সংকট গভীর হচ্ছে জাতীয় পার্টিতে; একদিকে বহিষ্কার চলছে, অন্যদিকে ভোটে হারা বিক্ষুব্ধ লাঙ্গলের প্রার্থীরা জড়ো হচ্ছেন ঢাকায়। তাদের পদক্ষেপ দলটিতে আবার ভাঙনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
জাতীয় পার্টিতে দীর্ঘদিনের বিবাদ জেগে ওঠে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগেই। তার জেরে ভোট থেকে বিরত থাকেন দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ।
দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদের দর কষাকষি করে ২৬ আসন আওয়ামী লীগের কাছ থেকে ছাড় নিলেও লাঙ্গলের প্রার্থীরা জেতেন কেবল ১১টি আসনে।
১৫ আসনে আওয়ামী লীগ নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কাছে হারতে হয়েছিল জাতীয় পার্টিকে। অন্যদিকে সমঝোতার বাইরে দুই শতাধিক আসনে দলটি প্রার্থী দিলেও কেউই জেতেননি।
এই অবস্থায় ১০ জানুয়ারি সংসদ সদস্যদের শপথ নেওয়ার সময় বিক্ষুব্ধ নেতা-কর্মীরা দলের চেয়ারম্যানের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নিয়ে তা ও মহাসচিবের বিরুদ্ধে স্লোগান তোলেন।
তার জেরে দলের কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ এবং সভাপতিমণ্ডরীর সদস্য সুনীল শুভ রায়কে অব্যাহতি দিয়েছেন জি এম কাদের।
শুক্রবার দলের যুগ্ম দপ্তর সম্পাদক মাহমুদ আলম স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের দলীয় গঠনতন্ত্রের প্রদত্ত ক্ষমতাবলে কাজী ফিরোজ রশীদকে কো-চেয়ারম্যান ও সুনীল শুভ রায়কে প্রেসিডিয়াম সদস্যপদসহ দলীয় সব পদ-পদবি থেকে অব্যাহতি প্রদান করেছেন, যা ইতোমধ্যে কার্যকর করা হয়েছে।”
ফিরোজ রশীদ ও সুনীল শুভ দুজনই জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা এইচ এম এরশাদের স্ত্রী রওশনের সমর্থক।
ফিরোজ রশীদ একাদশ সংসদে ঢাকা-৬ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। এবার আসনটি আওয়ামী লীগ ছেড়ে না দেওয়ায় তিনি ভোটই করেননি।
বিজ্ঞপ্তিতে অব্যাহতির কারণ জানানো হয়নি। এ বিষয়ে কথা বলতে ফিরোজ রশিদকে তার মোবাইল ফোনে কল করলেও তিনি ধরেননি।
তবে সুনীল শুভ রায় সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, তিনি অব্যাহতিপত্র পেয়েছেন। তবে এটা তার কাছে ‘অর্থহীন এবং মূল্যহীন’।
এরশাদের ভাই কাদের যেভাবে দল পরিচালনা করছেন, তাতে অনেক দিন ধরেই মানসিকভাবে একমত হতে পারছেন না বলে জানান সুনীল।
তিনি বলেন, “আমি নিজেই অব্যাহতি নিতাম। কিন্তু এভাবে ছেড়ে দিলে হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টির সম্মানহানি হবে ভেবে নিইনি। আজ তিনি আমাকে অব্যাহতি দিয়ে আমারই লাভ করিয়ে দিলেন।”
অব্যাহতির নেপথ্যে
গত ১০ জানুয়ারি জাতীয় পার্টি থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা যখন শপথ নিচ্ছিলেন, তখন বনানীতে দলের চেয়ারম্যানের কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ করছিলেন দলটির একদল নেতা-কর্মী। সেখানে পরাজিত প্রার্থী কয়েকজনও ছিলেন।
সেদিন তাদের কার্যালয়ের ভেতরে ঢুকতে দেয়নি পুলিশ। এরপর রাস্তায় দাঁড়িয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা।
