ঢাকার শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরে চলছে জামদানি মেলা। সেখানে নানা রঙের বাহারি কাজের জামদানির পসরা নিয়ে বসেছে বিক্রেতারা। কিন্তু মেলায় ক্রেতা খুবই কম বলে অভিযোগ করেছে মেলায় অংশ নেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো। যদিও আয়োজক বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) বলছে, ভালো সাড়া মিলেছে।
জাতীয় জাদুঘরের নলিনীকান্ত ভট্টশালী গ্যালারীতে যৌথভাবে এই মেলা আয়োজন করেছে বিসিক ও জাদুঘর কর্তৃপক্ষ। ৩০ মার্চ শুরু হওয়া মেলা চলবে ৩ এপ্রিল পর্যন্ত। নারায়ণগঞ্জের রুপগঞ্জে গড়ে ওঠা বিসিক জামদানি শিল্পনগরীর ৩০টি প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছে এবারের মেলায়।
মঙ্গলবার মেলার চতুর্থ দিনে গিয়ে দেখা যায় ক্রেতা ও দর্শনার্থীর অভাবে অলস সময় কাটাচ্ছে স্টলের কর্মীরা। তারা বলছেন, ক্রেতা নেই বললেই চলে। সারা দিনে ২/১টির বেশি পণ্য বিক্রি করতে পারছে না কেউ।
মেলায় অংশ নেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি আব্দুল্লাহ জামদানি উইভিং ফ্যাক্টরি। সেখানকার বিক্রয় প্রতিনিধি মো. কাউসার বলেন, “বলা যায় মেলায় কোনও ক্রেতাই নেই। যাদের দেখছেন তারা বেশিরভাগই স্টলের লোকজন। আমাদের স্টলে ৭৫০ টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকার জামদানি আছে। কিন্তু কোনও ধরনের পণ্যই বিক্রি হচ্ছে না।”
একই কথা বলছিলেন মেসার্স হাসেম জামদানী উইভিং ফ্যাক্টরির স্টলের কর্মী আতিকুর রহমান জনি। মেলায় বিক্রির অবস্থা খুব খারাপ। তিনি জানান, মঙ্গলবার বেলা সোয়া ৩টা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে মাত্র ১টি শাড়ি।
স্টল ভাড়া দিয়ে, মালামাল পরিবহণ করে মেলায় অংশ নিয়ে যে টাকা খরচ হয়েছে, বিক্রি বাট্টা শেষে তার কিছুই উঠবে না বলেও মনে করছেন বিক্রেতারা। সজীব মিঞা সেপরান জামদানি উইভিং ফ্যক্টিরির কর্মী। তিনি বলেন, “মেলায় স্টল ভাড়া দিয়েছি ৬ হাজার টাকা। স্টল সাজানো ও মালামাল পরিবহনসহ সব মিলিয়ে ১৫ হাজার টাকার বেশি খরচ হয়ে গেছে। স্টলে কাজ করছে তিনজন। বিক্রি যা হচ্ছে তাতে স্টল ভাড়ার টাকাই উঠবে না। কর্মচারীদের খরচ দেব কোথা থেকে?”
