আঁচ টের পাওয়া যাচ্ছিল নির্বাচনের আগেই, ভোটের পর বেসামাল হয়ে পড়ল জাতীয় পার্টি। একের পর এক বহিষ্কার, তার পাল্টায় রওশন এরশাদের নিজেকে চেয়ারম্যান ঘোষণা, সেই ঘোষণাকে আমলে না নিয়ে মহাসচিবের কথা, শেষে সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে জি এম কাদেরের স্বীকৃতি- সব মিলিয়ে দেশের রাজনীতিতে নাটকীয় দিন গেল এরশাদের দলটিকে ঘিরে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে অস্থির জাতীয় পার্টিতে রবিবার সকালে একদল নেতা-কর্মীদের নিয়ে বৈঠক করেন দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন। এই সভায় দল থেকে সম্প্রতি বহিষ্কৃত এবং ভোটে অংশ নিয়ে পরাজিত প্রার্থীরা ছিলেন।
সেখানে রওশন নিজেকে দলের চেয়ারম্যান ঘোষণা করেন। সেই সঙ্গে জানান, জি এম কাদের ও মুজিবুল হক চুন্নু আর চেয়ারম্যান ও মহাসচিব পদে নেই। আর যাদের বহিষ্কার করেছেন কাদের, তাদের বহিষ্কারাদেশও তুলে নেওয়া হলো।
তার এই বৈঠকের পরপরই দলীয় চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের কার্যালয়ে সাংবাদিকদের ডেকে মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, রওশনের এই ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার কোনও এখতিয়ার নেই বলে তা ধর্তব্যেই আনছেন না তারা।
এদিকে বিকালে সংসদ সচিবালয় থেকে জানানো হয়, কাদের বিরোধীদলীয় নেতার স্বীকৃতি পেয়েছেন। দলটির সংসদ সদস্যরা আগেই কাদেরকে বিরোধীদলীয় নেতা করার আবেদন জানিয়ে রেখেছিলেন স্পিকারের কাছে।
এদিকে দলটির এক কেন্দ্রীয় নেতা জানিয়েছেন, সকালের ঘটনার পর আবার জি এম কাদেরকে ফোন করে তার মতো করে দল চালাতে বলেছেন রওশন।
সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদের গড়া জাতীয় পার্টির বহু নাটকের সাক্ষী বাংলাদেশ। তার মৃত্যুর পরও তা থেমে নেই।
২০১৯ সালে এরশাদের মৃত্যুর পর শুরুতেই গোল বেঁধেছিল দলের কর্তৃত্ব নিয়ে। ভাবি রওশন এবং দেবর কাদেরের সেই বিরোধে দলটি ফের ভাঙনের উপক্রম হয়েছিল।
তবে সেই দফায় জ্যেষ্ঠ নেতাদের হস্তক্ষেপে দুজনের সমঝোতা হয়। তাতে দলে কর্তৃত্ব নিয়ে কাদের হন চেয়ারম্যান; আর একাদশ সংসদে বিরোধীদলীয় নেতার পদটিতে থেকে যান রওশন, পাশাপাশি দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক নামে পদ তৈরি করে তাকে দেওয়া হয় সেই পদ।
অশীতিপর রওশন অসুস্থতার জন্য দীর্ঘদিন বিদেশে থাকায় তাকে বিরোধীদলীয় নেতার পদ থেকে সরাতে তৎপরতা ছিল কাদের সমর্থকদের।
এর মধ্যে গত বছর দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া নিয়ে পুরনো বিবাদ আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তার এক পর্যায়ে রওশন ভোটে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত তো নেনই, জাতীয় পার্টির সঙ্গে জোট কিংবা আসন সমঝোতা না করতে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আহ্বানও জানিয়েছিলেন।
তবে তাকে উপেক্ষা করেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন সমঝোতা করে নির্বাচনে যান কাদের। তবে জিততে পারেন কেবল ১১টি আসনে। ফল বিপর্যয়ের পর জাতীয় পার্টির মধ্যে ক্ষোভ দানা বাঁধে। চেয়ারম্যান ও মহাসচিবের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের পর চার কেন্দ্রীয় নেতাকে বহিষ্কার করেন কাদের। তাদের উদ্যোগেই রবিবার রওশনকে নিয়ে বৈঠক হয়।
চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিলাম: রওশন
গত কয়েকদিন ধরে শোনা যাচ্ছিল, রওশনের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি পুনর্গঠন হবে। বহিষ্কৃতরা যেমন এ ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন, তা ভিত্তি পাচ্ছিল যখন তাদের পক্ষ নিয়ে রওশনের বিবৃতি আসে।
গত ২২ জানুয়ারিতে দেওয়া বিবৃতিতে রওশন অবিলম্বে বহিষ্কৃতদের দলে ফিরিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তবে তার পরিপ্রেক্ষিতে কাদের বলেছিলেন, কে কী বলল, তাতে দলীয় সিদ্ধান্ত পাল্টাবে না।
এরপর রবিবার সকালে গুলশান-২ এর নিজের বাড়িতে দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে মতবিনিময় সভায় বসেন রওশন। সেখানে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “সঙ্কট নিরসনে পার্টির নেতা-কর্মীদের অনুরোধে এবং পার্টির গঠনতন্ত্রের ২০ এর ১ ধারায় বর্ণিত ক্ষমতাবলে আমি পার্টির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব থেকে জি এম কাদের ও মহাসচিব মজিবুল হক চুন্নুকে অব্যাহতি প্রদান করলাম।
“নেতা-কর্মীদের অনুরোধে আমি পার্টির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণ করলাম। পরবর্তী সম্মেলন না হওয়া পর্যন্ত আমি কাজী মো. মামুনুর রশিদকে মহাসচিবের দায়িত্ব প্রদান করলাম। তিনি সার্বিকভাবে সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করবেন।”
এই সভায় জাতীয় পার্টির শীর্ষ পর্যায়ের কোনও নেতাকে দেখা যায়নি। রওশনের সন্তান সাদ এরশাদ ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন বহিষ্কৃত তিন নেতা ভাইস-চেয়ারম্যান ইয়াহ ইয়া চৌধুরী, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য সুনীল শুভ রায় এবং ঢাকা মহানগর উত্তরের সভাপতি শফিকুল ইসলাম সেন্টু।
আমলেই নিচ্ছেন না চুন্নু
রওশনের ঘোষণার পরপরই জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু সংবাদ সম্মেলন করেন বনানীতে দলের চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে।
রওশনের ঘোষণাকে যে কতটা হালকাভাবে নিচ্ছেন, তা বুঝিয়ে তিনি বলেন, “উনি যে চেয়ারম্যান-মহাসচিবকে বাদ দিয়েছেন, এনিয়ে তা তৃতীয়বার। এর আগেও উনি দুইবার নিজেকে চেয়ারম্যান ঘোষণা করে বাদ দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে আবার প্রত্যাহার করেছিলেন এই বলে যে তার ঘোষণাটা ঠিক না।”
চুন্নু বলেন, জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী চেয়ারম্যান বা মহাসচিবসহ দলের কোনও নেতা-কর্মীকেই প্রধান পৃষ্ঠপোষক দল থেকে বাদ দিতে পারেন না।
“প্রত্যেকটা দলের একটা গঠনতন্ত্র আছে, নিয়ম আছে। আমাদের গঠনতন্ত্রে এমন কোনও ধারা নাই যাতে দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক পদধারী দলের চেয়ারম্যান, মহাসচিব বা অন্য কাউকে দল থেকে বাদ দিতে পারেন।
“এই ধরনের কোনও ক্ষমতা তার নাই। গঠনতন্ত্রের বাইরে মনের মাধুরী মিশিয়ে যে কোনও ব্যক্তি যে কোনও কথা বলতেই পারে। এসব কথার কোনও ভিত্তি নাই।”
সেক্ষেত্রে রওশনের এমন পদক্ষেপের কারণে দল থেকে তার বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না- সেই প্রশ্ন রাখা হয় চুন্নুর কাছে।
