জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন ফেরানোর পথ করে দিয়েছে সর্বোচ্চ আদালত। তবে তাদের প্রতীক দাঁড়ি পাল্লা থাকবে কি না, সেই প্রশ্নের মীমাংসার এখনও বাকি।
জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে দেওয়া হাই কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে দলটির আপিল গ্রহণ করে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ এক যুগ পর রবিবার রায় দেয়।
তাতে হাই কোর্টের রায় বাতিল করে দেওয়া হয়। ওই রায় মেনেই যেহেতু জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করেছিল ইসি, ফলে এখন দলটির নিবন্ধন ফিরিয়ে দিতে হবে।
আপিল বিভাগের এই রায়ের ফলে তিনটি সংসদ নির্বাচনের পর এবার জামায়াত দলীয় ব্যানারে ভোট করার সুযোগ পেল। তবে দলীয় প্রতীক হিসেবে দাঁড়ি পাল্লা জামায়াত পাবে কি না, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার ইসির ওপরই দিয়েছে আদালত।
রায়ের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় জামায়াত আমির শফিকুর রহমান ফেইসবুকে লিখেছেন, “বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধনসংক্রান্ত হাই কোর্টের দেওয়া ন্যায়ভ্রষ্ট রায় আজ প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে চার সদস্যের বেঞ্চ বাতিল ঘোষণা করেছে। মহান রবের দরবারে নতশিরে শুকরিয়া আদায় করি।
“পরবর্তী প্রক্রিয়া নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। মহান রবের সাহায্য চাই—আমরা যেন দ্রুতই আমাদের পূর্ণ অধিকার ফিরে পাই। আমিন।”
আওয়ামী লীগ আমলে জামায়াত নিবন্ধন হারানোর পাশাপাশি নিষিদ্ধও হয়েছিল। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছর আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সরকারি সেই নিষেধাজ্ঞা উঠে যায়, এখন আদালতের রায়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পথও খুলল।
জামায়াত সর্বশেষ ২০০৮ সালের নির্বাচনে দলীয় প্রতীকে অংশ নিতে পেরেছিল। ২০১৩ সালে নিবন্ধন হারানোর পর ২০১৮ সালের নির্বাচনে তাদের নেতাদের অংশ নিতে হয়েছিল বিএনপির প্রতীক ধানের শীষে।
২০০৯ সালে ক্ষমতায় যাওয়ার পর যুদ্ধাপরাধের বিচারে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের বিচার শুরুর পাশাপাশি বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী দলটির গঠনতন্ত্র নিয়েও আদালতে প্রশ্ন তোলা হয়।
একটি রিট আবেদনে তখন হাই কোর্ট জামায়াতের গঠনতন্ত্র বাংলাদেশের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে রায় দেয় এবং তাদের নিবন্ধন বাতিল করতে ইসিকে নির্দেশ দেয়।
জামায়াতকে নিবন্ধন দেওয়ার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০০৯ সালে রিট আবেদনটি করেছিলেন সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরীসহ ২৫ ব্যক্তি।
সেই আবেদনের চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে ২০১৩ সালের ১ আগস্ট রায় দেয় হাই কোর্টের তিন সদস্যের বৃহত্তর বেঞ্চ।
হাই কোর্টের রায়ের পরপরই তা স্থগিত চেয়ে জামায়াত আবেদন করে। তা ২০১৩ সালের ৫ আগস্ট খারিজ করে দেন আপিল বিভাগের তৎকালীন চেম্বার বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী, যিনি অভ্যুত্থানের পর গ্রেপ্তার হয়ে এখন কারাগারে।
আদালতের নির্দেশের পাঁচ বছর পর জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে ২০১৮ সালের ৭ ডিসেম্বর প্রজ্ঞাপন জারি করে ইসি।
২০০৮ সালে নিবন্ধন পদ্ধতি চালু হওয়ার পর জামায়াতও নিবন্ধন পেয়েছিল। ১৯৮৬ সাল থেকে প্রতিটি সংসদে (১৯৯৬ সালের ষষ্ঠ সংসদ বাদে) তাদের প্রতিনিধিত্বও ছিল।
হাই কোর্টের ওই রায়ের পর দল হিসাবে জামায়াত টিকে থাকতে পারলেও দলীয় ব্যানারে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার যোগ্যতা হারায়। কেননা দলীয় প্রতীকে অংশ নিতে পারে কেবল নিবন্ধিত দলগুলো।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতা হারানোর কয়েকদিন আগে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসাবে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করলে জামায়াত দল হিসাবে সক্রিয় থাকার বৈধতাও হারায়।
