তথ্য সংরক্ষণে ষাটের দশকের যুগান্তকারী আবিষ্কার ছিল ফ্লপি ডিস্ক। রাতারাতি তথ্য এক স্থান থেকে আরেক স্থানে স্থানান্তরের ক্ষেত্রে ব্যাপক গতি পেয়েছিল এর আবিষ্কার।
বেশ কয়েক দশক ধরে চলে ফ্লপি ডিস্ক। কিন্তু নব্বইয়ের দশকের পর থেকে সিডি, ডিভিডি, মেমোরি কার্ড, ইউএসবি স্টোরেজ থেকে শুরু করে ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার কারণে ফ্লপি ডিস্ক গ্রহণযোগ্যতা হারাতে শুরু করে। এক পর্যায়ে এর ব্যবহার প্রায় বন্ধ হয়ে যায়, গুটি কয়েক ক্ষেত্র ছাড়া।
ফ্লপি ডিস্কের ব্যবহার চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে একমাত্র ব্যতিক্রমী দেশ ছিল জাপান। গত মাস পর্যন্ত দেশটির জনগণকে সরকারি কোনও নথি জমা দিতে হলেও ফ্লপি ডিস্ক ব্যবহার করতে হতো।
জাপানের ডিজিটাল মন্ত্রী তারো কোনোর নিরলস চেষ্টার ফলে সম্প্রতি আনুষ্ঠানিকভাবে ফ্লপি ডিস্কের ব্যবহার বন্ধ করা হয়েছে। মজার বিষয় হলো, ফ্লপি ডিস্ক ব্যবহার অব্যাহত রাখতে দেশটিতে এক হাজারের বেশি সরকারি বিধিমালা ছিল।
নতুন সিদ্ধান্তের ফলে এসব বিধিমালা এখন বাতিল হয়ে গেল।
মূলত ২০২১ সাল থেকেই ফ্লপি ডিস্ক ব্যবহার বন্ধের প্রক্রিয়া শুরু করেন তারো কোনো। টানা তিন বছরের লড়াইয়ের পর গত বুধবার তিনি ঘোষণা দেন, “ফ্লপি ডিস্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধে শেষমেষ আমরা জিতেছি।”
ডিজিটাল মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর থেকেই তারো কোনো পুরনো প্রযুক্তি বাদ দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। ফ্লপি ডিস্ক ছাড়াও তিনি ফ্যাক্স মেশিন বাতিলের পক্ষেও একাধিকবার আওয়াজ তুলেছেন।
বিশ্বে একটা সময় নতুন প্রযুক্তির কেন্দ্রবিন্দু ছিল জাপান। কিন্তু পরিবর্তনের প্রতি অনীহার কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ডিজিটাল রূপান্তরের বৈশ্বিক প্রবাহে দেশটি পিছিয়ে পড়েছে।
দেশটির সরকারি দপ্তরগুলোতে এখনও ইমেইলের পরিবর্তে ফ্যাক্স মেশিন ব্যবহার করা হয়। সরকারি দপ্তর থেকে এসব যন্ত্র সরিয়ে ফেলার একটি পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কিন্তু প্রতিবাদের মুখে সেই পরিকল্পনা বাতিল হয়ে যায়।
ফ্লপি ডিস্ক বাতিলের ঘোষণাটি জাপানের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। সোশাল মিডিয়া এক্সে একজন ফ্লপি ডিস্ককে ‘অনুন্নত প্রশাসনের প্রতীক’ বলে অভিহিত করেছেন।
আরেকজন এক্সে লেখেন, “সরকার এখনও ফ্লপি ডিস্ক ব্যবহার করে? এটাতো অনেক পুরনো… মনে হয় সেখানে শুধু বৃদ্ধরাই কাজ করেন।”
কয়েকজন আবার কিছুটা স্মৃতিকাতর পোস্টও করেছেন এ নিয়ে। তাদেরই একজন লেখেন, “ফ্লপি ডিস্ক কি এখন নিলামঘরেও পাওয়া যাবে?”
সাড়ে তিন ইঞ্চি আকারের একটি ফ্লপি ডিস্কে মাত্র ১ দশমিক ৪৪ মেগাবাইট তথ্য সংরক্ষণ করা যেত। সেই হিসাবে ৩২ গিগাবাইট তথ্য সংরক্ষণ করতে ২২ হাজারের বেশি ফ্লপি ডিস্ক লাগত।
ফ্লপি ডিস্কের শেষ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সনি ২০১১ সালে এর উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে।
সরকারি দপ্তরগুলোকে ডিজিটাল করতে জাপান ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে একটি ডিজিটাল এজেন্সি চালু করে। এর প্রধান হলেন তারো কোনো।
তবে জাপানের ডিজিটালাইজেশনের চেষ্টা বাস্তবায়ন, ধারণার চেয়েও কঠিন হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
সরকারের পর্যায়ক্রমে বাদ দেওয়ার চেষ্টা সত্ত্বেও দেশটির অধিকাংশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এখনও ‘হ্যাঙ্কো’ নামক ব্যক্তিগত সিলমোহর ব্যবহার করে। এ দিয়ে তারা সরকারি নথি অনুমোদন করে।
স্থানীয় সংবাদপত্র দ্য জাপান টাইমসের মতে, জাপানের জনগণ শম্ভুক গতিতে এই সিলমোহর ব্যবহার বন্ধ করছে।
২০১৯ সাল পর্যন্ত দেশটির শেষ পেজার পরিষেবা বন্ধ করা যায়নি। কারণ এর শেষ ব্যবহারকারী বলেছিলেন যে, তার বয়স্ক মায়ের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য এটিই ছিল তা পছন্দের পদ্ধতি।
তবে জাপান আনুষ্ঠানিকভাবে ফ্লপি ডিস্কের ব্যবহার বন্ধ করলেও বোয়িং ৭৪৭এস ও ৭৬৭এস এবং এয়ারবাস এ৩২০এস এখনও নেভিগেশন সংক্রান্ত তথ্য হালনাগাদের জন্য এর ব্যবহার করে। এছাড়া সিটি স্ক্যানার ও আলট্রাসাউন্ড যন্ত্র ও সান ফ্রান্সিসকোর সাবওয়ে ব্যবস্থাপনা বিভাগেও ফ্লপি ডিস্কের ব্যবহার রয়েছে।
ব্যক্তিগত পর্যায়েও কেউ কেউ ফ্লপি ডিস্ক এখনও ব্যবহার করেন। এক্ষেত্রে তাদের যুক্তি হলো, ফ্লপি ডিস্ক হ্যাক করা যায় না, এতে তথ্য সুরক্ষিত থাকে।
তথ্যসূত্র : বিবিসি, জেডনেট