ভোট নিয়ে জমা ক্ষোভ উগরে দিলেন লাঙ্গলের প্রার্থীরা; তবে তাদের যারা জড়ো করেছিলেন, তারা হটেছেন পিছু; আর এরই মধ্যে আরও দুজনের উপর নামল বহিষ্কারের খড়গ।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের পর জাতীয় পার্টিতে যে অস্থিরতা চলছে, তার নানামুখী প্রকাশ দেখা দিল প্রয়াত সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদের গড়া দলটিতে।
গত তিনটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট করে কিংবা সমঝোতা করে সংসদে বেশ কিছু আসন নিশ্চিত করে আসছিল জাতীয় পার্টি। মন্ত্রিত্ব নিয়েছিল, সংসদে প্রধান বিরোধী দলের আসনও পেয়েছিল।
এবার বিএনপিবিহীন নির্বাচনে আওয়ামী লীগে সঙ্গে ২৬টি আসনে সমঝোতা করলেও ফল হয়েছে বিপর্যয়কর। সাকু্ল্যে ১১টি আসনে জিততে পেরেছে তারা।
সমঝোতার বাইরেও দুই শতাধিক আসনে লাঙ্গলের প্রার্থী ছিল। তারাও হেরেছেন। আর হারের পর কেন্দ্রীয় নেতাদের দিকে তুলেছেন অভিযোগের আঙুল।
গত ১০ জানুয়ারি সংসদ সদস্যদের শপথ নেওয়ার দিন জাতীয় পার্টির একদল নেতা-কর্মী ঢাকার বনানীতে দলের চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে বিক্ষোভ করে চেয়ারম্যান জি এম কাদের এবং মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুকে পদত্যাগের জন্য ৪৯ ঘণ্টা সময় বেঁধে দিয়েছিল। সেই সঙ্গে রবিবার সব প্রার্থীদের ঢাকায় এনে জাতীয় পার্টিতে ‘আপন ধারায়’ ফেরানোর লক্ষ্যে সভা করার ঘোষণাও সেদিন দেয়।
অভিযোগের তীর কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের দিকে
কাকরাইলের ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত সভায় সারাদেশ থেকে আসা জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা চেয়ারম্যান ও মহাসচিবের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎ, পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠা,যোগাযোগ না করা এবং দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ তোলেন; যদিও সভার ব্যানারে এরশাদের পাশাপাশি জি এম কাদেরের ছবিও টানান ছিল।
দলের ঢাকা মহানগর উত্তরের সভাপতি শফিকুল ইসলাম সেন্টু বলেন, “নেতা-কর্মীদের আক্ষেপ তাদের সাথে যোগাযোগ করেন নাই চেয়ারম্যান ও মহাসচিব। নির্বাচনের আগে প্রার্থীরা আমার কাছে এসেছিলেন। তারা দেখা পায় নাই নেতাদের।
“মহাসচিব আমাকে বলেছেন যে তিনি অল্প কিছু টাকা পেয়েছেন। আমি তাকে বললাম, সবাইকে অল্প অল্প করে দিয়ে দিয়েন। কিন্তু তিনি শেরিফা কাদেরের (কাদেরের স্ত্রী) কাছে টাকা দিয়ে এলাকায় চলে গেলেন।”
সেন্টু বলেন, “আমরা জানি, সরকার সিটও দিয়েছে, অর্থও দিয়েছে। কিন্তু নিজেরা নিজেরা খেয়েছে, বাকি কোনও নেতার দিকে তাকায় নাই। একবার বলে ভিক্ষার আসন নিবেন না কিন্তু যেই নিজের বউ শেরিফা কাদের চূড়ান্ত হলো, সাথে সাথে চেয়ারম্যান নির্বাচনে যেতে রাজি হয়ে গেলেন। আমাদের ত্যাগী নেতাদের জবাই করে দিল শুধু নিজের পরিবারতন্ত্র টিকাতে গিয়া।”
চেয়ারম্যানের উদ্দেশে সেন্টু বলেন, “আপনি ঘুঘু দেখেছেন, কিন্তু ঘুঘুর ফাঁদ দেখেন নাই। আপনাকে ঘুঘুর ফাঁদ দেখিয়ে দিব। আপনি রাজনীতিতে আমাদের জুনিয়র, আপনাকে রাজনীতি আমাদের কাছ থেকে জানতে হবে।”
