গত কয়েক বছরে জাপানি ফিকশন বইয়ের চাহিদার ‘বুম’ হয়েছে। ইউরোপ তো বটেই বাংলাদেশের মতো একটি বই বিমুখ দেশেও জাপানি ফিকশন বইয়ের অনুবাদ দেদারসে বিক্রি হচ্ছে।
২০২২ সালে নিলসেন বুকস্ক্যান জরিপ চালিয়ে দেখেছে, যুক্তরাজ্যে বিক্রি হওয়া মোট অনুবাদ ফিকশন বইয়ের ২৫ শতাংশই জাপানি। এই বছরের পরিসংখ্যান আরও বেশি চমকে দেওয়ার মতো। ব্রিটিশ পত্রিকা গার্ডিয়ান বলছে, ২০২৪ সালে এখন পর্যন্ত অনুবাদ হওয়া ৪০টি সর্বাধিক বিক্রিত ফিকশন বইয়ের ৪৩ শতাংশই জাপানি লেখকদের বই।
জাপানি লেখিকা আসাকু ইউজুকির বিদ্রুপাত্মক, সামাজিক অপরাধমূলক উপন্যাস ‘বাটার’ রয়েছে বিক্রির শীর্ষে। এ উপন্যাসে বর্ণনা করা হয়েছে, কীভাবে একজন সাংবাদিক এবং একজন পাচক জোট বেঁধে খুনি হয়ে ওঠেন। এ বছর ‘বুকস আর মাই ব্যাগ’ পাঠক পুরস্কারও পেয়েছে ‘বাটার’। এ পুরস্কারটি বই বিক্রেতা এবং পাঠকদের ভোটের ওপর ভিত্তি করে দেয়া হয়।
যদিও জাপানি ফিকশন বইয়ের জনপ্রিয়তার ইতিহাসটি বেশ পুরানো, ১৯৯০ দশক থেকে শুরু। এর পেছনে রয়েছে দুইজন লেখকের অবদান। এদের একজন পৃথিবীবিখ্যাত ঔপন্যাসিক হারুকি মুরাকামি। জাপানি এই লেখক জাপানের বাইরে ব্রিটেনসহ ইউরোপের দেশগুলোতে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন যখন তার ‘উইন্ড-আপ বার্ড ক্রোনিকাল’ উপন্যাসটি ১৯৯৮ সালে বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা হারভিল প্রেস প্রকাশ করে।
২০০০ সালে ব্রিটিশ খুচরা বই বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান ওয়াটারস্টোন এর ক্রয় বিভাগের প্রধান ছিলেন স্কট প্যাক। তিনি মুরাকামির বড় ধরনের ভক্ত ছিলেন। সেই সময়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে স্কট বলেন, “(মুরাকামি) মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন। যখনই তার কোনও বই আসতো, আমরা সেটির জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়তাম।“ এই বছর মুরাকামির ১৫তম উপন্যাস ‘দ্য সিটি অ্যান্ড ইটস আনসারটেইন ওয়ালস’ প্রকাশ হয়েছে।
উপন্যাসটিতে একজন ব্যক্তি তার পছন্দের নারীর সন্ধানে রহস্যময় এক দেয়ালঘেরা শহরে প্রবেশ করে। হঠাৎই সে নিজেকে আবিষ্কার করে লাইব্রেরি, ম্যাপ ও স্বপ্নের দুনিয়ায়।
কিন্তু মুরাকামির উপন্যাসগুলোর নিঃসঙ্গ মূল চরিত্রের সঙ্গে জ্যাজ মিউজিক, বিড়াল এবং কল্পনার জগত মিলে একটি নতুন পরিবেশ তৈরি হয়। প্রশ্ন হলো- এগুলোর সাফল্যের কারণ কী?
