Beta
রবিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৫
Beta
রবিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৫

‘এখন আমার কোনও ঈদ নেই’

রাফা শহরের একাংশে ঈদের নামাজ পড়ছেন ফিলিস্তিনিরা।
রাফা শহরের একাংশে ঈদের নামাজ পড়ছেন ফিলিস্তিনিরা।
[publishpress_authors_box]

“ঈদ শিশুদের জন্য। যুদ্ধে গাজায় প্রাণ হারিয়েছে ৫ হাজারের বেশি শিশু। এই ঈদ আমরা কীভাবে উদযাপন করব!”

কথাগুলো দ্য ন্যাশনালকে বলছিলেন একদা দক্ষিণ গাজার বাসিন্দা পঞ্চাশোর্ধ্ব মোনা ইউসেফ।

শহরের তাল আল হাওয়ায় তার বাড়ি ধ্বংস হয়েছে ইসরায়েলি বোমার আঘাতে। সেই থেকে মোনা শহরের আল নাসের পাড়ায় এক বন্ধুর বাড়িতে থাকেন।

তিনি বলেন, “আমার নাতির বয়স ১৫। সে আমার কাছে জানতে চেয়েছে, অন্যান্য আরব দেশের শিশুরাও কি আমাদের মতো? মানুষের মুখে দুঃখ ও হতাশার ছাপ স্পষ্ট। অধিকাংশ সময়ই তারা নীরব থাকেন।”

ইসরায়েলে গত ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পরই সব ওলট পালট হয়ে যায়। ইসরায়েলের পাল্টা হামলায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় গাজা। এতে প্রাণ হারায় ৩৩ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি।

সেই গাজাতেই মাথার ওপর বোমারু বিমান আর আতঙ্ক নিয়ে বুধবার আসে মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদ। ঈদ মানে আনন্দ, কিন্তু গাজায় আসেনি সেই আনন্দ।

আগে গাজার যেসব বাজারে নতুন পোশাক ও ঈদের দিনে মিষ্টি কেনার ধুম লাগত, সেসব আজ ধ্বংসস্তূপ। তাকবির ধ্বনিতে এবার মুখরিত হচ্ছে না শহরটির অলি-গলি। শহরজুড়ে শুধু আতঙ্ক আর হতাশার বসবাস।

প্রতিবার ঈদকে কেন্দ্র করে ঐতিহ্যবাহী আয়োজনের কিছুই অবশিষ্ট নেই গাজায়। ঈদের দিনেও তীব্র ক্ষুধা নিয়ে এখানকার বাসিন্দারা পথ চেয়ে বসে আছে ত্রাণের।

ধ্বংসস্তুপের মধ্যেই ঈদের নামাজ পড়ছেন গাজার মুসল্লিরা।

এমনই একজন ১০ বছর বয়সী মোহাম্মদ আজিজ। এই ধ্বংসযজ্ঞে বাবা-মা ও ভাইকে হারিয়ে এখন উত্তর গাজার জাবালিয়ায় জাতিসংঘ পরিচালিত একটি স্কুলে বোনের সঙ্গে থাকে সে।

সেদিন মায়ের জন্য আলু কিনতে বাজারে গিয়েছিল আজিজ। তখনই ইসরায়েলি বিমান হামলায় ধ্বংস হয় তাদের বাড়ি। আজিজ চিরতরে হারিয়ে ফেলে তার বাবা-মা ও ভাইকে। এরপরই বোনের কাছে ঠাঁই হয় তার। কিন্তু কঠিন মুহূর্তগুলোতেও আজিজের মতোই বাবা-মায়ের শূন্যতা অনুভব করে তার বোন।

আজিজ বলে, “চারপাশে অনেকের মা-বাবা আছে, আমার নেই। তাদের কথা খুব মনে পড়ে। ঈদের সময় মা আমাকে নতুন জামাকাপড় কিনতে নিয়ে যেতেন। এখন আমার কোনও ঈদ নেই।”

গাজা থেকে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন ৩৫ বছর বয়সী হেন্নান হিনাওয়ি। বর্তমানে বাস করেন গাজার সর্বদক্ষিণের শহর রাফার তাঁবুতে। তার ছোট ছোট সন্তানরাও যুদ্ধের বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জ বুঝতে পারছে বলে জানান তিনি। এবছর যে তাদের জীবনে কোনও ঈদ নেই, তাও তারা বুঝে গেছে।

হেন্নান বলেন, “ঈদ মানেই পরিবারের মিলনমেলা, শিশুদের পার্কে খেলা, তাদের হাতে টাকা দেওয়া, আর খেলনা কেনা। তারা (ইসরায়েল) আমাদের ঈদের মৌলিক জিনিসগুলো থেকেও বঞ্চিত করেছে।”

