অর্থনীতিতে নানা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে রাজস্ব আদায়ে বেশ ভালো গতি দেখা দিয়েছে, প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ১৬ শতাংশ। তবে হয়নি লক্ষ্যপূরণ। আর এ সময়ে রাজস্ব আদায়ে ভোক্তাদের ওপর বাড়তি চাপ পড়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
গত জুলাই-ফেব্রুয়ারি রাজস্ব আদায় হয়েছে ২ লাখ ২৬ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হয়েছে। এই অঙ্ক গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ বেশি। এই প্রবৃদ্ধি গত পাঁচ অর্থবছরে ১০ শতাংশ গড় প্রবৃদ্ধির হারকে ছাড়িয়ে গেছে।
তবে নির্ধারিত রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা সংশোধন করে কমানোর পরও গত জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে ১৮ হাজার ২২১ কোটি টাকা রাজস্ব ঘাটতি রয়ে গেছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী, জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ছিল ২ লাখ ৪৪ হাজার ৮০৮ কোটি টাকা। এর বিপরীতে আদায় হয়েছে ২ লাখ ২৬ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা।
সবশেষ ফেব্রুয়ারি মাসে রাজস্ব আদায় বেড়েছে ১৯ শতাংশের বেশি, যা চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আমদানিমূল্য বৃদ্ধি ও কর আদায়ের প্রচেষ্টা বাড়ানোসহ বিভিন্ন কারণে আদায় বাড়ছে।
এনবিআরের বাড়তি রাজস্ব আদায়ের চাপ ভোক্তাদের ওপর পড়ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, রাজস্বের বড় অংশই আসে পরোক্ষ কর থেকে। আর এই কর সরাসরি ভোক্তারা দিয়ে থাকেন।
এনবিআরের সাময়িক হিসাব অনুসারে, এই আট মাসে আয়কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭৯ হাজার ১৫৫ কোটি টাকা। এর বিপরীতে আয় হয়েছে ৭২ হাজার ৩১১ কোটি টাকা। পাশাপাশি মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯২ হাজার ৩৬৮ কোটি টাকা; আয় হয়েছে ৮৮ হাজার ৭০১ কোটি টাকা।
এছাড়া শুল্ক আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭৩ হাজার কোটি টাকা। এর বিপরীতে আয় হয়েছে ৬৫ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা।
জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে আয়কর থেকে, প্রায় ২০ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে আয়কর আদায়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ২৯ শতাংশ।
অন্যদিকে আমদানিতে জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হওয়া সত্ত্বেও আমদানি খাতে কর আদায় প্রায় ১১ শতাংশ বেড়েছে। ভ্যাট আদায়ে ১৬ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
এনবিআর সদস্য (কর) সৈয়দ মোহাম্মাদ আবু দাউদ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমরা মাঠ পর্যায়ে মনিটরিং বাড়িয়েছি। এছাড়া ট্যাক্স ডিডাকশন এট সোর্স (টিডিএস), যারা অতীতে টিডিএস কার্যকর করতো না, তা এখন বাধ্য হচ্ছে। প্রুফ অব সাবমিশন অব রিটার্ন (পিএসআর) বাস্তবায়নের বাধ্যবাধকতা আনা হয়েছে। এসব কারণে আয়কর আদায়ে ভালো প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
“প্রতি বছরই অর্থবছরের শেষ দিকে রাজস্ব আদায় বাড়ে। আশা করছি, অর্থবছর শেষে সংশোধিত লক্ষ্য অর্জিত হবে” যোগ করেন তিনি।
এছাড়া রমজানকে ঘিরে আমদানি বৃদ্ধির কারণে ফেব্রুয়ারিতে প্রবৃদ্ধি অনেক বেড়েছে বলেও মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আট মাসে সার্বিকভাবে আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খোলা কমেছে ৪ শতাংশ।
তা সত্ত্বেও আমদানি খাতে কর আদায়ে প্রবৃদ্ধির কারণ ব্যাখ্যা করে এনবিআরের কাস্টমস বিভাগের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমদানির মিথ্যা ঘোষণা ঠেকানোর ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, যা আমদানি কর আদায়ে প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে।”
