প্রতিষ্ঠাতা এইচ এম এরশাদের জীবদ্দশায়ই জাতীয় পার্টি ভেঙেছিল কয়েক বার; তার মৃত্যুর পর নতুন করে ভাঙনের যে ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছিল, তা ফলে গেল রওশন এরশাদের নেতৃত্বে নতুন কমিটি গঠনের মধ্য দিয়ে।
প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ বর্তমান নেতৃত্বকে বাদ দিয়ে সম্মেলন করলেও দাবি করছেন, জাতীয় পার্টি ঐক্যবদ্ধ আছে।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে থেকে জাতীয় পার্টিতে কোন্দল চলছিল। তার একদিকে ছিলেন এরশাদের স্ত্রী রওশন, অন্যদিকে এরশাদের ভাই দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদের।
ভোটে দলের ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ ফলের পর কোন্দল আরও বাড়ে, তার ধারাবাহিকতায় আলাদা সম্মেলন ডাকেন রওশন।
শনিবার ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে সেই সম্মেলনে রওশন এরশাদকে চেয়ারম্যান ঘোষণা করা হয়। মহাসচিব হন কাজী মামুনুর রশীদ।
সম্মেলনের কাউন্সিল অধিবেশনে গঠিত নির্বাচন কমিশনের আহ্বায়ক গোলাম সারোয়ার মিলন চেয়ারম্যান পদে রওশনের নাম প্রস্তাব করেন। কাউন্সিলররা হাত তুলে সমর্থন জানালে মিলন বলেন, “এখন থেকে রওশন এরশাদ আমাদের দলের চেয়ারম্যান।”
এই কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ পদ পেয়েছেন এরশাদের ছেলে রাহগির আল মাহি এরশাদ (সাদ এরশাদ)। কো-চেয়ারম্যান করা হয়েছে তাকে। রওশনের অবর্তমানে তিনিই চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করবে বলে সম্মেলনে ঘোষণা দেওয়া হয়।
অন্যান্য পদের মধ্যে কাজী ফিরোজ রশিদ নির্বাহী চেয়ারম্যান, আবু হোসেন বাবলা সিনিয়র কো–চেয়ারম্যান, সাইদুর রহমান, শফিকুল ইসলাম, সাদ এরশাদ, গোলাম সরোয়ার মিলন ও সুনীল শুভরায়কে কো-চেয়ারম্যান ঘোষণা করা হয়েছে।
এই কমিটিতে পদধারী কেউ এখন সংসদে নেই। জাতীয় পার্টি থেকে যারা এবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন, তারা সবাই জি এম কাদেরের সঙ্গে। তিনি সংসদে প্রধান বিরোধীদলীয় নেতার আসনে রয়েছেন।
ওই অংশের মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেছিলেন, রওশনের নেতৃত্বে কারা কী করছে, তা নিয়ে তাদের কোনও মাথাব্যথা নেই।
জাতীয় পার্টি ‘ঐক্যবদ্ধ’
সম্মেলনের উদ্বোধন করে অশীতিপর রওশন বলেন, জাতীয় পার্টিকে ‘রক্ষার’ জন্যই এই সম্মেলন করছেন তিনি।
“আজ যদি এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত না হতো, তাহলে জাতীয় পার্টি হারিয়ে যেত। হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে আমরা হারিয়ে ফেলতাম। দেশের মানুষ জাতীয় পার্টির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিত।
“এই সম্মেলনের মাধ্যমে এরশাদের নীতি-আদর্শ এবং উন্নয়ন-সমৃদ্ধি ও সংস্কারের রাজনীতি পুনঃপ্রতিষ্ঠার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।”
সম্মেলনে সাবেক সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, “এরশাদের নাম ইতিহাস থেকে মুছে ফেলবেন না। এরশাদকে বাদ দিয়ে কোনও জাতীয় পার্টি বাংলার বুকে হবে না। আপনাদেরও (অন্য অংশ) আহ্বান করব, ঐক্যবদ্ধ হোন, দালালি করবেন না।”
জাতীয় পার্টিতে কোনও বিভেদ নেই দাবি করে রওশন বলেন, “আমরা এক আছি, ঐক্যবদ্ধ আছি এবং থাকব।
