সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে সৃষ্ট সহিংসতায় আহতদের একটি বড় অংশ চিকিৎসাধীন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। তাদের সংবাদ সংগ্রহসহ কোনও কাজেই এই হাসপাতালটিতে এখন সাংবাদিকদের প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না।
লিখিত কোনও নির্দেশনা না থাকলেও, সাংবাদিক পরিচয় দিলে হাসপাতালের ভেতরে প্রবেশ করতে দিচ্ছেন না দায়িত্বরত আনসার সদস্যরা। কোনোভাবে ঢুকে পড়লে তা টের পাওয়া মাত্র বের করে দেওয়া হচ্ছে।
এমনকি, সাংবাদিক পরিচয়ের কারণে হাসপাতালের বাইরেও হেনস্তার শিকার হতে হয়েছে সকাল সন্ধ্যার প্রতিবেদককে। জোর করে তার মোবাইল নিয়ে তা থেকে মুছে ফেলা হয় বেশকিছু ছবি ও ভিডিও।
রবিবার দুপুরে সংবাদ সংগ্রহের কাজে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান সকাল সন্ধ্যার এই প্রতিবেদক। প্রবেশমুখ থেকে শুরু করে প্রতি ক্ষেত্রেই শুনতে হয়, ‘সাংবাদিক প্রবেশে নিষেধ আছে’, ‘সাংবাদিকদের তথ্য দিতে বারণ আছে’, ‘ভালোয় ভালোয় বের হয়ে যান, নয়তো বের করে দেব’; এমন কথা।
হাসপাতালে দায়িত্বরত আনসার সদস্য থেকে শুরু করে সাদা পোশাকে অবস্থান নেওয়া গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরাও সাংবাদিক প্রবেশে বাধা দিচ্ছিলেন। তথ্য দিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছিলেন নার্স থেকে শুরু করে চিকিৎসকরাও।
পদে পদে বাধা
দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে হাসপাতালের প্রধান ফটক দিয়ে প্রবেশের সময় আনসার সদস্যদের তৎপরতা দেখা যায়। কে-কেন-কী কাজে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ঢুকতে চান, তা জানানোর পরই প্রবেশের অনুমতি মিলছিল।
সাংবাদিক পরিচয় দিলে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না দেখতে পেয়ে এই প্রতিবেদক রোগী সেজে প্রবেশ করেন।
প্রবেশের কিছুক্ষণ পরেই পেছন থেকে আরেক আনসার সদস্য দায়িত্বরত আনসার সদস্যকে বলেন, “এই আপা সাংবাদিক। এর আগেও এসেছিল, উনাকে ঢুকতে দিয়েছিস কেন।”
তখন এই প্রতিবেদক প্রশ্ন করেন, “সাংবাদিক হলে কি চিকিৎসা নেওয়া যাবেনা?”
জবাবে আনসার সদস্যরা জানান, সাংবাদিক প্রবেশে নিষেোজ্ঞা আছে। চিকিৎসা নিতে হলেও তারা প্রবেশ করতে পারবেন না।
তবে কে নিষেধ করেছে, কবে থেকে এই নিষেধাজ্ঞা সে বিষয়ে কিছু বলতে রাজি হননি তারা। বারবার বলতে থাকেন, “এত কিছু জানি না, নিষেধ মানে নিষেধ”।
কিছুক্ষণ বাকবিতণ্ডার হাসপাতালের ভেতরে ঢুকলেও ভেতরে পদে পদে বাধার মুখে পড়তে হয়।
হাসপাতালে প্রবেশের পর থেকেই সাদা পোশাকের দুই ব্যক্তি তাকে অনুসরণ করছেন বলে বুঝতে পারেন এই প্রতিবেদক। কোটা সংস্কার আন্দোলনে আহত রোগীদের বেশিরভাগ ১০১, ১০২ ও ১০৩ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন জানতে পেরে সেদিকেই যাচ্ছিলেন তিনি।
ওয়ার্ডে ঢোকার আগেই অনুসরণকারীদের মধ্যে একজন এসে পরিচয় জানতে চান। পরিচয় পেয়ে তাকে সাবধান করেন, বিপদ হতে পারে জানিয়ে চলে যেতে বলেন।
এরপর একজন নার্সের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলে তিনি রাজি হননি। বলেন, “আমাদের তথ্য দেওয়ার ক্ষেত্রে বারণ আছে।”
কে বারণ করেছে বা কেন, সে প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “যা বলার বলেছি, প্লিজ বিরক্ত করবেন না।”