হেন্নানের পরিবারের এবারের ঈদ শুধু কায়েক বিস্কুট কেনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তিনি বলেন, “সন্তানরা কায়েক বিস্কুট পছন্দ করে। প্রতিবার যেভাবে রমজানের পরে প্রথম দিনে তারা কায়েক বিস্কুট খায়, এবারও তারা খেতে চায়। তাই কিনেছি।”

যৌথ পরিবারে শান্তির সংসার ছিল হেন্নানের। এখন সেখান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বামী ও দুই সন্তান নিয়ে বাস করেন তাঁবুতে। সন্তানরাও ছয় মাস ধরে তাদের চাচাতো ভাইবোনদের দেখেনি। তিনি বলেন, “আমাদের আত্মাও আজ ক্লান্ত। এই পরিস্থিতি আর সহ্য করতে পারছি না। আগে সব উৎসব উপভোগ করতাম। কিন্তু এখন জীবনধারণের বাইরে অন্য কিছুতে মনোযোগ দেওয়ার ক্ষমতা নেই।”

ফিলিস্তিনিদের ঐতিহ্যবাহী এক খাবার সোমাকিয়া। মূলত রমজানের শেষ দিন এটি তৈরি করে ঈদের দিন খাওয়া হয়। সেই সোমাকিয়া তৈরি করে প্রতিবেশীদের বিতরণ করছিলেন ৬৫ বছর বয়সী উম হাসান আল মাসারি। প্রত্যেক ঈদের তিনি সোমাকিয়া তৈরি করেন। তবে এবারেরটা হবে ভিন্ন। মাসারি বলেন, “এবার সোমাকিয়া তৈরি হবে মাংস ছাড়া। যুদ্ধের বাজারে মাংসের অনেক দাম।”

রাফায় ধ্বংসস্তূপের পাশে ঈদের পিঠা বানাতে ব্যস্ত এক ফিলিস্তিনি নারী।

এবারই প্রথম ফিলিস্তিনিরা ঈদ উদযাপন করতে পারছে না, এমন নয়। মাসারি বলেন, “এমন পরিস্থিতিতে মানিয়ে নিয়েছি আমরা। জীবনের আনন্দ হারিয়ে ফেলেছি। যুদ্ধে প্রতিটি পরিবার কাউকে না কাউকে হারিয়েছে। এ যুদ্ধ শেষ হলেও আমাদের জীবন আর আগের মতো হবে না।”

আল আকসা মসজিদ কম্পাউন্ডে এবারও ঈদের নামাজ আদায় করেছে ফিলিস্তিনি জনগণ। কিন্তু ঈদের আনন্দ তাদের ছোঁয়নি। রক্ত, ধ্বংস আর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের চিন্তা গ্রাস করে আছে তাদের মন।

রাফার দোকানদার আহমেদ ইসমাইলি আল জাজিরাকে বলেন, “ঈদের কোনও আনন্দ আর আমাদের নেই। এমনকি শিশুদেরও আগের মতো খেলনার প্রতি আগ্রহ নেই। এটা আমাদের জীবনের সবচেয়ে খারাপ সময়।”

বাস্তুচ্যুত জাবের হাসান বলেন, “আমরা সব দিক দিয়েই ক্ষতিগ্রস্ত। মানুষ টিকে থাকতেই হিমশিম খাচ্ছে। পরিবারের খাবার জোগাড় করতেও কষ্ট হচ্ছে। ঈদ, উৎসব বা অন্য কোন আনন্দের কথা এখন আমাদের মাথায় আসে না।”

সবার জন্য ঈদ আনন্দের, কিন্তু গাজাবাসীর জন্য ঈদের এই সকালটা শোকের। রেড ক্রিসেন্টের টিমের সদস্য হিসেবে গাজায় কাজ করতে গেছিলেন ফাওয়াদ আবু খামাশ। সেখানে ইসরায়েলি হামলায় নিহত হন তিনি। তার মা বলেন, “এই ঈদ দুঃখের। ঈদের সকাল থেকে ছেলের কবরের সামনে বসে আছি।” 

প্রতিবছর ঈদের দিন মুসলিম বিশ্বকে সামনে রেখে বক্তব্য দেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। এবারও দিয়েছেন, তার সেই বার্তা ছুঁয়ে গেছে গাজাবাসী দুর্দশাও।

সোশাল মিডিয়া এক্সে তিনি লিখেছেন, “প্রতিবছর, সারা বিশ্বের মুসলমান সম্প্রদায়কে #ঈদুল ফিতর উপলক্ষে আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাই। যুদ্ধ ও ক্ষুধার কারণে গাজা, সুদান এবং আরও অনেক জায়গায় অনেক মুসলমান যথাযথভাবে ঈদ উদযাপন করতে পারবে না- এটা জেনে আমার হৃদয় ভেঙে গেছে।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত