অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদারে চার বছর পর আবারও চীনে গেলেন জাপানের শীর্ষ ব্যবসায়ীরা, যা নতুন সূচনার মধ্যবর্তী উদ্যোগ বলে মনে করা হচ্ছে।
বৃহস্পতিবার চীনে গেছেন অন্তত ২০০ জাপানি ব্যবসায়ী নেতা ও সিইওদের একটি প্রতিনিধি দল।
কয়েক বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র-চীন ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের জেরে চীন-জাপান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কেও টানাপোড়েন চলছিল। এ পরিস্থিতির মধ্যেই এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র জাপানের ব্যবসায়ী নেতারা এই চীন সফর করছে।
১৯৭৫ সাল থেকে প্রতি বছরই চীন সফর করে আসছিলেন জাপানের ব্যবসায়ী নেতারা। কিন্তু কোভিড-১৯ মহামারীর সময় চীনের কঠোর নীতির কারণে তাতে ছেদ পড়ে। মহামারীর সময় চীন তার সীমান্ত বন্ধ করে দেয়। নিজের নাগরিকদের বিদেশে যাওয়া বা বিদেশি নাগরিকদের আসার ওপরও কড়াকড়ি আরোপ করে দেশটি।
সমুদ্রে পারমাণবিক তেজস্ক্রিয় বর্জ্য পানি নিঃসরণ থেকে শুরু করে গোয়েন্দাগিরির অভিযোগে চীনে জাপানি নাগরিকদের আটকসহ নানা কারণেও চীন-জাপান সম্পর্কে অবনতি ঘটে।
এছাড়া চীনে উন্নতমানের চিপ তৈরির সরঞ্জাম রপ্তানিতে জাপানের নিষেধাজ্ঞাও দেশ দুটির সম্পর্কে অবনতির বড় কারণ। চীন অভিযোগ করে, জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদার সরকার চীনের অর্থনৈতিক উন্নতিতে বাধা সৃষ্টি করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের পদাঙ্কই অনুসরণ করছে।
তবে গত নভেম্বরে কিশিদা ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের মধ্যে এক বিরল বৈঠক হয়। সেই বৈঠকে তারা সম্মত হন যে, চীন-জাপানের মধ্যে পরস্পরের জন্য উপকারী সম্পর্ক থাকা উচিৎ। ওই বৈঠকের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতেই জাপানের ব্যবসায়ী নেতারা ফের চীন সফরে গেলেন।
জাপানের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন কেইদানরেন, জাপান চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (জেসিসিআই) ও জাপান-চীন ইকোনমিক অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধিরা বৃহস্পতিবার চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াংয়ের সঙ্গে দেখা করেছেন।
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ওয়াং ওয়েনবিন বৃহস্পতিবার নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াং বলেছেন, চীন-জাপান সম্পর্ক এখন অতীতের ধারাবাহিকতা রক্ষা এবং ভবিষ্যতের নতুন সূচনার মধ্যবর্তী এক জটিল সময় পার করছে।”
ওয়েনবিন বলেন, “জাপানের ব্যবসায়ী নেতারা চীন ও জাপানের মধ্যে পরস্পরের জন্যই সুবিধাজনক হবে এমন সহযোগিতার উদ্যোগ নেবেন বলে আশা করা হচ্ছে।”
জাপান চীনের উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। অন্যদিকে, জাপানি কোম্পানিগুলোও বছরের পর বছর ধরে চীনের উৎপাদন সাপ্লাই চেইন তৈরিতে বিনিয়োগ করেছে এবং দেশটির স্থানীয় অংশীদারদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করেছে।
২০২২ সালে চীন জাপানের শীর্ষ রপ্তানি বাজার ও আমদানির একক বৃহত্তম উৎস ছিল। সে বছর চীনের রপ্তানি থেকে জাপানের আয় হয় ১৪৫ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে, চীন থেকে জাপানের আমদানি ছিল ১৮৯ বিলিয়ন ডলারের।
তবে গত বছরের শেষদিকে প্রকাশিত এক বার্ষিক জরিপে দেখা যায়, চীনে ব্যবসা বাড়ানোর পরিকল্পনাকারী জাপানি কোম্পানির সংখ্যা প্রথমবারের মতো ৩০ শতাংশের নিচে নেমেছে। কিছু কোম্পানি এর কারণ হিসেবে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা নিয়ে উদ্বেগ ও বাকিরা ভূ-রাজনৈতিক ঝুঁকির কথা বলেছে।
গত বছর গোয়েন্দাগিরি করার সন্দেহে চীন জাপানের ওষুধ কোম্পানি অ্যাস্টেলাস ফার্মার এক নির্বাহী কর্মকর্তাকে আটক করেছিল। জাপানের কর্মকর্তারা বলছেন, চীনের এই পদক্ষেপও দুদেশের ব্যবসায়িক সম্পর্কে শীতল প্রভাব ফেলেছে।
চীনের মুখপাত্র ওয়াং ওয়েনবিন বলেছেন, “চীনের সব আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও বিচারিক কার্যক্রম বাস্তব সাক্ষ্য-প্রমাণ ও আইনের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়।
“বিদেশি কোম্পানিগুলো আইন অনুযায়ী চললে কোনও সমস্যা নেই। আমরা জাপানসহ সব দেশের কোম্পানিকে স্বাগত জানাই।”
স্থানীয় কোম্পানিগুলোর প্রতিযোগিতা, চীনের অনিশ্চিত অর্থনীতি ও জাপানের ফুকুশিমা পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্র থেকে সমুদ্রে বর্জ্য পানি ফেলা নিয়ে দুদেশের মধ্যে বিরোধ আছে। এর জেরে জাপানিদের মধ্যে নেতিবাচক মনোভাবের কারণে চীনে জাপানি কোম্পানিগুলোর বিক্রিও কমছে।
চীনের স্থানীয় ইলেকট্রিক গাড়ি নির্মাতাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে টয়োটা ও নিশানের মতো বিখ্যাত জাপানি কোম্পানিগুলো। এতে চীনের পুঁজিবাজারে তাদের শেয়ারদরেও বড় পতন ঘটছে।
সূত্র : রয়টার্স