রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নিষেধাজ্ঞার খড়গ কাটিয়ে এখন নিবন্ধন ফিরে পেতে জামায়তে ইসলামী তৎপর হলেও তাদের প্রতীক দাঁড়িপাল্লা নিয়ে ফ্যাঁকড়া থেকেই যাচ্ছে।
জামায়াত নেতারা অবশ্য আশা করছেন, নিবন্ধন ফেরত পেতে যে আইনি লড়াই চালাচ্ছে তারা, তাতে প্রতীকও ফেরত আসবে।
ইসি কর্মকর্তারা বলছেন, আদালতের নির্দেশে যেহেতু জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হয়েছিল, সেহেতু আদালতের নতুন নির্দেশ এলে সে অনুযায়ী কাজ করবেন তারা।
তবে দাঁড়িপাল্লা যেহেতু ন্যায়বিচারের প্রতীক এবং তা আদালতের সঙ্গে সম্পর্কিত, তাই এই বিষয়ে দলটিকে নতুন করে চিন্তা-ভাবনা করা উচিৎ বলে মত এসেছে আইনজ্ঞদের কাছ থেকে।
বাংলাদেশের নির্বাচনী আইন অনুযায়ী, ভোট করতে হলে যে কোনও দলকে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত হতে হয়। নিবন্ধিত প্রতিটি দলের জন্য একটি প্রতীক সংরক্ষিত থাকে, যা নিয়ে তারা ভোটের মাঠে নামে।
নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত না হলে দল হিসাবে তৎপরতা চালানো গেলেও দলীয় পরিচয়ে ভোটে অংশ নেওয়া যায় না। সেজন্য নিবন্ধন হারিয়ে জামায়াতকে ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে বিএনপির প্রতীকে ভোট করতে হয়েছিল।
জামায়াতের নিবন্ধন হারানোর ঘটনাটি ঘটেছিল আওয়ামী লীগের শাসনকালে। এই কালের অন্তিম সময়ে শেখ হাসিনার সরকার ‘সন্ত্রাসী দল’ আখ্যািয়ত করে জামায়াতকে নিষিদ্ধও করেছিল।
তার চার দিন পরই গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনাার সরকারের পতন ঘটলে পাল্টে যায় দৃশ্যপট, নিষেধাজ্ঞাও যায় উঠে। রাজনীতিতে দাপটের সঙ্গে ফেরা জামায়াত এখন আইনি জটিলতাও কাটানোর চেষ্টায় রয়েছে।
নিবন্ধনহারা যেভাবে
২০০৮ সালে সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে নিবন্ধনের নিয়ম চালুর সময় জামায়াতেরও নিবন্ধন ছিল। তাদের প্রতীক ছিল দাঁড়িপাল্লা। তার আগেও একই প্রতীকে ভোট করেছিল তারা।
জামায়াতকে নিবন্ধন দেওয়ার সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে তরীকত ফেডারেশনের নেতা সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরী, জাকের পার্টির নেতা মুন্সি আবদুল লতিফ, সম্মিলিত ইসলামী জোটের নেতা জিয়াউল হাসানসহ ২৫ জন ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে আদালতে একটি রিট আবেদন করেন।
ওই আবেদনের যুক্তি ছিল, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী জামায়াতের ঘোষণাপত্র বাংলাদেশের স্বাধীনতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ফলে এই দল নিবন্ধন পেতে পারে না।
২০১৩ সালের ১ আগস্ট বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি কাজী রেজা-উল হকের হাইকোর্ট বেঞ্চের রায়ে জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করা হয়।
আদালতের রায় পাওয়ার পর ২০১৮ সালের ৭ ডিসেম্বর জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে ইসি।
এদিকে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে জামায়াত। তবে আপিল শুনানিতে জামায়াতের মূল আইনজীবী উপস্থিত না থাকায় গত বছরের নভেম্বরে আপিল বিভাগ আপিল খারিজ করে দেয়।
এদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে গত ১ আগস্ট জামায়াতকে সন্ত্রাসী সত্তা হিসাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে শেখ হাসিনার সরকার। সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ১৮(১) ধারায় জামায়াত, ছাত্রশিবিরসহ তাদের অন্যান্য অঙ্গসংগঠনকে নিষিদ্ধ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন জারি হয়।
তবে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করে গত ৮ আগস্ট। এরপর গত ২৮ আগস্ট জামায়াত নিষিদ্ধের প্রজ্ঞাপন বাতিল করা হয়।
তার আগেই নতুন সরকারের সঙ্গে নানা আলোচনায় দেখা গিয়েছিল জামায়াত নেতাদের। বঙ্গভবনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শপথ অনুষ্ঠানেও আমিন্ত্রত ছিলেন দলটির নেতারা।
নিবন্ধন ফেরতে কী করছে জামায়াত
জামায়াত নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আইনি প্রক্রিয়ায়ই নিবন্ধন ফেরতের চেষ্টা চালাচ্ছে তারা।
দলের আমির শফিকুর রহমান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ফ্যাসিবাদের মাধ্যমে যেভাবে দলকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, একই কায়দায় নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছিল। নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত বাতিলের মতোই নিবন্ধন বাতিলের সিদ্ধান্তও বাতিল হবে। আমরা এর জন্য যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ায় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি।”
জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল মামলাটি পুনরায় শুনানির জন্য আবেদন করা হয়েছে।
জামায়াতের আইনজীবী, ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক নেতা মোহাম্মদ শিশির মনির সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ডিসমিস ফর ডিফল্ট হিসাবে খারিজ হওয়া আপিলটি পুনরুজ্জীবিত করতে আপিল বিভাগের চেম্বার আদালতে আবেদন করা হয়েছে।”
আগামী ২০ অক্টোবর এর শুনানি হবে বলে জানান তিনি।
দাঁড়িপাল্লা যেভাবে বাদ পড়ে
জামায়াত যে প্রতীকটি ব্যবহার করছিল, সেই দাঁড়িপাল্লা সুপ্রিম কোর্টের মনোগ্রামেও রয়েছে। তাই কোনও রাজনৈতিক দলকে এই প্রতীক না দিতে ইসির প্রতি আহ্বান রেখেছিল সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন।
সেই ডাকে সাড়া দিয়ে নির্বাচন কমিশনও দলীয় প্রতীকের তালিকা থেকে দাঁড়িপাল্লা বাদ দেয়। তা ঘটে ২০১৭ সালে, ততদিনে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হওয়ায় প্রতীকের প্রশ্নটি আর সামনে আসেনি।
২০১৬ সালে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার (এস কে সিনহা) নেতৃত্বে এক ফুল কোর্ট (আপিল বিভাগ ও হাই কোর্ট বিভাগের সব বিচারকদের নিয়ে সভা) সভায় মত আসে, দাঁড়িপাল্লা প্রতীক যেন কোনও রাজনৈতিক দলকে না দেওয়া হয়।
ওই বছরের ডিসেম্বরে আদালত প্রশাসন তাদের সিদ্ধান্ত নির্বাচন কমিশন সচিবালয়কেও জানায়। তারপর এরপর কমিশন সভায় প্রস্তাবটি অনুমোদনের পর বিধিমালায় সংশোধন আনা হয়। তাতে দাঁড়িপাল্লা প্রতীক হিসাবে বাদ পড়ে। তখন পর্যন্ত দলগুলোর জন্য বরাদ্দ ছিল ৬৫টি প্রতীক, দাঁড়িপাল্লা বাদ পড়লে প্রতীক দাঁড়ায় ৬৪টি।
জামায়াত এখন প্রতীক ফিরে পেতে চাইলে তাদের আদালতে যেতে হবে বলে মনে করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “দাঁড়িপাল্লা প্রতীক এটা রাজনৈতিক দলের ব্যাপার না। এটা আসলে ন্যায়বিচার সমতার প্রতীক, আইনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।
“আদালতের প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়েই যেতে হবে তাদের। তারা যদি রিভিউ চেয়ে বোঝাতে সক্ষম হয় যে এই (আদালতের) দাঁড়িপাল্লা আর জামায়াতে ইসলামীর দাঁড়িপাল্লার পার্থক্য আছে, আদালত যদি তাতে সন্তুষ্ট হয়। তবেই প্রতীক ফেরত পেতে পারে।”
জ্যোতির্ময় বড়ুয়ার সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেন জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমাদের যখন নিবন্ধন দেওয়া হয়, তখন প্রতীকসহই নিবন্ধন দেওয়া হয়েছিল। এখন যদি পুনর্বহাল করা হয়, তাহলে প্রতীকসহই করা হবে বলে আমার বিশ্বাস।”
প্রতীক নিয়ে কোনও জটিলতা হবে না বলে মনে করেন জামায়াতের আইনজীবী শিশির মনিরও।
তিনি বলেন, “প্রথমত প্রতীক নিয়ে কোনও নিষেধাজ্ঞা জারি হয়নি। যেটি হয়েছিল, তা ছিল পর্যালোচনা। আমরা নিবন্ধন মামলাতে যদি জিতে যাই, নিবন্ধন ফিরে পাই, নিবন্ধনের পাশাপাশি আমরা প্রতীকও ফেরত পাব।”
ফুল কোর্ট সভার সিদ্ধান্তকে প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত আখ্যায়িত করে শিশির মনির বলেন, “ইট ডাজন্ট মিন যে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। ফুল কোর্ট সভার সিদ্ধান্ত কোনও বিচারিক সিদ্ধান্ত নয়।”
ইসি কী বলছে
জামায়াতের নিবন্ধনের বিষয়ে আদালতের সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই কাজ হবে বলে সকাল সন্ধ্যাকে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনের সচিব শফিউল আজম।
দাঁড়িপাল্লা প্রতীকের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এ বিষয়টি এখনও আমাদের কাছে আসে নাই। আপনি হঠাৎ করেই বললেন। বিষয়টি আদালতের ব্যাপার। আদালত নিশ্চয়ই একটা নির্দেশনা দেবেন। আদালতের যে নির্দেশনা আসবে, আমরা সেই অনুযায়ী কাজ করব।”
নতুন প্রতীক নিয়ে কি ভাববে জামায়াত
নতুন অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচন দেবে। তার আগে যদি প্রতীকের সুরাহা না হয়, তবে জামায়াতকে নতুন প্রতীক নিয়ে ভাবতে হতে পারে।
আইনি লড়াইটি লম্বা প্রক্রিয়ার ব্যাপার মন্তব্য করে জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, “সেক্ষেত্রে নতুন প্রতীক নিয়েই জামায়াতে ইসলামীর চিন্তাভাবনা করা উচিৎ।”
তবে তেমন কোনও ভাবনা জামায়াতের নেই বলে জানালেন দলটির নেতা মতিউর রহমান।
তিনি বলেন, “কোর্টের ভিউ যদি ভিন্ন হয়, তাহলে তখন আমরা ভিন্ন চিন্তা করব।”
তবে তেমন কিছু ঘটবে না আশা রেখে জামায়াত আমির শফিকুর রহমান বলেন, “প্রতীক প্রতীকের জায়গায় থাকবে, ইনশাল্লাহ।”