Beta
শনিবার, ১৭ মে, ২০২৫
Beta
শনিবার, ১৭ মে, ২০২৫

পদে পদে প্রতারণার শিকার, দাবি জল্লাদ শাহজাহানের

ss. shahjahan-1-4-24
[publishpress_authors_box]

শাহজাহান ভূঁইয়া বেশি পরিচিত জল্লাদ শাহজাহান নামে। বঙ্গবন্ধুর খুনি ও একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের ফাঁসি কার্যকর করে প্রথম আলোচনায় আসেন জল্লাদ শাহজাহান। ৪৪ বছরের কারাভোগ শেষ করে ছাড়া পেয়েছেন গত বছরের ১৮ জুন। এই সময়ে কার্যকর করেছেন প্রায় ৪০টি ফাঁসি, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ফাঁসি দেওয়ার রেকর্ড। কিন্তু মুক্ত এই জীবনে এসে শাহজাহানের উপলব্ধি, ‘কারাগারেই ভালো ছিলাম।’

স্বাধীন জীবনের তুলনায় কারাবন্দি জীবনকে তার সহজ মনে হয়েছে মানুষের প্রতারণায় পড়ে। ভাগিনা, কর্মচারীদের কাছে প্রতারিত হওয়ার পরে সর্বশেষ স্ত্রীও প্রতারণা করে তার কাছ থেকে ১৮ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ করেন শাহজাহান। বলেন, “বাইরে এসে নানা প্রতারণায় পড়ে মনে হচ্ছে কারাগারেই ভালো ছিলাম। কারাগারের বাইরে জীবন এত জটিল কেন? বাইরের জীবন এত কঠিন হবে জানলে কারাগারেই থেকে যেতাম।”

সোমবার জাতীয় প্রেসক্লাবের মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ হলে সংবাদ সম্মেলন করেন শাহজাহান। রবিবার আদালতে প্রতারণার মামলা করেছেন বলেও জানান। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন তার আইনজীবী ওসমান গণী।

গত বছরের জুনে কারাগার থেকে মুক্তির পর ঢাকার কেরানীগঞ্জের গোলামবাজারে বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস শুরু করেন শাহজাহান। সেখানে একটি চায়ের দোকান দেন, এরপর বিয়ে করেন। কিন্তু গত কয়েক মাসে পদে পদে প্রতারণার শিকার হওয়ার কথা জানান কারামুক্ত শাহজানান।

সংবাদ সম্মেলনে শাহজাহান বলেন, “কারাগার থেকে বের হওয়ার পর ভাগিনা নজরুল আমাকে অটোরিকশা কিনে দেবে বলে আমার টাকা মেরে দেয়। এরপর অনেক কষ্টে একটা চায়ের দোকান দেই। যে ছেলেটি আমার সঙ্গে দোকানে সময় দিত, সে চার মাস পর দোকানে থাকা ৩০ হাজার টাকা ও মোবাইল চুরি করে নিয়ে যায়। আমি এখন উভয় সংকটে জীবনযাপন করছি।”

স্ত্রীর প্রতারণা

এখানেই শেষ নয়। গত বছরের ২১ ডিসেম্বর বিয়ে করেন এক নারীকে। সেখানেও হন প্রতারণার শিকার। শাহজাহান বলেন, “৪৪ বছর কারাভোগ শেষ করে এসে বাইরের মানুষদের বুঝতে পারছি না। যেখানেই যাচ্ছি প্রতারণার খপ্পরে পড়ছি। ৫ লাখ টাকা দেনমোহরে বিয়ের কাবিন হলেও, স্ট্যাম্পে লিখিত দিয়ে আমার কাছে থাকা ১০ লাখ টাকা নিয়ে বিয়ের ৫৩ দিনের মাথায় পালিয়ে গেছে স্ত্রী সাথী আক্তার। এরপর আমার নামে যৌতুকের মামলাও দিয়েছে।”

পরিচয়ের দেড় মাস পর গত বছরের ২১ ডিসেম্বর সাথীর (২৩) সঙ্গে পাঁচ লাখ টাকা দেনমোহরে বিয়ে হয় শাহজাহানের। এই স্বল্প সময়েই সাথী ও তার মা শাহজাহানের মোট ১৮ লাখ টাকার জিনিস হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ শাহজাহানের।

সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, “সাথী ও তার মা বিয়ের আগে নানা কৌশলে আমার কাছ থেকে দেড় লাখ টাকা নেয়। বিয়ের দিন ১০০ টাকার তিনটি স্ট্যাম্পে একটি অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর করে আমার আরও ১০ লাখ টাকা নেয়। বিয়ের প্রায় দুই মাসের মাথায় আমার স্ত্রী বাসায় থাকা ৫ লাখ নগদ টাকা ও গয়না নিয়ে পালিয়ে যায়। আমি এ বিষয়ে থানায় অভিযোগ করতে গেলে থানা অভিযোগ নেয়নি। পরে জানতে পারি ১৫ ফেব্রুয়ারি সাথী আক্তার আমার বিরুদ্ধে ঢাকার আদালতে যৌতুক নিরোধ আইনে নালিশি মামলা করেছে।

“মামলায় সে দাবি করেছে, বিয়ের যৌতুক হিসেবে শাহজাহানকে এক লাখ টাকার মালামাল দেয় তার পরিবার। পাশাপাশি নগদ ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। আমি নাকি তার থেকে তিন লাখ টাকা যৌতুক দাবি করেছি। অথচ সে আমার টাকা প্রতারণা করে নিয়ে গেছে সেটার প্রমাণ আমার হাতে আছে। তাই এসব প্রমাণ নিয়ে আমি সাথী আক্তারসহ ৬ জনের নামে মামলা দিয়েছি (মামলা নং ২৮২/২৪)। আদালত মামলাটি পিবিআইকে তদন্ত করতে নির্দেশ দিয়েছেন।”

কারাগার থেকে ছাড়া পাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল থেকে পাঁচ লাখ ও বিভিন্ন শুভাকাঙ্ক্ষীর কাছ থেকে পাওয়া টাকাসহ মোট ১৮ লাখ টাকা তার কাছে ছিল জানিয়ে শাহজাহান বলেন, সব হারিয়ে এখন তিনি আবার সর্বশ্রান্ত।

আক্ষেপ করে তিনি বলেন, “আমি এখন কীভাবে বাঁচব, আমার জীবন কীভাবে চলবে, কোথায় থাকব- কিছুই বুঝতে পারছি না। এখন কেউ আমাকে খাবার দিলে খাই, না দিলে না খেয়ে থাকি। আমার থাকার জায়গা নেই। ফুটপাতে, গ্যারেজে খুব কষ্টে সময় পার করছি।”

কাজের জন্য এমপি-চেয়ারম্যানের কাছে গেলেও সহযোগিতা পাননি জানিয়ে শাহজাহান বলেন, “আমি আমার উপজেলা চেয়ারম্যান, এমপির কাছে গিয়েছি। কেউ আমাকে কাজ দেয়নি, সহযোগিতা করেনি। এভাবে চলতে থাকলে আমার আত্মহত্যা করা ছাড়া কোনও উপায় থাকবে না।”

কর্মসংস্থানের অনুরোধ

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিত্তবানদের কাছে আবাসন ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেওয়ার অনুরোধ জানান শাহজাহান।

তিনি বলেন, “আমি চরম অর্থনৈতিক সংকটে আছি। আমার কাজ করার ক্ষমতা নেই, আয় রোজগার নেই, অর্থের যোগানদাতা নেই, থাকার জায়গা নেই। আমি এই অসহায়ত্বের অবসান চাই।”

৪৪ বছরে কারাবন্দি জীবনে ৪০ ফাঁসি কার্যকর

৪৪ বছরের কারাবন্দি জীবনে ৪০ জনের ফাঁসি কার্যকর করার কথা জানিয়েছেন শাহজাহান। ১৯৭৯ সালে একটি হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হন এবং ২০২৩ সালের ১৮ জুন কারামুক্ত হন তিনি।

জল্লাদ শাহজাহান বলেন, “এই দীর্ঘ ৪৪ বছর কারাবন্দি থাকাকালে ২০২৩ সালের ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত আমি আলোচিত প্রায় ৪০টি ফাঁসি কার্যকর করেছি, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সবথেকে বেশি ফাঁসি দেওয়ার রেকর্ড।”

তিনি বলেন, “১৯৮৯ সালে আমি সহযোগী জল্লাদ হিসেবে গফরগাঁওয়ের নূরুল ইসলামকে ফাঁসি দিয়ে জল্লাদ জীবনের সূচনা করি। এরপর ১৯৯৩ সালের জুলাই মাসে শহীদ বুদ্ধিজীবী কন্যা শারমীন রীমা হত্যা মামলার আসামি খুকু মুনির, ১৯৯৭ সালে বহুল আলোচিত ডেইজি হত্যা মামলার আসামি হাসান, ২০০৪ সালের ১০ মে খুলনা জেলা কারাগারে এরশাদ শিকদার, ২০০৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর রংপুর জেলা কারাগারে ইয়াসমিন হত্যা মামলার আসামি এএসআই মইনুল হক ও আবদুস সাত্তার, ২০০৪ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর দিনাজপুরে ইয়াসমিন হত্যা মামলার আরেক আসামি পিকআপ ভ্যানচালক অমৃত লাল বর্মণের ফাঁসি কার্যকর করেছি।

“২০০৭ সালের ২৯ মার্চ কাশিমপুর ও ৯ মার্চ ময়মনসিংহে জঙ্গি নেতা সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাই, আতাউর রহমান সানি, আবদুল আউয়াল, খালেদ সাইফুল্লাহ ও ইফতেখার মামুন, ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলায় মুত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পাঁচ খুনি বজলুল হুদা, আর্টিলারি মুহিউদ্দিন, সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ও ল্যান্সার মহিউদ্দিন আহমেদের ফাঁসি কার্যকর করেছি।”

একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া কয়েকজনের ফাঁসি কার্যকর করার কথা জানিয়ে শাহজাহান বলেন, “২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রথম যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লা, ২০১৫ সালের ১১ এপ্রিল মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত জামায়াত নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, ২০১৫ সালের ২২ নভেম্বর জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী, ২০১৬ সালের ১১ মে জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী, ২০১৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর জামায়াতে ইসলামীর নির্বাহী পরিষদের সদস্য মীর কাসেম আলীর ফাঁসি কার্যকর করেছি।”

এছাড়া ২০২০ সালের ৫ মে (কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রথম ও একমাত্র ফাঁসি) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মস্বীকৃত খুনি ও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদের ফাঁসিও কার্যকর করার কথা জানিয়েছেন জল্লাদ শাহজাহান।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত