞাপন এস, আর, ও. নং. ২৮১-আইন/২০২৪ এতদ্দ্বারা বাতিল করিল এবং উক্ত আইনের তফসিল-২ হইতে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং উহার ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ উহার সকল অঙ্গ সংগঠন এর তালিকাভুক্তি বাতিল করিল।”

রাজনৈতিক দল হিসাবে জামায়াত বারবারই আলোচনায় আসে একাত্তরে ভূমিকার জন্য। তখন বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিল যে গুটিকয়েক দল, তারই একটি জামায়াত।

স্বাধীনতার পর ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনৈতিক তৎপরতা বন্ধ থাকায় জামায়াতও ছিল নিষ্ক্রিয়। ১৯৭৫ সালে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর জামায়াতের সক্রিয় হওয়ার পথ খোলে।

এরপর ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে ১০টি আসন নিয়ে সংসদে যায় দলটি। ১৯৯২ সালে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচার দাবির আন্দোলন থেকে জামায়াত নিষিদ্ধের দাবি উঠেছিল।

কিন্তু তা জামায়াতের কাজে কোনও প্রভাব ফেলেনি। প্রায় প্রতিটি সংসদেই দলটির প্রতিনিধিত্ব ছিল। ২০০১ সালে খালেদা জিয়ার সরকারে মন্ত্রীও হন দলটির শীর্ষ দুই নেতা মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মো. মুজাহিদ।

তবে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রক্রিয়া শুরু হলে জামায়াত চাপে পড়ে। সেই চাপ আরও বাড়ে ২০১৩ সালে, যখন শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন েথকে জামায়াত নিষিদ্ধের দাবি জোরাল হয়ে ওঠে।

এর মধ্যে গ্রেপ্তার হন জামায়াতের শীর্ষনেতারা। বিচারে মৃত্যুদণ্ড হয় দলটির আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মো. মুজাহিদসহ শীর্ষনেতাদের। গোলাম আযম ও দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী আমৃত্যু কারাভোগের মধ্যে মারা যান।

ব্যক্তির অপরাধের বিচারের পর শাহবাগ আন্দোলন থেকে যুদ্ধাপরাধী দল হিসাবে জামায়াতের বিচারের দাবি উঠেছিল। সেজন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধনের প্রয়োজন পড়ে। তবে আওয়ামী লীগ প্রতিশ্রুতি দিলেও সেই আইন সংশোধন করেনি।

এরমধ্যে আদালতের আদেশে জামায়াতের ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করে নির্বাচন কমিশন। ফলে ২০১৪ সাল থেকে কোনও নির্বাচনে দলীয়ভাবে অংশ নিতে পারছিল না জামায়াত।  

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে যখন আওয়ামী লীপ চাপে, তখন এমাসের শুরুতে আকস্মিকভাবেই নির্বাহী আদেশে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হয়।

সেই সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়ায় জামায়াত তখন বলেছিল, “সরকার নিজেদের অপকর্ম ঢাকার জন্য বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নির্বাহী আদেশ বলে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে চলমান আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে চাচ্ছে।”

শাহবাগ আন্দোলন থেকে জামায়াতে ইসলামীকে আইন করে নিষিদ্ধ করার দাবি জোরেশোরে উঠেছিল।

জামায়াত নিষিদ্ধের দাবি যারা করে আসছিল, তাদের মধ্য থেকে সময় ও প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল।

আওয়ামী লীগের জোট শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন তখন বলেছিলেন, “উল্টো পরিবেশে করা হলো, যার ফলে কিছু লোকজনের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হবে।”

বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশিদ ফিরোজ বলেছিলেন, ‘লোক দেখানো’ এই নিষেধাজ্ঞা আদালতে টিকবে না।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি শাহ আলম বলেছিলেন, সন্ত্রাসী সংগঠন হিসাবে নয়, জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে হবে যুদ্ধাপরাধী সংগঠন হিসাবে।

আইনজ্ঞরাও বলেছিলেন, নির্বাহী আদেশে জামায়াত নিষিদ্ধের ফলে একাত্তরে তাদের অপরাধ উপেক্ষিত রয়ে গেল।

নিষিদ্ধ করার পর আওয়ামী লীগ জঙ্গি দল হিসাবে জামায়াতকে মোকাবেলার ঘোষণা দিয়েছিল। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মধ্যে সেই ঘোষণা আওয়ামী লীগের উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহের উদ্রেক করেছিল অনেকের মধ্যে।

শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমনে আওয়ামী লীগের কঠোর নীতিতে কয়েকশ মানুষ নিহত হলে তা গণবিক্ষোভে পরিণত হয়। সেই চাপে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন।

সেদিনই সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ জামান সেনানিবাসে যে কয়েকটি রাজনৈতিক দলকে আলোচনায় ডেকেছিলেন, তার মধ্যে জামায়াতও ছিল।

এরপর বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন যে কয়েকটি দলকে আলোচনায় ডাকেন, তার মধ্যেও জামায়াত ছিল। পরে গত ৮ আগস্ট বঙ্গভবনে ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টাদের শপথ অনুষ্ঠানে জামায়াত নেতারাও ছিল আমন্ত্রিত।

বন্যাদুর্গত এলাকায় ত্রাণ কাজে জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান।

২০১৩ সাল থেকে ঢাকার মগবাজারে জামায়াতের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দলটির নেতারা যেতে পারছিল না, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তারা কার্যালয় খুলে সেখানেও বসে।

নানা কর্মসূচিতেও সক্রিয় রয়েছে জামায়াত। এখন কুমিল্লা, নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষ্মীপুরে বন্যার ত্রাণ কার্যক্রমেও দলটির নেতা-কর্মীদের দেখা যাচ্ছে।

জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান কয়েকদিন আগেই এক অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনাকে ইঙ্গিত করে বলেন, “আমাদের ইতিহাসজ্ঞানে তো কখনও দেখি নাই, কোনও শাসক ও দোসরদের দেশ ছেড়ে পালিয়ে বেড়াতে হয়। আপনারা পালাবেন কেন? আমাদের নেতৃবৃন্দকে আপনারা হত্যা করেছেন, আমাদের কোনও নেতা দেশ ছেড়ে পালাননি।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত