স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলমুক্তির ডাক দিয়ে ১৯৮৭ সালে শুরু হয় জাতীয় কবিতা উৎসব। এরপর থেকে প্রতিবছরই স্বৈরাচার, সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ, গণতন্ত্র হনন বা বর্বরতার প্রতিবাদ জানাতে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে কবিতা উৎসবে আসেন কবিরা।
এবারও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। ‘যুদ্ধ গণহত্যা সহে না কবিতা’ প্রতিপাদ্য নিয়ে আগামী ১ ও ২ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ৩৬তম জাতীয় কবিতা উৎসব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারগার প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হবে এবারের উৎসব। এবারও ভারতের বিভিন্ন ভাষার কবিসহ দক্ষিণ এশিয়ার কয়েক দেশের কবিরা অংশ নিবেন উৎসবে। ।
১৯৮৭ সালে হুসেইন মো. এরশাদ তখন রাষ্ট্রপতি। রাষ্ট্রীয়ভাবেই কবি এরশাদের প্রচার প্রচারণায় মুখর চারদিক। এরশাদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন তৎকালীন সৈয়দ আলী আহাসান, আল মাহমুদ, ফজল শাহাবুদ্দিনের মতো কবিরাও। ফজল শাহাবুদ্দিন ছিলেন সাপ্তাহিক বিচিত্রার সম্পাদক। সেখানে প্রতি সপ্তাহে রাষ্ট্রপতির একটি করে কবিতা প্রকাশিত হতো। তার ইচ্ছাতেই তৈরি করা হলো ‘কবিতা কেন্দ্র’। সেখান থেকেই এরশাদের সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতায় আয়োজন করা হয় ‘এশীয় কবিতা উৎসব’।
এই সময়ে স্বৈরাচার বিরোধী কবিরা গঠন করে জাতীয় কবিতা পরিষদ। সেসময় দৈনিক বাংলা থেকে পদত্যাগ করে কবি শামসুর রাহমান যোগ দেন জাতীয় কবিতা পরিষদে। সঙ্গে থাকেন সৈয়দ শামসুল হক, রফিক আজাদ, মোহাম্মদ রফিক, ড. হুমায়ুন আজাদ, বেলাল চৌধুরী, লুৎফর রহমান সরকার, নির্মলেন্দু গুণ, আসাদ চৌধুরী, মহাদেব সাহা, হায়াৎ মাহমুদ, রুদ্র মোহাম্মদ শহীদুল্লাহসহ আরও অনেক কবি।
১৯৮৭ এর ৩১ জানুয়ারী থেকে ২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আয়োজিত হয় এশীয় কবিতা উৎসব। তিনদিন ব্যাপী এ উৎসব অনুষ্ঠিত হয় ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে। এরশাদই ছিলেন এ উৎসবের প্রধান পৃষ্ঠপোষক। অন্যদিকে এরশাদের কবিতা উৎসবের প্রতিবাদে ১ ও ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি সড়কদ্বীপে ‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’ স্লোগানে আয়োজিত হয় প্রথম জাতীয় কবিতা উৎসব। কবি শামসুর রহমানের সভাপতিত্বে কবি বেগম সুফিয়া কামাল উৎসবের উদ্বোধন করেন।
সেই থেকে শুরু। কোভিডের বছরগুলো বাদে ধারাবাহিকভাবেই হয়ে আসছে জাতীয় কবিতা উৎসব। প্রত্যেকবারই সমসাময়িক বিষয়বস্তুকে প্রতিপাদ্য করে হয়ে আসছে এ উৎসব। যেমন- ১৯৮৮ সালে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন ‘স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে কবিতা’ ছিল কবিতা উৎসবের স্লোগান বা ২০০৮ সালে জরুরি অবস্থার সময় ‘কবিতার মন্ত্র জয় গণতন্ত্র’ স্লোগান সামনের রেখে আয়োজিত হয়েছিল কবিতা উৎসব।
৩৬তম কবিতা উৎসব সামনে রেখে মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী হলে সংবাদ সম্মেলন করে জাতীয় কবিতা পরিষদ। সংবাদ সম্মেলনে পরিষদের নেতারা বলেন, বাংলাদেশ ছাড়াও বেশ কয়েকটি দেশের কবি ও কবিতাপ্রেমীরা উৎসবে একত্র হবেন। তারা যুদ্ধ, গণহত্যাসহ সব অন্যায়ের প্রতিবাদ জানাবেন।
এবারের দুই দিনব্যাপী উৎসবের উদ্বোধন করবেন কবি নির্মলেন্দু গুণ। উৎসবে কবিতাপাঠ, নিবেদিত কবিতা, সেমিনার, আবৃত্তি ও সংগীতের মধ্য দিয়ে ‘যুদ্ধ গণহত্যা সহে না কবিতা’ স্লোগানকে মূর্ত করে তোলা হবে। উৎসবের দ্বিতীয় দিন বিকেলে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবির নাম ঘোষণা করা হবে বলে জানিয়েছে জাতীয় কবিতা পরিষদ।
এবারের উৎসবের পোস্টার, ব্যাকড্রপ, স্যুভেনিরের প্রচ্ছদে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যার ওপর ভারতীয় শিল্পী নীরেন সেনগুপ্তের আঁকা ছবি, ১৯৩৭ সালে পাবলো পিকাসোর আঁকা বিশ্ববিখ্যাত শিল্পকর্ম ‘গোয়ের্নিকা’ ও গাজায় চলমান হত্যাকাণ্ডের ওপর রাশিদ বাউহামিদির শিল্পকর্ম ‘মা ও শিশু’ ব্যবহার করা হয়েছে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।
প্রায় আটটি দেশের কবিরা এবারের কবিতা উৎসবে অংশ নেবেন। এর মধ্যে ১০ জন কবি সশরীরে আসবেন। আর মিশরের কায়রোর আন্তর্জাতিক বইমেলা থেকে চার দেশের আটজন কবি অনলাইনে উৎসবে যুক্ত হবেন।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন কবিতা পরিষদের সভাপতি মুহাম্মদ সামাদ, সাধারণ সম্পাদক তারিক সুজাত, আসলাম সানী, দিলারা হাফিজ, নাসির আহমেদ।