স্কট প্যাকের ভাষায়, “খুব সহজেই তার উদ্ভট উপন্যাসগুলোর মধ্যে ঢুকে পড়া যায়।”
তবে তিনি একথাও স্মরণ করিয়ে দেন, মুরাকামির আগে আরেক জাপানি ফিকশন লেখিকা বানানা ইশোমিতো এই পথ তৈরি করে গিয়েছেন।
স্কট বলেন, “১৯৮০ এর দশকের শেষ নাগাদ এবং ৯০ দশকের শুরুতে ইশোমিতোর বই ইংরেজিতে অনুবাদ হতে থাকে। এর মধ্যে তার লেখা বিখ্যাত উপন্যাস ‘কিচেন অ্যান্ড লিজার্ড’ ছিল। ইশোমিতোর লেখায় বেশিরবাগ ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্ন ও একাকিত্বে থাকা কোনও নারী চরিত্রকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে, যারা তাদের ব্যক্তগত জীবনের ট্র্যাজেডি থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করে।“
মুরাকামি ও ইশোমিতোর মধ্যে বেশকিছু মিল রয়েছে। জাপানি নোবেল বিজয়ী ঔপন্যাসিক কেনজাবুরো ওয়ে ১৯৯০ দশকের এক নিবন্ধে তাদের লেখার সমালোচনায় লিখেছেন, “তাদের লেখা এমন একটি তরুণ প্রজন্মের অভিজ্ঞতার কথা বলে যারা রাজনৈতিকভাবে নিষ্ক্রিয় বা আক্রান্ত নয়, বয়োসন্ধি বা এর পরের সময়ের সাব-কালচারে যারা আটকে আছে।”
বিচ্ছিন্নতাবাদ, সুররিয়্যালিজম (অধিবাস্তববাদ), সামাজিক আকাঙ্ক্ষাকে এড়িয়ে চলা- এই সময়ের জাপানি বেস্ট সেলিং উপন্যাসগুলোর উপজীব্য। কিন্তু জাপানি লেখকদের উপন্যাসে এসব এই প্রবণতা মাত্র গত দশকে প্রবলভাবে তৈরি হয়েছে।
এই সময়ে জাপানি অপরাধমূলক উপন্যাসের রমরমা চলছে। সেটি ক্ল্যাসিক কিংবা নতুন- যাই হোক না কেন।
ইউজুকির ‘বাটার’ উপন্যাসের পাশাপাশি লেখক সেইচো মাৎসুমোতোর ক্ল্যাসিক উপন্যাসও অনুবাদকৃত সেরা ২০টি বইয়ের তালিকার শীর্ষে রয়েছে বলে জাপানি পত্রিকা ‘টোকিও এক্সপ্রেস’ জানিয়েছে।
জাপানি কথাসাহিত্যিকদের উপন্যাসের চাহিদাও বেড়েছে। বিশেষ করে নারীদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে লেখা উপন্যাসগুলোর দেদারসে কাটতি বাড়ছে। আর এক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিচ্ছেন সায়াকা মুরাতা, হিরোমি কাওয়াকামি এবং মিয়েকো কাওয়াকামি।
এর মধ্যে ২০১৮ সালে মুরাতার ‘কনভিনিয়েন্স স্টোর উইমেন’ প্রকাশ একটি টার্নিং পয়েন্ট ছিল বলে মত দিয়েছেন বিখ্যাত প্রকাশনী গ্রান্টার সহকারী প্রকাশনা পরিচালক জেসন আর্থার। এই উপন্যাসটি ৩৬ বছর বয়সী এক নারীকে কেন্দ্র করে এগিয়েছে, যিনি শারীরিকভাবে অসুস্থ, কিন্তু ছোট একটি দোকানে সুখি সুখি ভাব নিয়ে কাজ করেন। গ্রান্টা প্রকাশিত মুরাতার তিনটি উপন্যাসের এটি ছিল প্রথম । বাকি দুইটি উপন্যাস ‘আর্থলিংস’ ও ‘লাইফ সেরিমোনি’।
