জাতীয় নির্বাচন আসলেই আলোচনায় আসে জাতীয় পার্টি। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনেও দলটি নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা হয়েছে। এখনও হচ্ছে। এবার মূলত ভোটের দিন ৭ জানুয়ারি থেকেই জাতীয় পার্টি নিয়ে জোর আলোচনা শুরু হয়। কারণ এদিন দলটির চেয়ারম্যান ও মহাসচিবের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ তুলতে শুরু করেন নেতাকর্মীরা।
এমনকি জিএম কাদের ও মুজিবুল হক চুন্নুকে নিজ নিজ পদ থেকে অব্যাহতি নিতে ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটামও দেওয়া হয়। এর রেশ ধরে ১৫ জানুয়ারি বহিষ্কার করা হয় চার নেতাকে, বিলুপ্ত করা হয় ঢাকা মহানগর উত্তর কমিটি।
দলটির সবশেষ খবর, বহিষ্কৃত ওই নেতাদের মধ্যে ঢাকা মহানগরের উত্তরের সাবেক সভাপতি শফিকুল ইসলাম সেন্টু ও প্রেসিডিয়াম সদস্য সুনীল শুভ রায়ের নেতৃত্বে বৃহস্পতিবার (২৫ জানুয়ারি) ঢাকা মহানগরের ১০ থানার ৬৭১ জন নেতা পদত্যাগ করেছেন।
একই দিন সকালে দলের বনানী কার্যালয়ে সভা করেছে নবগঠিত ঢাকা মহানগর উত্তর কমিটি। এই কমিটির নেতারা বলছেন, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের নেতৃত্বে অবিচল থেকেই তারা দলকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন তারা।
পদত্যাগ করা অংশটির নেতারা বলছেন, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ প্রতিষ্ঠিত দলের ‘ধ্বংস’ দেখতে চান না বলেই তারা জিএম কাদেরের নেতৃত্বে না থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
ঢাকার মোহাম্মদপুর, আদাবর, শেরে বাংলানগর, হাতিরঝিল, পল্লবী, মিরপুর, বাড্ডা, রূপনগর, দারুস সালাম ও ক্যান্টনমেন্ট থানার ৬৭১ জন নেতাকর্মী বৃহস্পতিবার বিকালে জাতীয় প্রেসক্লাবে হাজির হন।
সেখানে ‘জাতীয় পার্টির বর্তমান চেয়ারম্যান ও মহাসচিবের স্বেচ্ছাচারিতার প্রতিবাদে গণ পদত্যাগ’ শিরোনামে সংবাদ সম্মেলন করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা মহানগরের উত্তরের সাবেক সভাপতি শফিকুল ইসলাম সেন্টু বলেন, “জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও মহাসচিব দীর্ঘদিন ধরে নেতাকর্মীদের সঙ্গে অন্যায়, অপরাধ করে আসছেন। কিন্তু এসবের কোনও প্রতিবাদ করা যায় না। জিএম কাদের মনে করেন জাতীয় পার্টি তার মুদি দোকান। এখানে কিছু লোক সারাদিন দোকানদারি করে, সন্ধ্যার পর তাকে হিসাব দেয়, হিসাব নিয়ে তিনি চলে যান।”
দলের নেতৃত্ব মহাসচিব চুন্নুর হাতে অভিযোগ করে সেন্টু বলেন, তিনি চেয়ারম্যানকে লাটিমের মতো ঘোরাচ্ছেন। দলকেও ধ্বংস করে ফেলছেন।
দেশের কোথাও জাতীয় পার্টির সভা-সমাবেশ হয় না অভিযোগ করে ঢাকা মহানগরের উত্তরের সাবেক সভাপতি শফিকুল ইসলাম সেন্টু বলেন, “চেয়ারম্যান-মহাসচিব যোগ্য নন। তাই তাদের পদত্যাগ চাই। আমরা এরশাদের ঝাণ্ডা নিয়ে এগিয়ে যাবো।”
জিএম কাদেরের উদ্দেশে সেন্টু বলেন, “দল এরশাদের, আপনার না। আপনার এই দল করার যোগ্যতাও নেই।”
