জি এম কাদের ও মুজিবুল হক চুন্নুকে দলীয় পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হলেও দল থেকে বাদ দেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন বেগম রওশান এরশাদ। শুক্রবার এক অনুষ্ঠানে তিনি আরও জানিয়েছেন, জিএম কাদের ও মুজিবুল হক চুন্নু জাতীয় সংসদে জাতীয় পার্টির প্রতিনিধিত্ব করবেন। তারা সংসদে যোগ্যতার প্রমাণ দিতে পারবেন বলেও আশা প্রকাশ করেন নিজেকে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ঘোষণাকারী রওশন।
জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা এইচ এম এরশাদের মৃত্যুর পর পাঁচ বছর ধরে দলটিতে কোন্দল চলছে। একাংশের নেতৃত্বে রয়েছেন এরশাদের স্ত্রী রওশন, অন্য অংশের নেতৃত্বে ভাই জি এম কাদের।
গত ৭ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া নিয়ে পুরনো বিবাদ আবার মাথাচাড়া দেয়। এর জের ধরে ২৮ জানুয়ারি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও মহাসচিব মজিবুল হক চুন্নুকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে নিজেকে চেয়ারম্যান ঘোষণা করেন রওশন এরশাদ। তারপর থেকে দুই পক্ষ আলাদাভাবেই চলছে।
শুক্রবার বিকালে গুলশানে নিজ বাসভবনে জাতীয় মহিলা পার্টির নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় রওশন বলেন, “এর আগে যে দুজন পার্টির শীর্ষ পদে ছিলেন, তাদের ব্যর্থতার জন্য পার্টিতে বিপর্যয় নেমে এসেছিল। সেই দুই জনকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। দল থেকে তাদের বাদ দেওয়া হয়নি। তারা সংসদে জাতীয় পার্টির প্রতিনিধিত্ব করবেন।”
জাতীয় পার্টির যুগ্ম মহিলা বিষয়ক সম্পাদক শাহনাজ পারভীনের সভাপতিত্বে এ সভা হয়। সভায় আগামী ৯ মার্চ দলের ‘ঐতিহাসিক সম্মেলন’ হবে বলেও আশা প্রকাশ করেন রওশন।
সভায় আরও বক্তব্য রাখেন পার্টির এ অংশের কো-চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, মহাসচিব কাজী মামুনূর রশিদ, এরশাদের ছেলে রাহগির আল মাহি সাদ এরশাদ, প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী গোলাম সরোয়ার মিলন, ঢাকা মহানগর উত্তর জাপার আহ্বায়ক ও প্রেসিডিয়াম সদস্য শফিকুল ইসলাম সেন্টু এবং জাপার মুখপাত্র ও প্রেসিডিয়াম সদস্য সুনীল শুভরায়।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের পর দলটি ভাঙনের মুখে থাকলেও জাতীয় পার্টিতে কোনও বিভেদ নেই বলে মতবিনিময় সভায় দাবি করেন রওশন এরশাদ।
তিনি বলেন, “সর্বস্তরের নেতাকর্মী ঐক্যবদ্ধ আছে এবং থাকবে। পল্লীবন্ধু এরশাদের প্রতি অনুরক্ত নেতাকর্মীদের মধ্যে কোনও মতানৈক্য নাই। যারা পল্লীবন্ধুর নাম-নিশানা মুছে ফেলতে চায়, তারাই আলাদা হয়ে থাকতে পারে।”
নিজেকে চেয়ারম্যান ঘোষণাকারী রওশন এরশাদ নতুন সম্মেলনের ডাক দিয়ে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি রবিবার প্রস্তুতি কমিটিও গঠন করেন। জি এম কাদের পক্ষের মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু সেদিন নির্বাচন কমিশনে গিয়ে দলের নারী সংসদ সদস্য প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র জমা দেন।
রওশন এরশাদ বলেন, “আমি কোনোভাবেই পার্টিকে ছোটো করতে পারি না। তাই এরশাদভক্ত যাদের দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছিল, যাদের অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল, কিংবা যাদের বহিষ্কার করা হয়েছিল- আমি তাদের সবাইকে পল্লীবন্ধুর রেখে যাওয়া পতাকাতলে ফের নিয়ে এসেছি।”
ঐতিহাসিক সম্মেলন হতে যাচ্ছে জানিয়ে রওশন এরশাদ বলেন, “জাতীয় পার্টির অগণিত নেতাকর্মীর মনের যন্ত্রণা মোছানোর জন্যই আমাকে পার্টির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়েছে। ৯ মার্চ জাতীয় কাউন্সিলের মাধ্যমে পার্টি পরিচালনার জন্য যোগ্য নেতৃত্ব দায়িত্ব গ্রহণ করবে।”
সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদের গড়া জাতীয় পার্টির বহু নাটকের সাক্ষী বাংলাদেশ। তার মৃত্যুর পরও তা থেমে নেই। ২০১৯ সালে এরশাদের মৃত্যুর পর শুরুতেই গোল বেঁধেছিল দলের কর্তৃত্ব নিয়ে। ভাবি রওশন ও দেবর কাদেরের সেই বিরোধে দলটি ফের ভাঙনের উপক্রম হয়েছিল।
তবে সেই দফায় জ্যেষ্ঠ নেতাদের হস্তক্ষেপে দুজনের সমঝোতা হয়। তাতে দলে কর্তৃত্ব নিয়ে কাদের হন চেয়ারম্যান; আর একাদশ সংসদে বিরোধীদলীয় নেতার পদটিতে থেকে যান রওশন, পাশাপাশি দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক নামে পদ তৈরি করে তাকে দেওয়া হয় সেই পদ।
অশীতিপর রওশন অসুস্থতার জন্য দীর্ঘদিন বিদেশে থাকায় তাকে বিরোধীদলীয় নেতার পদ থেকে সরাতে তৎপরতা ছিল কাদের সমর্থকদের।
এর মধ্যে গত বছর দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া নিয়ে পুরনো বিবাদ আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তার এক পর্যায়ে রওশন ভোটে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত তো নেনই, জাতীয় পার্টির সঙ্গে জোট কিংবা আসন সমঝোতা না করতে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অনুরোধ করেছিলেন।
তবে তাকে উপেক্ষা করেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন সমঝোতা করে নির্বাচনে যান কাদের। তবে জিততে পারেন কেবল ১১টি আসনে। ফল বিপর্যয়ের পর জাতীয় পার্টির মধ্যে ক্ষোভ দানা বাঁধে। চেয়ারম্যান ও মহাসচিবের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের পর পাঁচ কেন্দ্রীয় নেতাকে বহিষ্কার করেন কাদের। বহিষ্কৃতদের সবার নিজস্ব জায়গায় ফিরিয়ে নেন রওশন।