কিন্তু অভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকার এসে জামায়াতের নিষেধাজ্ঞা বাতিল করে দেয়। এরপর জামায়াত নিবন্ধন ফিরে পেতে তাদের দীর্ঘদিন আগে করা আবেদনের শুনানির উদ্যোগ নেয়।
হাই কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে জামায়াতের করা আপিল ২০২৩ সালের ১৯ নভেম্বর খারিজ করে দিয়েছিল আপিল বিভাগ। আপিলকারীর পক্ষে সেদিন কোনও আইনজীবী ছিল না।
পরে আপিল পুনরুজ্জীবিত করতে আদালতে আবেদন করে জামায়াত। শুনানি নিয়ে গত বছরের ২২ অক্টোবর আপিল বিভাগ তা মঞ্জুর করে।
এরপর জামায়াতের আপিল শুনানির জন্য আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় ওঠে। গত ৩ ডিসেম্বর শুনানি শুরু হয়। এরপর আরও কয়েক দফা আপিল শুনানির পর গত ১৪ মে সর্বোচ্চ আদালত এ বিষয়ে রায়ের জন্য ১ জুন দিন ধার্য করে।
রবিবার দেওয়া এই রায়ে ফলে বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক বৈরিতার দিকে গড়ানোর মধ্যে এখন ভোটের বিষয়ে তাদের দ্বারস্ত হতে হবে না জামায়াতকে।
আর ক্ষমতা হারানোর পর নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ইসির নিবন্ধনও হারিয়েছে। ফলে তাদের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ এখন নেই।
দাঁড়ি পাল্লার জটিলতা
নির্বাচন কমিশন কোনও দলকে নিবন্ধন দেওয়ার সময় তাদের একটি প্রতীকও দেয়, যা নির্বাচনী ব্যালটে থাকে। যে কোনও দলের সমর্থকরা ওই দলের প্রতীকেই ভোট দেয়।
জামায়াত আগে থেকে দাঁড়ি পাল্লা প্রতীকে নির্বাচন করে আসছিল। ২০০৮ সালে নিবন্ধনের সময়ও তাদের সেই প্রতীকটি দেওয়া হয়েছিল।
কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট ২০১৬ সালে একটি রেজল্যুশন পাস করেছিল। সেখানে আদালতের প্রতীক দাঁড়ি পাল্লা নির্বাচনে ব্যবহারের জন্য কাউকে বরাদ্দ না দিতে ইসিকে বলা হয়েছিল।
ইসিকে পাঠানো সুপ্রিম কোর্টের চিঠিতে বলা হয়েছিল, “সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের বিচারপতিদের উপস্থিতিতে ১২ ডিসেম্বর (২০১৬ সালের) ফুল কোর্ট সভায় সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে, ‘দাঁড়িপাল্লা’ ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসেবে একমাত্র সুপ্রিম কোর্টের মনোগ্রামে ব্যবহৃত হবে। অন্য কোনও ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা রাজনৈতিক সংগঠনের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার না করার বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে অনুরোধ জানানো হোক।”
“সুপ্রিম কোর্টের ফুল কোর্ট সভার ওই সিদ্ধান্ত অনুসারে কোনও রাজনৈতিক দলের প্রতীক হিসাবে বা কোনও নির্বাচনে প্রার্থীর প্রতীক হিসেবে ‘দাঁড়ি পাল্লা’ বরাদ্দ প্রদান না করা এবং যদি বরাদ্দ করা হয়ে থাকে তাহলে ওই বরাদ্দ বাতিল করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো,” বলা হয়েছিল সেই চিঠিতে।
যেহেতু তার আগেই জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হয়ে গিয়েছিল এবং আর কোনও দল প্রতীকটি চায়নি, ফলে এনিয়ে ইসিকেও মাথা ঘামাতে হয়নি।
জামায়াত এই বিষয়টির সুরাহা আদালতে চাইলও আপিল বিভাগ বলটি ইসির দিকে ঠেলে দিয়ে বলেছে, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে এখন নির্বাচন কমিশন এ বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে।
রায়ের পর জামায়াতের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির সাংবাদিকদের বলেন, আদালত নির্দেশ দিয়েছে নিবন্ধন এবং অন্য যে ইস্যু নির্বাচন কমিশনের সামনে আসবে, সেগুলো যাতে দ্রুত নিষ্পত্তি করে। এখানে অন্য ইস্যু বলতে প্রতীক বোঝানো হয়েছে।
তিনি বলেন, “আমরা সংক্ষিপ্ত আদেশ চেয়েছি। সংক্ষিপ্ত আদেশ নির্বাচন কমিশনের কাছে নিয়ে যাব। কমিশন অতিদ্রুত নিবন্ধন ও দাঁড়ি পাল্লা প্রতীক বুঝিয়ে দেবে বলে প্রত্যাশা করি।”
তবে ইসির আইনজীবী তৌহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, “২০০৮ সালে রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতকে নিবন্ধন দিয়েছিল ইসি। এই নিবন্ধন দেওয়া অবৈধ ঘোষণা করে হাই কোর্টের দেওয়া রায় বাতিল করেছেন আপিল বিভাগ। ফলে দলটিকে ইসির দেওয়া নিবন্ধন বহাল রইল। তবে প্রতীক বরাদ্দের বিষয়ে আদালত কোনও পর্যবেক্ষণ দেননি।”