নানা বিতর্ক ও সমালোচনাকে সঙ্গী করে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির দায়িত্ব নিয়েছেন নন্দিত নাট্যব্যক্তিত্ব সৈয়দ জামিল আহমেদ।
তার একটি খণ্ডিত বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার মধ্য দিয়ে মঙ্গলবার দিনভর সমালোচনার কেন্দ্রে ছিলেন এ বরেণ্য ব্যক্তিত্ব। ‘২০২৪ সালে এসেও নারীদের বোরকা পরতে হবে কেন?’- এমন একটি বক্তব্য নিয়ে সমালোচনা করতে থাকেন নেটিজেনরা।
জানা যায়, গত শনিবার সন্ধ্যায় বেইলি রোডের মহিলা সমিতি মিলনায়তনে ‘বিক্ষুব্ধ থিয়েটারকর্মীগণ’ নামে একটি প্লাটফর্ম আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় জামিল আহমেদ সমসাময়িক থিয়েটারচর্চা নিয়ে নানা বক্তব্য দেন।
সেখানে তিনি বলেন, “শিল্পকলা একাডেমিতে আমি যদি সুযোগ পাই, আমি চাইবো সেখানে জামায়াত যেন আসে, এজন্য যে বলুক না জামায়াত- কেন ২০২৪ সালেও মেয়েদের বোরকা পরতে হবে? তারা আমাদেরকে কনভিন্সড করবে যে কেন ২০২৪ সালে শরীয়তি রাষ্ট্রব্যবস্থা দরকার?”
এ ছাড়া গণমাধ্যমে একটি সাক্ষাৎকারে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের আমন্ত্রণে প্রথম দিকে শিল্পকলা একাডেমির দায়িত্বভার গ্রহণ নিয়েও নিজের অনীহার কথা জানিয়েছিলেন তিনি। তার সেই ‘অনীহার’ কথা তুলে ধরেও প্রশ্ন তোলেন অনেকেই।
এবার শিল্পকলা একাডেমির দায়িত্বে আসার দ্বিতীয় দিনে বুধবার শিল্পকলা একাডেমিতে এক সংবাদ সম্মেলনে সেসব সমালোচনার জবাব দিলেন নিজেই।
উপস্থাপন করেন শিল্পকলা একাডেমি নিয়ে তার পর্যবেক্ষণে ধরা পড়া প্রধান সমস্যা ও সংকটগুলো। জানান তার আগামী দিনের কর্মপরিকল্পনার কথাও।
এতে শিল্পকলা একাডেমি নিয়ে তার আগামীর রূপকল্প উপস্থাপন পর্বে তিনি বলেন, “ইসলামের সঙ্গে সাংস্কৃতিক চর্চার কোনও বিরোধ নেই। সেই বিরোধিতার দর্শন ও বাস্তবতার জ্ঞান নিয়ে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আরও সবল বেগে পরিচালিত হতে হবে।”
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবেও তিনি বলেন, “আপনারা শুধু ভাইরাল হওয়ার জন্য, ভিউ বাড়ানোর জন্য কাজ করবেন না। যারা সমালোচনা করছে তাদের সেদিনের অনুষ্ঠানের পুরনো ভিডিওটি দেখান। আমি শুধু একটি প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলাম।”
সংবাদ সম্মেলনের আগে সৈয়দ জামিল আহমেদ মোট ১১টি পর্বে শিল্পকলা একাডেমির প্রধান সমস্যা, সংকট ও কর্মপরিকল্পনাগুলো তুলে ধরেন সেগুলো হলো-
বিদ্যমান আইন পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আইন, ১৯৮৯ এর ধারা ২ থেকে ধারা ১৩ এর ৩ নং উপধারা পর্যন্ত কোথাও বস্তুত এই একাডেমি বলতে রাষ্ট্র কী মনে করে এবং এর ভিশন (রূপকল্প) কী তা স্পষ্ট হয় না। এই আইনের ৪ নং ধারা অনুযায়ী, ‘একাডেমির সাধারণ পরিচালনা ও প্রশাসন একটি পরিষদের উপর ন্যস্ত থাকিবে এবং পরিষদ সেই সকল ক্ষমতা প্রয়োগ ও কাজ করিতে পারিবে যাহা একাডেমি কর্তৃক প্রযুক্ত ও সম্পন্ন হইতে পারে।’
কিন্তু সাধারণ পরিষদ গঠনের বিধি সম্বলিত ৫ নং ধারায় বর্ণিত ১৩টি উপধারা পর্যালোচনা করে প্রতীয়মান হয় যে, একাডেমি যেন সরকারের আজ্ঞাবহ একটি দলীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত ও পর্যবসিত হবার ঝুঁকিতে পতিত হয়েছে। অথচ ৩ নং ধারার ২নং উপধারায় বলা হয়েছে, ‘একাডেমী একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা হইবে।’