বহিষ্কৃত নেতাদের দলে ফেরত নিতে আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “তা নাহলে বহিষ্কৃত আর আঘাতপ্রাপ্তরা এক হয়ে গেলে চেয়ারম্যান ও মহাসচিব নিস্তার পাবেন না।”
ঢাকা-৭ আসনের প্রার্থী সাইফুদ্দিন আহমেদ মিলন দলের চেয়ারম্যানকে লক্ষ্য করে বলেন, “আপনারা কিছু সিটের আর অর্থের লোভে নির্বাচনে চলে গেলেন। আপনি আপনার সাথে সাথে জাতীয় পার্টির ইজ্জত মাটিতে লুটিয়ে দিলেন।”
কিশোরগঞ্জ-৬ আসনের প্রার্থী নুরুল কাদের সোহেল বলেন, “পার্টির নেতারা কেউ ফোন ধরেন নাই, যোগাযোগ করেন নাই। কোনও সাহায্য আমরা পাই নাই। আমাদের ভুল বুঝিয়ে বলির পাঠা বানানো হয়েছে। আমার নামে নাকি ২৫ লক্ষ টাকা বরাদ্দ ছিল, আমি নাকি ১০ লক্ষ টাকা হাতেও নিয়েছি। কিন্তু আমি কোনও টাকাই পাই নাই।”
একই সুর ছিল সিরাজগঞ্জ-৬ আসনের প্রার্থী মোক্তার হোসেনেরও৷ তিনি বলেন, “আমরা জানতাম আমরা দল থেকে সাহায্য পাব। তাই আমরা নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলাম। কিন্তু আমরা কেউ সাহায্য পাই নাই। আমরা ফোন দিয়েছিলাম, কোনও নেতা ফোন ধরেন নাই।”
নোয়াখালী-৩ আসনের প্রার্থী ফজলে এলাহী সোহাগ মিয়া বলেন, “পূর্বে জি এম কাদেরের নেতৃত্বে এই মিলনায়তনেই সভা হয়েছিল। ৫৯ জেলার প্রতিনিধিরাই বলেছিল যেন আমরা নির্বাচনে না যাই। প্রতিনিধিরা আমরা বলেছিলাম, যদি নির্বাচনে যেতেও হয়, তাও যেন আমরা কোনও প্রকার সমঝোতা ছাড়া যাই, ৩০০ আসনে নির্বাচন করি।
“আমরা জিএম কাদেরকে বিশ্বাস করেছিলাম। ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত আমরা জানি, আমরা সমঝোতা বাদে নির্বাচন করব। কিন্তু ১৭ তারিখ সব পালটে গেল। আমাদের বিশ্বাস তিনি রাখেননি, বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন।”
জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা শারমিন সুলতানা রিমি বলেন, “চেয়ারম্যান স্যারের আশে পাশে অনেক আগাছা তৈরি হয়েছে। এই সিন্ডিকেট জাতীয় পার্টিকে ধ্বংস করে ফেলছে। শেরিফা কাদেরকে নির্বাচনের তিন দিন আগে প্রেসিডিয়াম সদস্য করা হলো। কীভাবে করা হলো? কোন নিয়মে “
সিলেট-২ আসনের প্রার্থী ইয়াহ ইয়া চৌধুরী বলেন, “শেরিফা কাদের চূড়ান্ত হওয়ার সাথে সাথেই আপনি নির্বাচনে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলেন। একবারও তো আপনি জাতীয় পার্টির সিনিয়র নেতাদের কথা ভাবেননি। আপনি আপনার স্ত্রী, শ্বশুর আর নাতিকে নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন।
“বিগত ৪ বছর আপনি গণতন্ত্রের অনেক কথা বলেছেন। কিন্তু নির্বাচন শেষে আপনি আমাদের সাথে কথা না বলে শপথ নিতে চলে গেলেন। আমাদের সাথে একবার বসলেন না, ব্যর্থতার কারণ বের করার চেষ্টা করলেন না।”
‘ব্র্যাকেট যুক্ত হবে না’
গত বুধবার বনানীতে কাদের ও চুন্নুকে পদত্যাগের জন্য ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিলেও রবিবার সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা দাবি করেছেন, এটা তারা দেননি।
মতবিনিময় সভায় তিনি বলেন, “বুধবারে আমরা পার্টি অফিস গিয়েছিলাম। কিন্তু আমি পরিষ্কার করে বলতে চাই, আল্টিমেটামের সাথে আমাদের কোনও সম্পর্ক নেই। আমরা রক্ত দিয়ে জাতীয় পার্টি গড়ে তুলেছি। পাঁচবার আমি জেল খেটেছি, আমার বাড়ি লুট হয়েছে। আমরা জাতীয় পার্টি ভাঙতে পারি না। আমরা তদন্ত করে দেখব, আল্টিমেটাম কে বা কারা দিল।”