“অতীতে যারা পার্টি ছেড়ে গেছে, তারা কেউ পল্লীবন্ধু এরশাদের নীতি-আদর্শ নিয়ে যায়নি। এমনকি তারা পল্লীবন্ধুর ছবিও সাথে নেয়নি। তাই জাতীয় পার্টি কখনও ভেঙেছে, তা আমি মনে করি না।”
সম্মেলনের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে জাতীয় পার্টি ছেড়ে নতুন দল গঠনকারী জাতীয় পার্টি-জেপির মহাসচিব শেখ শহীদুল ইসলাম যোগ দেন।
আরও উপস্থিত ছিলেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি আব্দুল কাদের সিদ্দিকী, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির চেয়ারম্যান নাজিমুদ্দিন আল আজাদ, বাংলাদেশ ইসলামিক ফ্রন্টের চেয়ারম্যান এম এ মতিন।
জাতীয় পার্টিতে ভাঙন বারবার
সেনাপ্রধান থেকে অবৈধভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলকারী এইচ এম এরশাদ ১৯৮৬ সালে দলছুট একদল নেতাকে নিয়ে জাতীয় পার্টি গঠন করেন ।
১৯৯০ সালে গণঅভ্যুত্থানে এরশাদের পতনের পর অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে ৩৫টি আসনে বিজয়ী হয়ে চকম দেখায় দলটি।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারে অংশ নেওয়ার পর জাতীয় পার্টি প্রথম ভাঙনের মুখে পড়ে। সরকারের মাঝ পর্যায়ে এরশাদ বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটে যোগ দিলে তৎকালীন মহাসচিব আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বেঁকে বসেন।
সে সময়কার সরকারের মন্ত্রী মঞ্জু তখন আলাদা দল গঠন করেন। সেই দলের নাম জাতীয় পার্টি-জেপি। এই অংশের চেয়ারম্যান মঞ্জু ও মহাসচিব শেখ শহীদুল ইসলাম।
১৯৯৯ সালে এরশাদ চারদলীয় জোট ছেড়ে দিলে তখনকার মহাসচিব নাজিউর রহমান মঞ্জু আবার বেঁকে বসলে নতুন আরেকটি দল গঠন হয়, যারা চারদলীয় জোটে থেকে যায়। নাজিউরের নেতৃত্বাধীন সেই দলের নাম হয় বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপি। এর চেয়ারম্যান এখন নাজিউরপুত্র আন্দালিব রহমান পার্থ।
২০১৪ সালে দশম সংসদ নির্বাচনে এরশাদ অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিলে এক সময়ের মহাসচিব কাজী জাফর আহমেদ আলাদা দল গঠন করে বিএনপি জোটে থেকে যান। এই দলটির নাম জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর)। কাজী জাফরের মৃত্যুর পর এখন টিআইএম ফজলে রাব্বী দলটির চেয়ারম্যান এবং মোস্তফা জামাল হায়দার মহাসচিবের দায়িত্বে আছেন।
এদিকে পার্থ নেতৃত্বাধীন বিজেপি কয়েক বছর আগে বিএনপি জোট ছাড়ার ঘোষণা দিলে সেই অংশে ভাঙন দেখা যায়। তাতে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপি নামে আলাদা দল হয় দলটির এরশাদের সময়কার মন্ত্রী এ মতিনের নেতৃত্বে। বিএনপির সঙ্গে থাকা ওই জাতীয় পার্টির নেতৃত্ব দিচ্ছেন এখন মতিনপুত্র এম এ মুকিত।
এর বাইরে এরশাদের তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রী বিদিশা একবার আলাদা জাতীয় পার্টি গড়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন, তবে তার আর এগোয়নি।
বর্তমানে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত দলগুলোর মধ্যে জাতীয় পার্টি ভেঙে গঠিত চারটি দল রয়েছে। সেগুলো হচ্ছে জি এম কাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি (লাঙ্গল), আনোয়ার হোসেন মঞ্জু নেতৃত্বাধীন জেপি (বাইসাইকেল), পার্থ নেতৃত্বাধীন বিজেপি (গরুর গাড়ি) এবং মুকিত নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (কাঁঠাল)।