একাডেমির ক্ষমতা ও দায়িত্ব সংক্রান্ত ৭ নং ধারায় বর্ণিত ১৫টি উপধারাগুলির অস্পষ্টতা, সীমাবদ্ধতা ও অপপ্রয়োগে বিগত সকল শাসনামলেই লক্ষ্য করা গেছে। ফলে, পদলেহী শিল্পীদের দ্বারা সরকারি শিল্পকর্ম যাচ্ছেতাইভাবে সৃষ্টি করে একাডেমি একটি অনুগত ও দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
সংস্কৃতি কেবল আনন্দ-বিনোদনের ক্ষেত্র নয়
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিকে বিবিধ সংস্কৃতির হাজার মালভূমি দিয়ে গঠিত সৃষ্টি-কৃষ্টির এক যৌথ জমিনে পরিণত করার উদ্যোগ নিতে চাইছেন জামিল আহমেদ। তার পরিকল্পনা অনুযায়ী, ক জাতি, এক রাষ্ট্র, এক নেতা, এক ভাষা, এক ধর্ম ও এক মতাদর্শ ভিত্তিক সাংস্কৃতিক চর্চাকে একাডেমি সর্বদা ‘না’ বলবে। বরং, বহু জাতি, বহু ভাষা, বহু ধর্ম, বহু ভাবাদর্শভিত্তিক সৃষ্টি-সৌন্দর্য-আনন্দের এক সংলাপাত্মক জনগণতান্ত্রিক শিল্প-পরিসর রূপে গড়ে উঠবে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। দেশজ সংস্কৃতি ও বিশ্ব-সংস্কৃতির যোগসাধন করে একাডেমি এক নতুন দিনের সাংস্কৃতিক অনুশীলনের সেতুবন্ধন ঘটাবে।
সংস্কৃতি কেবল আনন্দ-বিনোদনের ক্ষেত্র নয়। সংস্কৃতি হলো সেই নান্দনিক ক্রিয়া যার মাধ্যমে রাষ্ট্রের অন্তর্গত সকল নাগরিকের সম্মিলিত জীবনীশক্তির পরিচয় প্রতিফলিত হয়। সংস্কৃতির চর্চায় জাতীয় জীবনের প্রাণস্পন্দন উপলব্ধি করা যায়। কেননা সংস্কৃতি জীবনের অর্থ নির্মাণ করে। জীবনের বিকাশ ও রাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রে সংস্কৃতি মানবজীবনের একেবারে কেন্দ্রে থাকে।
এ প্রসঙ্গে তিনি উদাহরণ টানতে গিয়ে বলেন, “বাংলাদেশে ইসলাম প্রশ্নে যুক্ত হয়ে দৃঢ়ভাবে বলা যায় যে, ইসলামের সঙ্গে সাংস্কৃতিক চর্চার কোনও বিরোধ নেই। সেই বিরোধিতার দর্শন ও বাস্তবতার জ্ঞান নিয়ে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আরও সবল বেগে পরিচালিত হতে হবে।”
একাডেমির ‘সংস্কার সেল’ গঠন
পূর্ববর্তী রেজিমে সৃষ্ট একাডেমির প্রাতিষ্ঠানিক স্বৈরতান্ত্রিক পরিচালন-পদ্ধতি ও স্বভাবকে বদলে দিতে চান নতুন মহাপরিচালক। এই লক্ষ্যে স্বায়ত্তশাসিত রাষ্ট্রীয় সাংস্কৃতিক একাডেমিতে পরিণত করতে প্রয়োজনীয় কাঠামোগত সংস্কার করতে চান তিনি শিল্পকলার । কাঠামোগত ও অবকাঠামোগত—উভয় প্রকার সংস্কার ও রূপান্তরের লক্ষ্যে রূপরেখা প্রণয়ন করতে মহাপরিচালকের সহায়তায় খণ্ডকালীন এক বা একাধিক পরামর্শক-উপদেশক-গবেষক নিয়োগ দিয়ে দ্রুত একটি ‘সংস্কার সেল গঠন’ করার কথা জানান তিনি।
সংস্কৃতি খাতে জিডিপি’র কমপক্ষে তিন শতাংশ বরাদ্দ দাবি
রাষ্ট্রের রূপান্তরেও কেবল ‘ইনফ্রাসট্রাকচারাল ডেভেলপমেন্ট’ নয় বরং ‘হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট’ ধারণাকে একটি অন্যতম নীতিরূপে গণ্য করার কথা বলে নাট্য ব্যক্তিত্ব জামিল আহমেদ। এই নীতি অনুযায়ী সংস্কৃতি খাতে জিডিপি’র কমপক্ষে তিন শতাংশ বরাদ্দ দিয়ে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিকে আর্থিকভাবে সক্ষম ও স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তোলার প্রয়োজন স্বীকার করে প্রযোজ্য সমর্থন ও উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানান তিনি।