বুধবার বিক্ষোভের সময় পুলিশি বাধায় কার্যালয়ে ঢুকতে না পেরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন দলটির কো-চেয়ারম্যান বাবলা এবং সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য সাইদুর রহমান টেপা।
এবার নির্বাচনে অংশ নিয়ে পরাজিত হওয়া বাবলা সেদিন বলেছিলেন, “তারা (চেয়ারম্যান-মহাসচিব) যদি পদত্যাগ না করে তাহলে পার্টির গঠনতন্ত্র মোতাবেক সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আমরা বর্ধিত সভা করে কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত নেব। সেখান থেকে আমরা ঠিক করব, কীভাবে জাতীয় পার্টি সামনের দিনে চলবে।”
কিন্তু রবিবারের মতবিনিময় সভায় বিপরীত বক্তব্য আসে তার কাছ থেকে।
তিনি বলেন, “আমরা এখানে দল ভাঙতে আসি নাই। আমরা জাতীয় পার্টির নামের সাথে ব্র্যাকেট বসাতে আসি নাই। এটা আত্মশুদ্ধির সভা। আমরা আমাদের জাতীয় পার্টির পুনর্জাগরণের জন্য আজকের এ সভা করছি।”
“অনেকেই জাতীয় পার্টিকে ভাঙতে এসেছে, তারা কেউ টিকে নাই। তাদের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে। আমরা হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদের অনুসারী, আমরা একতায় বিশ্বাসী।”
সভায় দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য লিয়াকত হোসেন খোকা বলেন, “আমরা এ সভায় জাতীয় পার্টি ভাঙতে আসি নাই। আমরা আমাদের কর্মীদের কথা শুনতে এসেছি, তা নিয়ে কেন্দ্রীয় সভায় আলোচনা হবে।”
কো চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশিদ ও সুনীল শুভ্র রায়কে বহিষ্কারের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “বহিষ্কার করাটা খুবই অনাকাঙ্ক্ষিত। এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হবে। তা নাহলে জাতীয় পার্টিকে ঐক্যবদ্ধ রাখা যাবে না।”
কাজী ফিরোজ রশিদ ও সুনীল শুভ রায়ের সভায় উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও তারা যাননি। বুধবার লিখিত বক্তব্য পাঠ করেছিলেন সাইদুর রহমান টেপা। তিনিও সভায় উপস্থিত হননি।
সাইদুরের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, শারীরিক অসুস্থতার কারণে সভায় যাননি তিনি।
আবার বহিষ্কার
ভোটের পর কো চেয়ারম্যান ফিরোজ রশীদ এবং সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য সুনীল শুভ রায়কে বহিষ্কার করেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান কাদের।
রবিবারের সভার পর আরও দুজনের বহিষ্কারাদেশ আসে। তারা হলেন- ঢাকা মহানগর উত্তরের সভাপতি এবং সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শফিকুল ইসলাম সেন্টু এবং কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান ইয়াহ ইয়া চৌধুরী।
এই দুজনই রবিবারের সভায় ছিলেন এবং চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন। তাদেরে বহিষ্কারের কারণ জানানো হয়নি দলটির দপ্তর থেকে আসা সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে।
সেন্টুকে বহিষ্কারের পাশাপাশি জাতীয় পার্টির ঢাকা মহানগর উত্তরের কমিটিও বিলুপ্ত করে দিয়েছেন কাদের।