জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) এক ছাত্রলীগ নেতা ও তার সহযোগীর বিরুদ্ধে স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ এনে তাদের বিচারসহ বিভিন্ন দাবিতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে।
এর অংশ হিসেবে মঙ্গলবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘নিপীড়নবিরোধী মঞ্চের’ ব্যানারে মানববন্ধন হয়েছে। এ কর্মসূচি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর প্রক্টর আ স ম ফিরোজ উল হাসান ও মীর মোশাররফ হোসেন হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক সাব্বির আলমের পদত্যাগের দাবি জানানো হয় ঘটনায় তাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে। এজন্য অভিযুক্ত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রক্টর ও প্রভোস্টকেও বিচারের আওতায় আনার দাবি জানানো হয় মানববন্ধনে।
এদিকে ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়ে মঙ্গলবার বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের এক নেতার নেতৃত্বে মৌন মিছিলও হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ, কৌশলে গত ৩ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ৯টার দিকে মীর মোশাররফ আবাসিক হলে স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে বোটানিক্যাল গার্ডেনে নিয়ে পালাক্রমে ধর্ষণ করেন তিনি ও তার সহযোগী বহিরাগত মামুনুর রশীদ মামুন।
এ অভিযোগে ওই নারীর স্বামীর করা মামলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী মোস্তাফিজুর রহমানসহ চার জনকে গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তিন দিনের হেফাজতে পেয়েছে পুলিশ। ঘটনায় জড়িত অপর দুইজনকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন আশুলিয়া থানার ওসি এএফএম সায়েদ।
মঙ্গলবার দুপুরে শহীদ মিনারের পাদদেশে নিপীড়নবিরোধী মঞ্চের ব্যানারে অনুষ্ঠিত মানববন্ধনে অছাত্রদের হল থেকে বের করার, প্রক্টর ও প্রভোস্টের পদত্যাগ এবং ধর্ষণে জড়িতদের সনদ বাতিল ও শাস্তি নিশ্চিতসহ বিভিন্ন দাবি জানানো হয়।
মানববন্ধনে ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক আনিছা পারভীন জলি বলেন, “আমাদের প্রথম যে দাবিটি ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে সকল অছাত্রদের বের করতে হবে। কিন্তু পাঁচ দিন সময়ের তিন দিন পেরিয়ে গেলেও প্রশাসন এখন পর্যন্ত ২৫০০ অবৈধ ছাত্রের কোনও তালিকা প্রকাশ করতে পারেনি। তাহলে বাকি দুইদিনে কীভাবে তাদের হল থেকে বের করবেন।
“আমরা বলেছিলাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বাদী হয়ে মামলা করবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তারা কোনও মামলা করেনি। শুধু একটা জিডি করেছে। আমরা চেয়েছিলাম যে ধর্ষক শিক্ষার্থীর সনদ বাতিল করা হোক। কিন্তু তাও অস্থায়ী বাতিল করা হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “ধর্ষণের যারা সহযোগী তাদের বিচারেও গড়িমসি করছে এই প্রশাসন। উপাচার্য বারবার বলেন আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। কমিটমেন্ট দেন। কিন্তু তা আর ফলোআপ করা হয় না। যেমনটি মাহমুদুর রহমান জনির ক্ষেত্রে হয়নি। প্রায় দেড় বছর পার হয়েছে এখন পর্যন্ত তার কোনও বিচার হয়নি।
“তাছাড়া যে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে, তার প্রধান করা হয়েছে একজন সিন্ডিকেট সদস্যকে। তাহলে এই তদন্ত কমিটি নিরপেক্ষ হবে কীভাবে?
তদন্ত কমিটির অন্য দুজনও রাজনৈতিক দলের এবং উপাচার্যের ঘনিষ্ঠ অভিযোগ করে অধ্যাপক আনিছা পারভীন জলি বলেন, “আপনারা জানেন যে ধর্ষককে যারা পালাতে সাহায্য করেছে তারা ছাত্রলীগের কর্মী। কিন্তু এই প্রক্টরই মোস্তাফিজকে খুঁজে আনতে পাঠিয়েছিলেন দুজন ছাত্রলীগের কর্মীকে।
“তাহলে প্রক্টোরিয়াল টিমের কাজ কি? তাদের উচিত ছিল এম এইচ হলকে চারদিক থেকে ঘেরাও করে মোস্তাফিজকে আটক করা। কিন্তু তা না করে পাঠানো হয়েছে ছাত্রলীগের কর্মীকে। এখান থেকেও বোঝা যায় প্রক্টরের কোনো সদিচ্ছা ছিল না তাদেরকে আটক করার।”
মানববন্ধনে আরও বক্তব্য রাখেন ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক গোলাম রাব্বানী, ফার্মেসি বিভাগের অধ্যাপক মাফরুহী সাত্তার, দর্শন বিভাগের অধ্যাপক আনোয়ারউল্লাহ ভূঁইয়া, অধ্যাপক মোহাম্মদ কামরুল আহসান, নিপীড়নবিরোধী মঞ্চের আহ্বায়ক অধ্যাপক রায়হান রাইন এবং সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক শামসুল আরেফিন।
মানববন্ধনে আন্দোলনরত শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ঘটনায় অভিযুক্ত শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ফিরোজ উল হাসান এবং মীর মোশাররফ হোসেন হলের প্রভোস্ট সাব্বির আলমকে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানান।
অধ্যাপক আনিছা পারভীন জলি জানিয়েছেন, সার্বিক দাবি নিয়ে তারা বুধবার উপাচার্যের সঙ্গে আলোচনা করবেন। সে আলোচনার ওপর ভিত্তি করে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। প্রয়োজনে অবস্থান কর্মসূচিতে যাবেন তারা।
ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি এনামুর রহমানের নেতৃত্বে দুপুরে ক্যাম্পাসে মৌন মিছিল হয়। ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার পাদদেশে শেষ হয় এ মিছিল।
বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি এনামুর রহমান জানান, আন্দোলনরত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কর্মসূচির সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করে এ মিছিল করেছেন তারা। এ সময় ঘটনায় জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডসহ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি জানান তিনি।
নিপীড়নবিরোধী মঞ্চের অভিযোগের বিষয়ে জানতে একাধিকবার প্রক্টর আ স ম ফিরোজ উল হাসানকে ফোন দিলেও তিনি সাড়া দেননি।
এ বিষয়ে এর আগে তিনি বলেন, “বহিরাগত একজনের সঙ্গে মিশে আমাদের সাবেক এক শিক্ষার্থী এই অপকর্মটি করেছে। আমরা শোনার সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাস্থলে যাই। দুই থানার পুলিশের সাথে যোগাযোগ করি। পরে জানতে পারি থানায় অভিযোগ করেছে। রাত ২টার দিকে ভিকটমসহ পুলিশ আসলে তাদেরকে আমরা সবধরনের সহযোগিতা করি।”
ধর্ষণের অভিযোগ ওঠার পর মোস্তাফিজকে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা এবং কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। সিন্ডিকেট সভায় তাদেরকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িক বহিস্কার, সনদপত্র স্থগিত এবং ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত ঘোষণার সিদ্ধান্ত হয়েছে।