কোন প্রক্রিয়ায় জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করা হবে সে সিদ্ধান্ত আগামীকাল বুধবার হবে বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। মঙ্গলবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি একথা জানান।
আইনমন্ত্রী বলেন, “প্রধানমন্ত্রী আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন এটা ঠিক যে, আগামীকালের মধ্যে একটা ব্যবস্থা নেওয়ার। আমি আশা করি, কিছুক্ষণ পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বসব এবং সেইখানে আমরা সিদ্ধান্ত নিব। কোন আইনি প্রক্রিয়ায় হবে, সেটা যখন আমরা সিদ্ধান্ত নিব তখন বলব।”
কালকের মধ্যেই কি সিদ্ধান্তটি হবে- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে আনিসুল হক বলেন, “ইনশাআল্লাহ।”
অখণ্ড ভারতে জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠা হলেও যে পাকিস্তানকে ভিত্তি করে এই দলটি সংগঠিত হয়েছিল, সেই দেশেও একাধিকবার নিষিদ্ধ হয়েছিল ইসলামী দলটি। বাংলাদেশেও স্বাধীনতার পর নিষিদ্ধ হয়েছিল জামায়াত। তবে পঁচাত্তরের পট পরিবর্তনের পর দলটি আবার সক্রিয় হয়। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী দল হিসাবে জামায়াতের বিচারের দাবি উঠলেও সেই বিচারের প্রক্রিয়া এখনও ঝুলে আছে।
এর মধ্যেই সরকারি চাকরিতে নিয়োগে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে ঘরে ব্যাপক সংঘাত-সহিংসতার পর নতুন করে দলটি নিষিদ্ধের বিষয়টি উঠেছে আলোচনায়।
এই আন্দোলনের মধ্যে সরকারি স্থাপনা লক্ষ্য করে হামলা-আগুন দেওয়ার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে জামায়াত ও বিএনপিকে দায়ী করার পর সোমবার ১৪ দলের এক বৈঠকে জামায়াত নিষিদ্ধের বিষয়ে জোটের মতৈক্য হওয়ার কথা জানানো হয়েছে।
আন্দোলন চলাকালে জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করে সরকার কোনও ঝামেলায় পড়বে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, “দেখেন এই যে নৃশংসতা যেটা চালানো হয়েছে গত ১৬ জুলাই থেকে ২০ জুলাই এবং কোটা আন্দোলনের নামে, কোটাবিরোধী আন্দোলনের নামে যেটা, যে সহিংসতা চালানো হয়েছে।
“তার প্রথম কথা হচ্ছে, যারা কোটাবিরোধী আন্দোলন করছিলেন তারা কিন্তু বলেছিলেন, এই সহিংসতার সাথে তাদের কোনও সম্পৃক্ততা নাই। সেই ক্ষেত্রে আমাদের কাছে তথ্য-উপাত্ত আছে যে, এই জামায়াত, বিএনপি, ইসলামী ছাত্রশিবির এবং ছাত্রদলের যারা জঙ্গি তারাই এটা করেছে।”
তিনি বলেন, “আমার মনে হয় যে, এই দলটাকে যদি নিষিদ্ধ করা হয় তাহলে আইনশৃঙ্খলা এবং দেশের রাজনীতিরও অনেক উন্নতি হবে।”
কালকের মধ্যে সিদ্ধান্ত হলে সেটা নির্বাহী আদেশে হবে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, “কোনও দলকে যখন নিষিদ্ধ করা হয় তখন নির্বাহী আদেশেই হয়। সেটা কোনও বিচার বিভাগীয় আদেশে হয় না।”
তিনি বলেন, “যুদ্ধাপরাধের দায়ে বিচার করা এক কথা, জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা আরেক কথা। যুদ্ধাপরাধের দায়ে এই আইনের যে পরিবর্তনের কথা এবং সংশোধনের কথা আমরা লিখেছি, সেই সংশোধন যদি হতো এবং সেটা হলে, সেটা হবে। সেটা হলে যেটা হবে যে, জামায়াতকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিচার করা হবে।”
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচারের উদ্যোগ নিলে একে একে ধরা পড়েন জামায়াতের শীর্ষনেতারা। বিচারে মৃত্যুদণ্ড হয় দলটির আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মো. মুজাহিদসহ কয়েকজন শীর্ষনেতার। গোলাম আযম ও দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী আমৃত্যু কারাভোগের মধ্যে মারা যান।
যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে ২০১৩ সালে গড়ে ওঠা শাহবাগ আন্দোলন থেকে জামায়াত এবং দলটির ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির নিষিদ্ধের দাবি আবার জোরেশোরে ওঠে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আশ্বাস দেওয়া হলেও সেই দাবি পূরণের দিকে এগিয়ে যাওয়ার কোনও লক্ষণ এতদিন দেখা যায়নি।
যুদ্ধাপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এক রায়ে জামায়াতকে ‘ক্রিমিনাল দল’ বলা হলেও দল হিসেবে বিচারের এখতিয়ার এই আদালতের নেই। সেজন্য আইন সংশোধন করে শুধু ব্যক্তি নয়, দলের যুদ্ধাপরাধের বিচারের পথ করার দাবিও উঠেছিল শাহবাগ আন্দোলন থেকে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে- আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বিভিন্ন সময়ে একথা বললেও তা ঝুলে আছে প্রায় দশক ধরে। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এর আগে বিভিন্ন সময়ে বলেছিলেন, জামায়াত নিষিদ্ধের বিষয়ে আদালতই সিদ্ধান্ত নেবে। সরকার স্বপ্রণোদিত হয়ে নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে এ বিষয়ে কিছু করবে না।
২০২৩ সালের জুন মাসে আইনমন্ত্রী বলেছিলেন, জামায়াতকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিচার করার জন্য যে আইন সংশোধন করার, সেই প্রক্রিয় চলমান। এই আইন সংশোধনের প্রক্রিয়া কেবিনেটে কিছু দিনের মধ্যেই যাবে।
মঙ্গলবার এ সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, “এটা আপনারা দেখবেন পরে।”
তাহলে কি নির্বাহী আদেশেই জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধ হচ্ছে- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “অবশ্যই।”
জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠা ১৯৪১ সালের ২৬ আগস্ট। মওদুদীর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা দলটির নাম তখন ছিল জামায়াতে ইসলামী হিন্দ। একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় জামায়াত। শুধু তাই নয়, বাঙালি হত্যাযজ্ঞে পাকিস্তানিদের সহায়তার ভূমিকাও নিয়েছিল দলটি। বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে জামায়াতের প্রত্যক্ষ ভূমিকার বিষয়টিও আলোচিত।
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সরকার ধর্মীয় সব দল নিষিদ্ধ করলে জামায়াতও সেই কাতারে পড়ে নিষিদ্ধ হয়। তবে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের যে উল্টোযাত্রা শুরু হয়, তাতে পুনর্বাসিত হয় জামায়াত।
জিয়াউর রহমানের আমলে জামায়াত সক্রিয় ওঠার পর এইচ এম এরশাদের আমলে দলটি সংসদেও আসন নেয়। এরপর ২০০১ সালে খালেদা জিয়ার সরকারে মন্ত্রীও করা হয় দলটির দুই নেতাকে, তাদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা তুলে দেওয়াকে একাত্তরের লাখো শহীদের প্রতি ‘চপেটাঘাত’ বলে পরে মন্তব্য এসেছিল একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের মামলার এক রায়ে। ওই দুজন পরে যুদ্ধাপরাধে দোষি সাব্যস্ত হয়ে ফাঁসিতে ঝুলেছেন।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষনেতা গোলাম আযম পাকিস্তান থেকে এরশাদ আমলে ফিরলেও ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি সরকার গঠনের পর আমিরের দায়িত্ব নেন। তার প্রতিবাদে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে আন্দোলন গড়ে উঠলে সেখান থেকে জামায়াত নিষিদ্ধের দাবি জোরাল হয়ে ওঠে।
নিষিদ্ধ না হলেও সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে জামায়াত নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন হারিয়েছে ২০১৩ সালেই। ফলে দলীয়ভাবে তারা কোনও নির্বাচনে অংশ নিতে পারছে না। ১৯৮৬ সালের পর থেকে প্রায় প্রতিটি সংসদে জামায়াত ছিল। ২০০৮ সালের সংসদে দুটি আসনে জিতেছিল তারা। এরপর আর নির্বাচনে অংশ নিতে পারেনি।