এই দুইটি বই ইতিমধ্যে ৫ লাখের বেশি কপি বিক্রি হয়েছে ।
মুরাতাকে ‘ফেনোমেনা’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন প্রকাশক জেসন।
“জাপানি উপন্যাস বিক্রিতে ‘কনভিনিয়েন্স স্টোর উইমেন ‘- এর অবদান অনস্বীকার্য। এটি বিক্রির দিক থেকে রীতিমত বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে, যা উপেক্ষা করার মতো নয়“, সহমত জানিয়ে বলেন অ্যালিসন ফিঞ্চার, যিনি জাপানিজ সাহিত্য বিষয়ক ওয়েবসাইট ‘রিড জাপানিজ লিটারেচার’ চালান এবং সাহিত্য বিষয়ক পডকাস্ট করেন।
মুরাতার উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদক জিনি তাপলে তাকেমরি, যিনি ২০ বছর ধরে টোকিওতে থাকছেন। মুরাতার বইয়ের সাফল্য নিয়ে তার মন্তব্য- ‘সত্যিই চমকপ্রদ’।
পাঠকদের অনেকেই ‘কনভিনিয়েন্স স্টোর উইমেনে’র মূল চরিত্রকে অটিজমে আক্রান্ত মনে করলেও জিনি তাপলে বলেন, “এই চরিত্র তা নয়, কিন্তু কেউ যদি এইভাবে দেখেন তাহরে মারাতা সায়াকার খুব একটা আপত্তি নেই। তিনি আসলে তার উপন্যাস দিয়ে দেখিয়েছেন যা আমরা ‘টেকেন ফর গ্র্যান্টেড’ (চাইলে পাওয়া যায়) বলে স্বাভাবিকভাবে ধরে নিই, সেটা আসলে একেবারেই স্বাভাবিক নয়।”
তাকেমরির আরও দুই অনুবাদক- লুসি নর্থ’ এবং অ্যালিসন মার্কিন পাওয়েলকে সঙ্গে নিয়ে ‘স্ট্রং উইমেন, সফটপাওয়ার’ নামের একটি গ্রুপ বানিয়েছেন জিনি তাপলে। তারা আরও বেশি জাপানি নারীদের লেখা বই ইংরেজিতে অনুবাদ করার ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। যদিও অনেক পথ পেরোতে হবে।
২০২৩ সালে জাপানি পুরুষ ও নারী লেখকদের সমান সংখ্যক বই অনুবাদ করা হয়েছিল। ২০২৪ সালে এমনটি নয়।
ইদানিং জাপানি লেখিকাদের উপন্যাসের প্রতি মানুষের আগ্রহ বেড়েছে। প্রকাশকরা আগে হারুকি মুরাকামির মতো বই চাইতেন। এখন তারা মুরাতার মতো বই চান। তবে, সাফল্যের ওপর এমন জোর দেওয়ার ফলে অনেক সময় প্রকৃত সৃজনশীলতাকে পাশ কাটিয়ে জনপ্রিয় থিম অনুকরণ করা হয়।
অনেক জনপ্রিয় জাপানি উপন্যাসকে ‘হিলিং’(প্রশান্তিমূলক) বা ‘হার্টওয়ার্মিং’ (হৃদয়ের উষ্ণতামূলক) হিসেবে দেখা হচ্ছে। সোজাসাপ্টা এসব উপন্যাসকে ‘কমফোর্ট বুকস’ জনরায় ফেলা যায়।
এই উপন্যাসগুলোর উপজীব্য থাকে প্রায়ই কফি শপ (যেমন- তোশিকাজু কাওয়াগুচির উপন্যাস ‘বিফোর দ্য কফি গেটস কোল্ড’), বইয়ের দোকান ও লাইব্রেরি (মিচিকো আয়োমার উপন্যাস ‘হোয়াট ইউ আ লুকিং ফর ইজ ইন দ্য লাইব্রেরি’) এবং বিড়াল (মাকাতো সিনকাইয়ের উপন্যাস ‘শি অ্যান্ড হার ক্যাট’) । এই বইগুলোর রিভিউ বা সমালোচনা হয় না। তবে খুব ভালো বিক্রি হয়- ৫ লাখ কপিরও বেশি।