তিনি বলেন, “বেগম রওশন এরশাদ আমাদের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যানের স্ত্রী। শ্রদ্ধা থেকেই তাকে জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক করা হয়। প্রধান পৃষ্ঠপোষকের দলীয় সিদ্ধান্তের ব্যাপারে কোনও রকম ক্ষমতা নাই, সুযোগ নাই।
“এটা একটা অলংকারিক পদ। অলংকারিক পদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন আছে বলে আমরা মনে করি না।”
গঠনতন্ত্র কী বলে
রওশন জাতীয় পার্টি থেকে চেয়ারম্যান-মহাসচিবকে অব্যাহতি দেওয়ার বিষয়ে গঠনতন্ত্রের ২০(১) ধারার ক্ষমতা প্রয়োগ করেছেন বলে জানান।
দলটির গঠনতন্ত্রের ২০(১) ধারাটিতে বলা আছে, প্রধান পৃষ্ঠপোষক পার্টির সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী হবেন। পার্টির কোনও জনসভায় তিনি উপস্থিত থাকলে চেয়ারম্যানের উপরে তার স্থান হবে। জাতীয় ও দলীয় যে কোনও বিষয়ে প্রয়োজন মনে করলে চেয়ারম্যান তার পরামর্শ নেবেন।
এ ধারা অনুযায়ী কীভাবে রওশন এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন- তা জানতে চাইলে তার সমর্থক নেতাদের কাছ থেকে সদুত্তর পাওয়া যায়নি।
এরশাদের গড়া এই দলে চেয়ারম্যানের রয়েছে অসীম ক্ষমতা। এরশাদ সেই পদে থাকাকালে তার ইচ্ছা অনুযায়ীই সব সিদ্ধান্ত নিতেন তিনি।
শেষ পর্যন্ত জিএম কাদেরই বিরোধীদলীয় নেতা
বিএনপিবিহীন দশম সংসদে রওশন বিরোধীদলীয় নেতা হয়েছিলেন। একাদশ সংসদেও তিনি ছিলেন একই পদে। তবে বিবাদের মধ্যে একাদশ সংসদে কাদেরকে বিরোধীদলীয় নেতা করতে স্পিকারকে চিঠি দিয়েছিলেন জাতীয় পার্টির একদল সংসদ সদস্য। তবে শেষমেষ রওশন এরশাদই থেকে যান বিরোধীদলীয় নেতার আসনে।
জি এম কাদেরের সেই অপূর্ণ আশা এবার পূরণ হল। দ্বাদশ জাতীয় সংসদে এসে বিরোধীদলীয় নেতার চেয়ারটি পেলেন তিনি।
স্বতন্ত্র না জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যরা বিরোধী দলের আসনে বসতে যাচ্ছেন, তা নিয়ে আলোচনার মধ্যে অধিবেশন শুরুর দুদিন আগে রবিবার বিকালে সংসদ সচিবালয় থেকে গেজেট প্রকাশিত হয়।
তাতে জানানো হয়, কাদেরকে বিরোধীদলীয় নেতা করার পাশাপাশি জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদকে বিরোধীদলীয় উপনেতা মনোনীত করেছেন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী।
সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা মন্ত্রীর মর্যাদা পান। কাদের ও আনিসুল দুজনই শেখ হাসিনার সরকারে মন্ত্রী হয়েছিলেন একবার।
কাদেরকে রওশনের ফোন
রওশন নিজেকে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ঘোষণার পর আবার দেবর জি এম কাদেরকে ফোন দিয়েছিলেন বলে দলটির এক কেন্দ্রীয় নেতা জানিয়েছেন।
রওশন সমর্থক ওই নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আপার এগুলো করার ইচ্ছা ছিল না। তিনি সাংবাদিক সম্মেলনের পর কথা বলেছেন জি এম কাদেরের সাথে। তিনি তাকে বলেছেন, এতগুলো নেতা-কর্মী তাকে ঘিরে ধরেছে, তাদের আপাতত শান্ত করার জন্য তিনি এটা করেছেন। জি এম কাদেরকে তার মতো করে দল পরিচালনার কথা বলেছেন।”
এই বিষয়ে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হলেও তার মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।