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন দলের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি ও ঢাকা মহানগর উত্তরের সাবেক সদস্য সচিব জাহাঙ্গীর আলম পাঠান।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, “পার্টির চেয়ারম্যান এবং মহাসচিব ৩০০ আসন থেকে প্রার্থী মনোনীত করার পর মাত্র ২৬টি আসনে আওয়ামী লীগের কাছ থেকে ছাড় পাওয়ার বিনিময়ে গোটা পার্টিকেই বিক্রি করে দিয়েছেন। ফলে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির চরম ভরাডুবি হয়েছে। আর সমঝোতা করে চেয়ারম্যান ও মহাসচিবসহ মাত্র ১১ জন এমপি হয়ে এসেছেন।”
তিনি বলেন, জাতীয় পার্টির যে নেতাকর্মীরা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে ভালোবাসেন তারা দলের ধ্বংস দেখতে চান না। সে কারণেই সবাই একযোগে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
“আপনাদের কাছে এই অঙ্গীকারও করে রাখছি, অল্প সময়ের ব্যবধানে আমরা পল্লীবন্ধু এরশাদের চেতনা, প্রেরণা ও নীতি আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য ঐক্যবদ্ধ থাকব।”
নতুন ঢাকা মহানগর উত্তর কমিটির সভা
গত ১৫ জানুয়ারি ঢাকা মহানগর উত্তরের সাবেক সভাপতি শফিকুল ইসলাম সেন্টুকে বহিষ্কারের সঙ্গেসঙ্গে বিলুপ্ত করা হয় ওই কমিটি।
পরে মো. তৈয়বুর রহমানকে আহ্বায়ক ও সুলতান আহমেদ সেলিমকে সদস্য সচিব করে নতুন কমিটি গঠন করা হয়।
প্রথম সভায় কমিটির আহ্বায়ক তৈয়বুর রহমান বলেন, “জাতীয় পার্টি ঢাকা মহানগর উত্তর অতীতের চেয়ে অধিকতর শক্তিশালী। কোনও ষড়যন্ত্রই জাতীয় পার্টির অগ্রযাত্রাকে দমিয়ে রাখতে পারবে না। জাতীয় পার্টি নতুন উদ্যমে জিএম কাদেরের নেতৃত্বে এগিয়ে যাবে।”
সদস্য সচিব সুলতান আহমেদ সেলিম বলেন, “চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের নেতৃত্বে অবিচল থেকে তৃণমূল পর্যায়ে দলকে আরও সুদৃঢ় করতে আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে যাব।”
দলের সাম্প্রতিক সব ঘটনা নিয়ে কথা হয় জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য জহিরুল হক জহিরের সঙ্গে।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “কারা পদত্যাগ করেছেন? তারা কেউ কি গুরুত্বপূর্ণ? সেন্টু ওয়ার্ড কমিশনার ছিল, তার নেতৃত্বে কিছু ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতারা পদত্যাগ করেছে, এটি এত গুরুত্বপূর্ণ কিছু না।”
এর আগেও অনেকে জাতীয় পার্টি ভেঙেছেন উল্লেখ করে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য জহিরুল হক জহির বলেন, “তারা কেউ কেউ দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন। আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর মতো নেতারাও সাইড হয়ে গেছেন রাজনীতি থেকে। এখন যারা আবার নতুন করে এ চেষ্টা করছেন তারাও বিফল হবে। এ বিষয়ে আমার কোনও সন্দেহ নেই।”
জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোশক রওশন এরশাদকে সামনে রেখে পদত্যাগ করা নেতারা নতুন দল গঠন করছেন বলে আলোচনা আছে।
এ প্রসঙ্গে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য জহিরুল হক জহির সাংবাদিকদের বলেন, “দেখুন রওশন এরশাদ অসুস্থ। ঠিক মতো কথা বলতে পারেন না। চলাফেরা করতে পারেন না। তার নাম ব্যবহার করে অনেকেই অনেক কিছু করার চেষ্টা করছে। কিন্তু কিছুতেই কোনও লাভ হবে বলে আমার মনে হয় না।”