জাপানি এই ‘কমফোর্ট বুকস’ প্রকাশের ক্ষেত্রে যুক্তরাজ্যের প্রকাশকদের মধ্যে ‘ডাবলডে’ সবচেয়ে এগিয়ে। এ প্রতিষ্ঠানটির ডেপুটি প্রকাশক জেন লসন, যিনি জাপানেই বড় হয়েছেন। যখন তিনি জুনিয়র এডিটর হিসেবে কাজ করতেন তখন কেবল জাপানি ফিকশন বই সম্পাদনার ব্যাপারেই তার আগ্রহ বেশি ছিল। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, “আমি যখন ‘দ্য গেস্ট ক্যাট’ বইটির একটি কপি হাতে পাই, তখন আমি সিদ্ধান্ত নিই এরকম একটি বই প্রকাশ করবো।“
২০০১ সালে প্রকাশিত লেখক তাকাশি হিরাইদের লেখা ওই উপন্যাসটি সে বছর জাপানের ‘বেস্ট সেলার’ ছিল।
২০১৭ সালে জেন লসন আরেক জাপানি লেখক হিরো আরিকাওয়ার ‘দ্য ট্রাভেলিং ক্যাট ক্রোনিক্যালস’ বইটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। যেটি ১০ লাখ কপিরও বেশি বিক্রি হয়।
লসন বলেন, ‘কমফোর্ট’ জনরার সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, এটি বিভাজন দূর করে দেয়। তরুণ এবং বৃদ্ধ- দুই ধরনের পাঠকেরই এর প্রতি আগ্রহ রয়েছে।
“পাওলো কোয়েলহোর ‘দ্য অ্যালকেমিস্ট’- এর মতো, এই বইগুলোর গুণগত মান আগে থেকেই ছিল। কিন্তু ইনস্টাগ্রাম এবং বুকটোক এগুলোকে আরও সংহত ও প্রশান্তিকর মাত্রা দিয়েছে।“
লসন স্বীকার করেন কিছু পাঠক ‘কমফোর্ট’ জনরার প্রতি বিশেষ নিয়ে বিড়াল কেন্দ্রিক লেখা দেখলে নাক সিঁটকায়। কিন্তু তাতে তার কিছু যায় আসে না, কেননা এই বইগুলোর বিক্রি খুবই ভালো।
তবে সম্ভবত সুনির্দিষ্ট কোনও বইয়ের নাম দেখে পাঠকরা বিরক্ত হন- সেটি নয়। বরং তাদের এই নাক সিঁটকানোর ব্যাপার তৈরি হয় এই কারণে যে, একটি সফল বইয়ের নাম নকল করে আরও অনেক প্রকাশক সেটির কোনও কাছাকাছি নাম দিয়ে রাতারাতি বই প্রকাশের প্রতিযোগিতায় নামেন।
এ প্রসঙ্গে লিটারেরি এজেন্ট ও পশ্চিম এশিয়ার সাহিত্য বিশেষজ্ঞ লি কাঙ্গিঙ তার এজেন্সির বিক্রি করা একটি নন-ফিকশন বইয়ের উদাহরণ টেনে নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, “বইটি যখন জাপানি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করা হলো, তখন এর নাম একেবারে বদলে দিলেন ব্রিটিশ প্রকাশক। এর শিরোনাম হলো- ‘দ্য বুকশপ উইমেন’, যাতে এটি শুনতে কিছুটা ‘কনভিনিয়েন্স স্টোর উইমেন’ এর মতো লাগে।“
লি কাঙ্গিঙ- এর জানামতে, বইটি বেশ ভালো বিক্রি হচ্ছে!