এরপর সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে দায়িত্বশীলদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করায় এক আনসার সদস্য এসে বলেন, “আপনি এখনও বের হননি? এখনই বের না হলে মহিলা আনসার ডেকে বের করে দেব।”
এসব বিষয়ে জানতে প্রশাসনিক ভবনে গিয়ে পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামানের সঙ্গে কথা বলতে গেলে সেখানেও বাধা দেন আরেক আনসার সদস্য। বলেন, “স্যারের কড়া নির্দেশ, সাংবাদিক ঢোকা নিষেধ।”
হাসপাতালের বাইরে অন্য ‘বাধা’
বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে হাসপাতাল থেকে বের হয়ে যান এই প্রতিবেদক। বাইরে বেরিয়ে সেখানে থাকা রোগীর আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে কথা বলেন। পরে নিজের মোবাইল ফোন বের করে হাসপাতালের বাইরের দৃশ্যের ছবি তোলেন।
এসময় হঠাৎ করে মধ্যবয়সী এক ব্যক্তি এসে চিৎকার করে দাবি করেন, এই প্রতিবেদক তার ছবি তুলছিলেন।
প্রতিবেদক তাকে বলেন, তিনি ফুটপাতসহ দোকানের ছবি তুলেছেন।
কিন্তু তা বিশ্বাস না করে ক্রমেই আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠেন ওই ব্যক্তি। সেসময় আশপাশ থেকে আরও অনেক মানুষ এসে প্রতিবেদককে ঘিরে ধরেন এবং কোন ছবি তুলেছেন তা দেখানোর জন্য চাপ দেন।
প্রতিবেদক তার ফোনের ছবিটি বের করে দেখাতে গেলে মধ্যবয়সী ব্যক্তিটি হাত থেকে মোবাইল কেড়ে নেন এবং নিজেই দেখতে থাকেন। তার দাবি, ছবি তুলে সেটি লুকিয়ে রাখা হয়েছে।
এসময় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে থাকা আনসার সদস্যদের সাহায্য চান এই প্রতিবেদক, কিন্তু তারা সে আহ্বানে সাড়া না দিয়ে ভেতরে চলে যান।
প্রতিবেদকের ফোনে সংবাদের প্রয়োজনে কোটা সংস্কার আন্দোলনের শুরু থেকে নানা ঘটনার ছবি এবং ভিডিও ছিল। সেগুলো দেখতে পেয়ে ওই ব্যক্তি আরও উত্তেজিত হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, “এই মহিলা নিজেও একটা রাজাকার। অশুভ শক্তি। এর ফোনে সব আন্দোলনের ছবি ভিডিও, শুক্রবারের ভিডিও।”
এ কথা শুনে প্রতিবেদককে ঘিরে থাকা অন্যরাও উত্তেজিত হয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে তার ব্যাগ তল্লাশির জন্য টানাটানি শুরু করেন।
এদের মধ্যে অনেকেই নিজেদের স্থানীয় আওয়ামী লীগের কর্মী দাবি করতে থাকেন। একজন বলেন, “আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার লোক। মোড়ে মোড়ে আমাদের অবস্থান আছে। কেউ পার পাবে না।”
এক পর্যায়ে এই প্রতিবেদকের মোবাইল ফোন থেকে সব ভিডিও মুছে তাকে ফোনটি ফেরত দেওয়া হয় এবং তাকে ওই স্থান ত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়।
তবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে সাংবাদিক নিগ্রহের বিষয়টি শোনেননি বলে জানালেন শাহবাগ থানার ওসি মোস্তাজিরুর রহমান।
সকাল সন্ধ্যার পক্ষ থেকে তার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, এ ধরনের ঘটনার শিকার হলে ভুক্তভোগীর কী করা উচিত?
জবাবে ওসি বলেন, “হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বা পরিচালককে অভিযোগ দিতে হবে।”
যদিও গত দুদিন ধরে হাসপাতালটির পরিচালকের কাছেই পৌঁছতে পারছেন না সাংবাদিকরা। শনিবারও আনসার সদস্যদের বাধার মুখে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ঢুকতে পারেননি সাংবাদিকরা। পরিচালকও সাংবাদিকদের দেখা দেননি, তাদের সঙ্গে কোনও কথাও বলেননি।