সেই সংবাদ সম্মেলনে ফিরোজ রশিদ থাকবেন বলে শোনা গেলেও তিনি যাননি। উপস্থিত ছিলেন সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবু হোসেন বাবলা। একাদশ সংসদের এই সদস্য ঢাকার একটি আসনে প্রার্থী হয়ে হেরেছেন।
১০ জানুয়ারির সেই বিক্ষোভ আয়োজনের নেপথ্যে ফিরোজ রশিদ ছিলেন বলে কাদের সমর্থকরা মনে করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলটির এক নেতা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “কাজী ফিরোজ রশীদ দীর্ঘদিন ধরে জি এম কাদেরের পার্টি চালানো নিয়ে বিরক্ত। বিভিন্ন সময় বললেও তার কথা শোনা হয়নি। নির্বাচনের পর পার্টির নেতারা মূলত কাজী ফিরোজ রশীদের নেতৃত্বেই জাতীয় পার্টি রক্ষা করতে চেয়েছিলেন।”
সেই সংবাদ সম্মেলনে সুনীল শুভ রায়ও ছিলেন। তিনিই লিখিত বক্তব্যের কাগজ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য সাইদুর রহমান টেপার হাতে দেন। সাইদুর বক্তব্য দিলেও সেটি সুনীলেরই তৈরি করা ছিল।
ঢাকায় আসছেন পরাজিতরা
১০ জানুয়ারি সংবাদ সম্মেলন থেকে কাদের এবং মহাসচিব মজিবুল হক চুন্নুকে অব্যাহতি নেওয়ার জন্য ৪৮ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেওয়া হয়। সেই সময়সীমা এরই মধ্যে শেষ হয়েছে।
এখন পরবর্তী পদক্ষেপ কী- জানতে চাইলে সুনীল বলেন, “আগামী ১৪ তারিখ ঢাকায় জাতীয় পার্টির সকল পরাজিত প্রার্থীরা আসছেন। আমরা দিনব্যাপী সভা করব। আমরা কীভাবে জাতীয় পার্টি করব, তার সিদ্ধান্ত নেব।”
তিনি আরও বলেন, “হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদের আদর্শ থেকে দল বিচ্যুত হচ্ছে। জাতীয় পার্টিকে আবার তার আদর্শের ধারায় ফিরিয়ে আনার সময় এখন।”
সেনাপ্রধান এরশাদ অবৈধভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পর ১৯৮৬ সালে গড়ে তোলেন জাতীয় পার্টি। গণঅভ্যূত্থানে ক্ষমতাচ্যুত এই সেনাশাসক দল চালাতেন তার ইচ্ছামতো। দলে কাউকে আনা কিংবা বহিষ্কার করা ছিল তার ইচ্ছাধীন, দলের গঠনতন্ত্রেই তাকে সেই ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল।
এরশাদ জীবিত থাকাকালেই দলটি কয়েকবার ভাঙনের মুখে পড়ে। ১৯৯৬ সালে প্রথম ভাঙনে তৎকালীন মহাসচিব আনোয়ার হোসেন মঞ্জু আলাদা হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি জাতীয় পার্টি-জেপি নামে দল চালাচ্ছেন।
এর পরের মহাসচিব নাজিউর রহমান মঞ্জুরও আলাদা হয়ে গড়েন বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপি। আরেক মহাসচিব কাজী জাফর আহমেদের হাত দিয়েও আলাদা দল হয়েছে। সেটি জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর) নামে পরিচিত।
এরশাদের মৃত্যুর পর দলের কর্তৃত্ব নিয়ে দেবর কাদেরের সঙ্গে ভাবি রওশনের দ্বন্দ্বে জাতীয় পার্টি পুনরায় ভাঙনের মুখে পড়েছিল। তবে দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা সমঝোতার উদ্যোগ নিলে সে দফায় ভাঙন ঠেকে।
এদিকে এরশাদের আরেক স্ত্রী বিদিশাও জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেন। এরশাদের সঙ্গে তালাকের পর দলে বিদিশার কোনো পদ না থাকলেও তাকে একটি বলয় গড়ার তৎপরতায় নানা সময়ে দেখা গেছে।