বইয়ের প্রচ্ছদে বিড়ালের মোটিফ থাকাটাও বই বিক্রি বাড়িয়ে দিচ্ছে। বুক ব্লগার এবং ফিকশন এনথুয়াজিস্ট টনি মেলন বলছেন, উপন্যাসে বিড়াল থাকলেই সেটি দুরন্ত গতিতে বিক্রি হয়।
সম্প্রতি তিনি সাতোশি ইয়াগিসাওয়ার ‘ডেজ অ্যাট দ্য মোরাসাকি বুকশপ’ এর ইংরেজি অনুবাদ পড়েছেন, যা ২০২৪ সালে যুক্তরাজ্যে অনূদিত উপন্যাস বিক্রির তালিকায় শীর্ষের দিক থেকে পঞ্চম স্থানে রয়েছে। তিনি জানান, এই বইটির প্রচ্ছদে বিড়ালের ছবি থাকলেও, ভেতরে কোনও বিড়ালের কাহিনী, এমনকি উল্লেখ পর্যন্ত নেই। আবার সিক্যুয়েলের বইটির প্রচ্ছদেও দুইটি বিড়াল আছে!
‘শি অ্যান্ড হার ক্যাট’ সহ আরও কিছু জাপানি বিড়াল চরিত্রপ্রধান বা বিষয়ক বইয়ের অনুবাদক তাপলে তাকেমরি বলেন, “জাপানে বইয়ে বিড়াল থাকাটা যে খুব বড় কিছু তা নয়, তারা স্বাভাবিকভাবেই বইয়ের প্রয়োজনে থাকতেই পারে। যুক্তরাজ্যে এসে জাপানি বইয়ে বিড়াল থাকার ব্যাপারটাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বড় করা হয়েছে।”
তিনি যোগ করেন, “জাপানি বইগুলো ‘নির্লজ্জভাবে আবেগপ্রবণ’। শিনকায় এর লেখা ‘শি অ্যান্ড হার ক্যাট’ও ব্যতিক্রম নয়। আমি আবেগপ্রবণতা অতটা নিতে পারি না, তবে সত্যি ওই ছোট্ট উপন্যাসটি আমার ভালো লেগেছে। বইটির অতিরিক্ত আবেগ কমিয়ে ইংরেজিতে অনুবাদ করতে গিয়ে আমাকে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছিল।”
জাপানি বইগুলোর মধ্যে ক্রাইম ফিকশন, তরুণ লেখিকাদের গল্প-উপন্যাস এবং ‘কমফোর্ট’ জনরার বইগুলো যুক্তরাজ্যের বাজারে বেশি চলে এবং অনুবাদ হয়। কিন্তু সায়েন্স ফিকশন, অতিপ্রাকৃত বা হরর গল্প খুব একটা দেখা যায় না। চটুল লেখা বা মাঙ্গা কমিক্সের বাইরে রোমান্স নির্ভর গল্পও খুব কম অনুবাদ হয়।
জাপানে ঐতিহাসিক গল্পের, বিশেষত সামুরাই ভিত্তিক উপন্যাসের একটি শক্তিশালী ধারা আছে, কিন্তু সেগুলোর অনুবাদও তেমন পাওয়া যায় না। লি কাঙ্গিঙ এ বিষয়ে একমত। তিনি বলেন, “জাপানে অনেক বই দারুণ জনপ্রিয়তা পেলেও, সেগুলো আন্তর্জাতিক বাজারে ভালোভাবে চলে না। ছোটগল্পের সংকলনগুলোও বিক্রি হয় না।”
জাপানি সাহিত্যে কয়েকটি নির্দিষ্ট ধারার আধিপত্য ছাড়াও, এর থিম বা শৈলীতে এমন কিছু কি আছে যা এখানে পাঠকদের আকৃষ্ট করে?
ফিঞ্চার একটি উদাহরণ তুলে ধরেছেন—তিনি ২০১৮ সালে মারিকো ওহারা-র লেখা ‘হাইব্রিড চাইল্ড’ উপন্যাসটি পড়েন, যেখানে এক ক্রস-জেন্ডার রোবট ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার গল্প বলা হয়েছে। বইটি জাপানে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯০ সালে। ফিঞ্চার বলেন, “তখন আমি বুঝতে পারলাম যে জাপানি সাহিত্য দেরি-পুঁজিবাদ সম্পর্কিত সমস্যা এবং লিঙ্গ ও নারীবাদ সম্পর্কিত বিষয়গুলো নিয়ে কাজ শুরু করেছিল এমনভাবে, যেভাবে ইংরেজি ভাষার সাহিত্য এ বিষয়গুলো মোকাবিলা করতে শুরু করেছিল তার দুই দশক পর।”
লি কাঙ্গিঙ- এর মতে, আধুনিক জাপানি সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো এর লেখকেরা প্রায়ই শহুরে পরিবেশ থেকে আসেন।
তিনি বলেন, “এই শহুরে প্রেক্ষাপটটি এখানকার পাঠকদের কাছে একদিকে পরিচিত, আবার অন্যদিকে আকর্ষণীয়, কারণ এটি পূর্বের (পরিচিত) একটি সংস্কৃতি তুলে ধরে।”
ম্যালোন এটিকে ব্যাখ্যা করেন এইভাবে, “পাঠকেরা এমন এক ভিন্নতা চান যা খুব বেশি ভিন্ন নয়। এক ধরনের আরামদায়ক ভিন্নতা।”
তাকেমোরি যোগ করেন, “জাপানি সাহিত্য পশ্চিমা সাহিত্যের তুলনায় অনেক কম ‘জাজমেন্টাল’। পশ্চিমা সাহিত্য সাধারণত ভাল ও মন্দের ধারণাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। কিন্তু জাপানি সাহিত্যে ভাল ও মন্দের সীমারেখা অনেক বেশি অস্পষ্ট; মন্দ চরিত্রগুলোতে প্রায়ই ভাল কিছু থাকে, আর ভাল চরিত্রগুলোও ত্রুটিপূর্ণ। উপন্যাসগুলোর সমাপ্তিও অনেক বেশি খোলামেলা।”
তবে একটি প্রশ্ন থেকেই যায় ট্রেন্ড বা প্রবণতার পেছনে ছুটে জাপানি সাহিত্য কি আকর্ষণ হারানোর ঝুঁকিতে পড়ছে? এটি কি ইতিমধ্যে তার শীর্ষ বিন্দুতে পৌঁছে গেছে?
লি কাঙ্গিঙ বলেন, “প্রকাশনা জগতে সবসময় ঢেউ ওঠে। একদিন এটি থেমে যাবে। আমি মোটেও চিন্তিত নই যদি ‘বিড়াল-ভিত্তিক বই’গুলো বালুর মতো মিলিয়ে যায়।”
তবে তিনি মনে করেন, অন্য অনেক জাপানি বই স্থায়ী হবে। তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে এমি ইয়াগির ‘ডায়েরি অব আ ভয়েড’ উপন্যাসটি ‘সাহিত্য গবেষণায় স্থান করে নিবে’। এ উপন্যাসে মূল চরিত্রের তরুণীটি গর্ভবতী হওয়ার ভান করে সমাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে।
প্রকাশনা সংস্থা ‘গ্রান্টা’র জেসন আর্থার মনে করেন, “আমরা একটি বিশাল ঢেউয়ের শীর্ষ বিন্দুতে আছি।”
তিনি বলেন, “গ্রান্টা সবসময় জাপানি সাহিত্য প্রকাশ করবে, তবে আমি মনে করি, কিছু বড় কর্পোরেট প্রকাশনা সংস্থা যদি প্রচুর প্রচারণা করে এমন কিছু বই প্রকাশ করে যা (বাজারে) অসফল হয়, তবে তারা আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে।”
শেষ পর্যন্ত, জাপান হোক বা অন্য কোনো দেশ, বিড়াল-ভিত্তিক বই হোক বা ক্রাইম ফিকশন—সাহিত্যের সফলতা নির্ভর করে এর সর্বজনীনতার ওপর, যা ধরন ও ভাষার সীমা অতিক্রম করে।
ফিঞ্চার মুরাতা-র কাজ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, “এটি আমাদের বলে যে, আমরা প্রত্যেকেই কিছুটা অদ্ভুত, মানব সমাজ নিজেও অদ্ভুত, আর এই গল্পে আমরা সবাই উপস্থিত।”
(গার্ডিয়ান অবলম্বনে)