রাজস্ব আদায় পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে গত রবিবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে এনবিআর ভবনে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম।
সভায় উপস্থিত এক কর্মকর্তা জানান, ফাঁকি বন্ধ করতে মনিটরিং বাড়ানো এবং মামলায় আটকে থাকা রাজস্ব আদায়ে কর্মকর্তাদের আরও নিবিড়ভাবে কাজ করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
তবে তা সত্ত্বেও চলতি অর্থবছরের রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের সম্ভাবনা খুবই কম বলে মনে করছেন এনবিআরের সাবেক সদস্য ফরিদ উদ্দিন।
সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “রাজস্বের একটি বড় অংশ আসে সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন থেকে। সাধারণত বছরের শেষদিকে রাজস্ব আদায় অনেক বেশি হয়। কিন্তু এবার এডিপি বাস্তবায়নের হার খুবই কম, যার ফলে শেষদিকে রাজস্ব আদায়ও কম হবে।”
“এমন পরিস্থিতিতে রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম,” বলেন তিনি।
বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নের হার দাঁড়িয়েছে ৩১ দশমিক ১৭ শতাংশ; এই বাস্তবায়নের হার গত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম।
গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকারের কৃচ্ছ্রসাধনের অর্থবছরেও এই আট মাসে এডিপি বাস্তবায়ন হার ছিল ৩২ দশমিক ১০ শতাংশ।
চলতি অর্থবছরে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষমাত্রা প্রাথমিকভাবে নির্ধারণ করা হয়েছিলে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে গত বছরের আদায়ের তুলনায় প্রবৃদ্ধি হতে হবে প্রায় ৩০ শতাংশ। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে এত বেশি হারে রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি কোনও বছরই ধরা হয়নি।
এমন পরিস্থিতিতে লক্ষ্যমাত্রা ২০ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে ৪ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
এনবিআর সূত্র জানিয়েছে, অর্থবছরের প্রথম আট মাসে রাজস্ব আদায় হয়েছে ২ লাখ ২৬ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। বাকি চার মাসে (মারচ থেকে জুন) আদায় করতে হবে ১ লাখ ৮৩ হাজার কোটি টাকার বেশি।
বাড়তি রাজস্বের চাপ যাচ্ছে সাধারণ ভোক্তার ওপর
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এনবিআরের বাড়তি রাজস্ব আদায়ের চাপ ভোক্তাদের ওপর পড়ছে। কেননা, রাজস্বের বড় অংশই আসে পরোক্ষ কর থেকে।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, এনবিআরের বাড়তি রাজস্ব আদায়ের চাপ যাচ্ছে ভোক্তার ওপর, কারণ রাজস্বের বড় অংশই আসে পরোক্ষ কর থেকে।
তিনি বলেন, “রাজস্বের ৮০ শতাংশই আসে পরোক্ষ কর থেকে। এর অর্থ হলো, বেশি রাজস্ব আদায় হলে এর চাপ ভোক্তার ওপর পড়ছে। যাদের আয় নেই বা কম, তাদের ওপর বড় চাপ পড়ছে।
“এমনিতেই পণ্যের দাম বাড়ছে। এর সাথে আমদানিতে বিভিন্ন ধরনের কর এবং স্থানীয় পর্যায়ে ভ্যাট যোগ হয়ে এই ব্যয় আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।”
“রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক সংস্কার ছাড়া সাধারণ মানুষের ওপর এই চাপ কমানো সম্ভব হবে না,” বলেন তিনি।
ভোক্তাদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “যে বাড়তি পরোক্ষ কর নেওয়া হচ্ছে, তা ব্যবসায়ী তার পকেট থেকে দেবেন না। ঘুরে ফিরে তা ভোক্তার ওপরেই পড়ছে। এজন্য আমাদের দাবি প্রত্যক্ষ কর বাড়িয়ে পরোক্ষ কর কমানোর জন্য। কিন্তু এনবিআর তা শুনছে না।”
এ সময় তিনি সাম্প্রতিক সময়ে খেজুর, ডাল, চিনি ও বিভিন্ন ধরনের ফলে দাম বেড়ে যাওয়ার জন্য অন্যান্য কারণের পাশাপাশি বিদ্যমান কর ব্যবস্থাকেও দায়ী করেন।