একাডেমির বিকেন্দ্রীকরণ
একাডেমির বাজেট বাড়িয়ে জেলা ইউনিটগুলিকে স্থানীয় সাংস্কৃতিক স্বায়ত্তশাসিত এককে পরিণত করতে নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার প্রস্তাব দেন মহাপরিচালক জামিল। তিনি মনে করেন, স্থানীয় বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তিগুলির প্রদর্শন, পুনঃসৃজন ও উদ্ভাবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে। কারণ, লোকজ শিল্পী ও জনগণের পরিসর রূপে জেলা শিল্পকলা একাডেমিগুলিকে গড়ে তুলবার আর কোনও বিকল্প নেই।
সংস্কৃতি চর্চায় কট্টরপন্থী বাধা অপসারণে সরকারের দায়-দায়িত্ব
মুক্ত সাংস্কৃতিক চর্চায় সকল প্রকার কট্টরপন্থী, অসহিষ্ণু মতাদর্শিক ও ধর্মীয় বাধা এবং প্রতিবন্ধকতা অপসারণ ও মোকাবিলা করার কথা বলেন শিল্পকলার নতুন মহাপরিচালক। এই লক্ষ্যে রাষ্ট্রীয় নীতি ও ক্ষমতা প্রয়োগ করে সাংস্কৃতিক সুরক্ষা বলয় ও ‘কালচারাল জাস্টিস’ নিশ্চিত করার সুস্পষ্ট রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকার থাকার প্রতি জোর দেন তিনি।
রাষ্ট্র, সরকার ও একাডেমির ত্রিমুখী সম্পর্ক
রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও সরকারি যথেচ্ছাচারমূলক ইচ্ছা পূরণের তল্পিবাহক প্রতিষ্ঠানে পর্যবসিত হবার দুষ্টচক্র থেকে শিল্পকলা একাডেমিকে বের করে আনা এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি বলে মনে করেন জামিল আহমেদ। তার মতে, রাজনৈতিকভাবে গঠিত জনগণের সাংস্কৃতিক ইচ্ছাকে উপলব্ধি করে একাডেমিকে স্বাধীন প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে প্রয়োজন সর্বাত্মক জরুরি তৎপরতা।
তিনি বলেন, “বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিকে এই দেশের জনগণের বহুত্ববোধক সাংস্কৃতিক ইচ্ছার কাছে দায়বদ্ধ প্রতিষ্ঠান রূপে গণ্য করতে হবে এবং এর মহাপরিচালককে সাংস্কৃতিক উপদেষ্টার কাছে দায়বদ্ধ থাকতে হবে ও জবাবদিহিতা দিতে হবে।
এছাড়া রাষ্ট্রীয় সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বিশ্বসমাজের যোগ এবং দুর্নীতিমুক্ত শিল্পকলা একাডেমি গঠনের জন্যও নানা পরিকল্পনার কথা বলেন জামিল আহমেদ। দুর্নীতি দমনে ফিনান্সিয়াল অ্যাডভাইজার স্বল্পকালীন সময়ে নিয়োজিত করার পরিকল্পনার কথা জানান তিনি।
তিনি জানান, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় ২২টি জেলার শিল্পকলা একাডেমি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। সেগুলি সচল ও পুনর্গঠনের লক্ষ্যে প্রয়োজনে সেসব স্থান নিজেই পরিদর্শন ও পদক্ষেপ নিবেন। এ কাজে সহযোগিতা কামনা করেছেন জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারদেরও।
এ ছাড়া, দ্রুত রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমিকেও সচল করতে চান তিনি। সকল পরিকল্পনা স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী কালপর্বে ভাগ করে তা বাস্তবায়নে এগিয়ে যেতে চান।
তিনি বলেন, “এই তিন কালপর্বে, একাডেমিকে নতুন দেশের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী সচল করতে বস্তুত দরকার হলো সংস্কার ও গণতান্ত্রিক রূপান্তর। এই লক্ষ্য পূরণে মহাপরিচালকের দায়-দায়িত্ব, ক্ষমতা-পদসোপান ও জবাবদিহিতা অবশ্যই পুনঃনির্ধারণ করতে হবে।”