দেশের অস্থিতিশীল সময় চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ব্যবসা-বাণিজ্যের কর্মকাণ্ডে যেমন বিঘ্ন ঘটেছে, তেমনি সরকারের কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আদায়ও সম্ভব হয়নি।
বুধবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) যে হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা গেছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে সার্বিকভাবে শুল্ক ও কর আদায়ে ঘাটতি হয়েছে ২৫ হাজার ৫৯৭ কোটি টাকা। আর এই প্রান্তিকে গত অর্থ বছরের একই সময়ের চেয়ে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার বেশি কম আদায় হয়েছে।
জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর- কোনও মাসেই রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি এনবিআর।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকে ঘিরে জুলাই মাসের প্রায় পুরোটা সময় দেশজুড়ে অস্থিরতা, সহিংসতা, মৃত্যু, ইন্টারনেট বন্ধ, কারফিউ, মামলা, গ্রেপ্তারের মতো ঘটে। এরপর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরও দেশে সংঘাতময় পরিস্থিতি দেখা দেয়।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গত ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেয় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। এরপর আড়াই মাস পার হলেও দেশে আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। ব্যবসা-বাণিজ্যের অনিশ্চয়তাও কাটেনি।
এসব কারণে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে অর্থাৎ জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আদায় করা যায়নি বলে জানান এনবিআরের শুল্ক ও কর বিভাগের কর্মকর্তারা।
এনবিআরের হিসাব অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে এনবিআরের মোট রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ছিল ৯৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এর বিপরীতে আদায় হয়েছে ৭০ হাজার ৯০৩ কোটি টাকা। এ সময়ে ঘাটতি হয়েছে ২৫ হাজার ৫৯৭ কোটি টাকা।
গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে সব মিলিয়ে ৭৫ হাজার ৪৮৮ কোটি টাকার শুল্ক-কর আদায় হয়েছিল।
এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৪ হাজার ৫৮৫ কোটি টাকা কম আদায় হয়েছে। শতাংশ হিসাবে এই তিন মাসে রাজস্ব আদায় কমেছে ৬ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ।
প্রায় ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে শেষ হয়েছিল গত ২০২৩-২৪ অর্থবছর।
তিন মাসেই ধাক্কা
চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের তিন মাসেই রাজস্ব আদায়ে মন্দাভাব চলছে। কোনও মাসেই রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য অর্জন করতে পারেননি কর ও শুল্ক কর্মকর্তারা।
জুলাই মাসে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ছিল ২৫ হাজার ৫৬৯ কোটি টাকা। এর বিপরীতে আদায় হয়েছে ২০ হাজার ২৬৯ কোটি টাকা। অর্থবছরের প্রথম মাসেই রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি হয় পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি।
পরের মাস আগস্টেও একই অবস্থা দেখা যায়। ওই মাসে ৩১ হাজার ৬০৭ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আদায় হয় ২১ হাজার ৬২৯ কোটি টাকা। ওই মাসে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি হয়।
সর্বশেষ গত সেপ্টেম্বর মাসে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ছিল ৩৯ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা। আদায় হয়েছে ২৯ হাজার ২ কোটি টাকা। ঘাটতি হয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি।
তিন খাতেই নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি
এনবিআরের হালনাগাদ তথ্য থেকে জানা যায়, জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে আমদানি শুল্ক, মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) ও আয়কর- এই তিন খাতের কোনোটিতেই লক্ষ্য পূরণ হয়নি। তিন খাতেই আগের বছরের চেয়ে রাজস্ব আদায় কমেছে, অর্থাৎ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
আলোচ্য সময়ে সবচেয়ে বেশি ঘাটতি হয়েছে আয়কর খাতে। তিন মাসে ঘাটতি হয়েছে সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকার মতো। এই খাতে আদায়ের লক্ষ্য ছিল ৩৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। আদায় হয়েছে ২৩ হাজার ১৬৪ কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৬ কোটি টাকা কম।
আমদানি খাতে এই তিন মাসে ২৮ হাজার ৬৩৭ কোটি টাকার লক্ষ্যের বিপরীতে আদায় হয়েছে ২২ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা; ঘাটতি হয়েছে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা। গত বছরের একই সময়ের চেয়ে দেড় হাজার কোটি টাকা কম আদায় হয়েছে।
জুলাই-সেপ্টেম্বরে ভ্যাট বা মূসক আদায়ে ঘাটতি হয়েছে ৮ হাজার ৫৮৮ কোটি টাকা। আদায় হয়েছে ২৫ হাজার ৫৯৩ কোটি টাকা। লক্ষ্য ছিল ৩৪ হাজার ১৮১ কোটি টাকা। গত বছরের একই সময়ের চেয়ে তিন হাজার কোটি টাকার মতো কম আদায় হয়েছে।
চলতি অর্থবছরে এনবিআরের জন্য সব মিলিয়ে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার শুল্ক ও কর, অর্থাৎ রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এনবিআর কর্মকর্তারা মনে করেন, বছরের শেষের দিকে কর আদায়ে গতি বাড়বে।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের ধারাবাহিকতায় এনবিআরেরও সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার; গঠন করা হয়েছে পাঁচ সদস্যের পরামর্শক কমিটি।
এই কমিটির সদস্য এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের আগে ও পরে দেশের পরিস্থিতি তো আসলেই অস্থির ছিল। এখনও পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি।
“এমনিতেই অর্থবছরের প্রথম দিকে রাজস্ব আদায়ে ধীরগতি থাকে। তারপর বর্তমান পরিস্থিতির কারণে এবার আদায় আরও কমে গেছে।”