ভালোমানের শাড়ি, থ্রি পিস, টু পিস, পাঞ্জাবি ও ওড়না নিয়ে এসেছেন তারিকুল জামদানি উইভিং ফ্যাক্টরি। তাদের মুখেও এখন হতাশার ছাপ। বিক্রয় প্রতিনিধি রিপন মিয়া জানান, আজ মাত্র ২টা পাঞ্জাবি বিক্রি হয়েছে। এভাবে বিক্রি হলেতো স্টল ভাড়ার টাকাই উঠবে না।
মেলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলেন গুটিকয়েক ক্রেতা। তাদেরই একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়ুয়া শিক্ষার্থী তানভীর মৌন। সঙ্গে ছিলেন চারুকলার শিক্ষার্থী মো. রাফি। সামনেই ঈদ। ভেবেছিলেন মায়ের জন্য শাড়িটা এখান থেকেই কিনে নিবেন। কিন্তু বাধ সাধে দাম। মৌন বলেন, “জামদানি শাড়ি মায়ের খুব পছন্দ। ভেবেছিলাম মেলায় একটু কম দামে শাড়ি পাবো। কিন্তু এখানেও দাম অনেক বেশি।” একই কারণে পছন্দ হলেও শাড়ি কিনতে পারেননি রাফি।
স্বামী-সন্তান নিয়ে পুরান ঢাকার নবাবপুর থেকে জামদানি মেলায় এসেছিলেন আসমা আক্তার। অনেকক্ষণ ঘুরেও কোনও শাড়ি কিনতে পারেননি তিনি। সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “যেসব শাড়ি পছন্দ হচ্ছে, তার দাম আকাশছোঁয়া। আর কম দামের শাড়ির মান খুবই খারাপ। জামদানি হাতে বোনা হলেও মেলায় মেশিনে তৈরি অনেক শাড়ি এসেছে। বিষয়টি আমার কাছে প্রতারণা মনে হয়েছে।”
ক্রেতা বিক্রেতাদের এমন মন্তব্যের মধ্যে মেলায় দর্শনার্থীদের উপস্থিতি সন্তোষজনক বলে দাবি করেছেন বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের উপব্যবস্থাপক নাসরিন সুলতানা। তিনি বলেন, “ক্রেতাদের মধ্যে জামদানি নিয়ে ভালো আগ্রহ আছে। মেলায় আমরা ভালো সাড়া পেয়েছি।”
এবারের মেলায় ২ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা দামের পণ্য আছে। যেগুলোর দাম ১০ হাজারের মধ্যে ক্রেতাদের কাছে সেগুলোর চাহিদা বেশি বলেই জানান নাসরিন সুলতানা। তিনি বলেন, “মেলা আয়োজনের মূল উদ্দেশ্য প্রচারণা। সেই উদ্দেশ্য পূরণ হয়েছে। ২০১৪ সাল থেকে আমরা জামদানি মেলার আয়োজন করছি। কিন্তু কোভিডের কারণে ২০১৯ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত মেলার আয়োজন বন্ধ ছিল। চার বছর পর আমরা আবারও জামদানি মেলা শুরু করেছি। কারণ মেলা ছাড়া জামদানির প্রচারণা সম্ভব না।”
‘মেলায় বিক্রি কম’ স্টল মালিকদের এমন অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, “একটি ভালো মানের জামদানি তৈরিতে কারিগরদের ২ থেকে ৬ মাস পর্যন্ত সময় লাগে। মালিকরা আশা করেন মেলায় তাদের এক্সক্লুসিভ পণ্যগুলো বেশি বিক্রি হবে। যেসব পণ্যের দাম ৫০ হাজারের বেশি। তাই কম দামি পণ্যগুলো বেশি বিক্রি হলেও তারা খুশি হন না।”
বংশ পরম্পরায় জামদানি ব্যবসা করে ব্যবসায়ীরা। জামদানি শিল্পে অনেক ধরণের প্রতিবন্ধকতা আছে। সেসব প্রতিবন্ধকতা জয় করে এগিয়ে যাচ্ছে জামদানি শিল্প। প্রধানমন্ত্রীও জামদানি নিয়ে উৎসাহিত করেছেন। এছাড়াও মেলার আয়োজনসহ বিভিন্নভাবে জামদানির প্রচারণা চালানো হচ্ছে। সে কারণে আমাদের দেশের অনেক তারকারা এখন জামদানি পরতে উৎসাহিত হচ্ছেন। এমনকি কান অনুষ্ঠানেও আমাদের তারকারা জামদানি পড়ছেন। সব মিলিয়ে খুব শিগগিরই জামদানির সুদিন ফিরবে বলেই মনে করেন এই বিসিক কর্মকর্তা।