Beta
বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২৪
Beta
বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২৪

বিচারপতি অপসারণ প্রক্রিয়ার জটিলতা কাটছে কি

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।
[publishpress_authors_box]

আওয়ামী লীগের ‘ফ্যাসিস্ট শাসনের দোসর’ বিচারকদের অপসারণের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সুপ্রিম কোর্ট ঘেরাও কর্মসূচি পালনের মধ্যদিয়ে ফের আলোচনায় এল বহুল আলোচিত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী মামলা।

শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলনের সূত্র ধরে বিচারপতি অপসারণ সংক্রান্ত ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন শুনানি জন্য আপিল বিভাগের রবিবারের কার্যতালিকায় এসেছে। এদিন প্রধান বিচারপতি নেতৃত্বাধীন সর্বোচ্চ আদালতের বেঞ্চে রিভিউ আবেদনটি ১ নম্বর ক্রমিকে রয়েছে।

যদিও আইনজ্ঞরা বলছেন, আপিল বিভাগের রায়ের পর সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল গঠন করে বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে কোনও বাধা নেই।

তবে একটি রিভিউ আবেদন থাকায় এবং বিগত সরকারের অনীহার কারণে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা মনে করা হতো।

গত ১৬ অক্টোবর বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের থামাতে এই জটিলতার বিষয়টি তুলে ধরেছিলেন সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল আজিজ আহমদ ভূঞা। এনিয়ে রিভিউ আবেদন আদালতের বিবেচনাধীন থাকার কথাও বলেছিলেন তিনি।

রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর রাষ্ট্রপক্ষ উদ্যোগী হওয়ায় রিভিউ আবেদনটি নিষ্পত্তির মাধ্যমে যদি বর্তমান রায়ই বহাল থাকে, তাহলে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল গঠন করে বিচারপতি অপসারণের বিষয়ে আর কোনও বাধা থাকবে না বলে মনে করেন আইনজীবীরা।

রিভিউ আবেদনটির ওপর আপিল বিভাগে রবিবার শুনানির জন্য রাষ্ট্রপক্ষ প্রস্তুত রয়েছে বলে সকাল সন্ধ্যাকে জানিয়েছেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ অনিক আর হক।

সর্বোচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী এনেছিল।

তবে হাইকোর্ট তা অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয়। তখন রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করলেও বিচারপতি এস কে সিনহা নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ হাই কোর্টের রায়ই বহাল রাখে।

এরপর ২০১৭ সালে রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। কিন্তু বিচারক সংকট এবং আওয়ামী লীগ সরকারের সময় রাষ্ট্রপক্ষ থেকে কোনও উদ্যোগ না নেওয়ায় এতদিনেও শুনানি হয়নি

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে গণআন্দোলনে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে।

এরপর গত ১০ অগাস্ট এই আন্দোলনের সমন্বয়কদের ডাকে সুপ্রিম কোর্টে জড়ো হয়েছিল বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। একপর্যায়ে তাদের দাবির মুখে সেদিনই পদত্যাগ করেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানসহ আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারক। প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ পান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ।

তার দুই মাস পর আওয়ামী লীগ আমলে নিয়োগ পাওয়া অন্য বিচারকদের অপসারণের দাবিতে গত ১৬ অক্টোবর ফের সুপ্রিম কোর্ট ঘেরাওয়ে যায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।

আওয়ামী লীগ আমলে নিয়োগ পাওয়া বিচারক অপসারণের দাবিতে বুধবার বিক্ষোভ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
‘ফ্যাসিস্টদের দোসর বিচারকদের’ অপসারণের দাবিতে বুধবার সুপ্রিম কোর্ট ঘেরাওয়ে যায় একদল শিক্ষার্থী।

তাদের চাপে ওইদিনই হাইকোর্ট বিভাগের ১২ জন বিচারককে আপাতত বিচারিক কার্যক্রম থেকে বিরত রাখার সিদ্ধান্ত নেন প্রধান বিচারপতি।

সেদিন বিক্ষোভরতদের সামনে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল আজিজ ভূঞা বলেছিলেন, “আপনারা জানেন, বিচারপতি পদত্যাগ বা অপসারণের একটা প্রক্রিয়া আছে। বর্তমানে দেশে এ সংক্রান্ত কোনও আইন বিদ্যমান নেই।”

ছয় বছর ধরে ঝুলে থাকা রিভিও আবেদনটি নিষ্পত্তি হবে বলে প্রত্যাশা করছেন রিট আবেদনকারী আইনজীবী মনজিল মোরসেদও। তিনিসহ আরও কয়েকজনের আবেদনেই হাইকোর্টের রায়টি হয়েছিল।

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “অনেক দিন থেকে রিভিউ শুনানি হচ্ছে না, যদিও রিভিও শুনানি না হলেও সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল কাজ করতে কোনও বাধা নেই।

“আপিল বিভাগ যখন রায় দেয়, তখন এটি কার্যকর করে দিয়েছে। কিন্তু কোনও স্থগিতাদেশ নেই। তারপরও এটি নিষ্পত্তি হয়ে গেলে ভালো। কাল যদি শুনানি হয়ে যায় ভালো হবে।”

রায়ের কোনও বাধা না থাকলেও তৎকালীন সরকারের অসযোগিতার কারণে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল কাজ করতে পারেনি বলে দাবি করেন মনজিল মোরসেদ।

তিনি বলেন, “আগে তিনজন বিচারককে বেঞ্চ দেওয়া হলো না, তদন্তের জন্য প্রধান বিচারপতির পক্ষ থেকে তখন আইন মন্ত্রণালয়কে বলা হয়েছিল, কিন্তু তৎকালীন আইনমন্ত্রীর এক ধরনের গোয়ার্তুমি ছিল। তিনি আপিল বিভাগের রায় মানেন না, সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল মানেন না।”

এদিকে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “রায়ের ওপর রিভিউ থাকায় সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল কাজ করতে পারেনি, কিন্তু রায়ের ওপর স্থগিতাদেশ ছিল না। এখন আবেদনটি প্রত্যাহার করে নিলে আর কোনও বাধা থাকবে না।”

ষোড়শ সংশোধনের প্রেক্ষাপট

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সংবিধানে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতেই রাখা হয়েছিল। কিন্তু ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু আমলে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনের পর বিচারক অপসারণের ক্ষমতা ন্যস্ত হয় রাষ্ট্রপতির হাতে।

জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় যাওয়ার পর সংবিধানের পঞ্চম সংশোধন এনে বিচারক অপসারণের বিষয় নিষ্পত্তির ভার দিতে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল গঠন করা হয়। এরপর সেভাবেই চলছিল।

তিন দশকের বেশি সময় পর আওয়ামী লীগ আমলে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানে ষোড়শ সংশোধনী এনে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা আবার সংসদের হাতে ফেরত নেওয়া হয়। বিলটি পাসের পর ওই বছরের ২২ সেপ্টেম্বর গেজেট প্রকাশিত হয়।

এরপর ওই সংশোধনী চ্যালেঞ্জ করে ২০১৪ সালের ৫ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের ৯ আইনজীবী হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করেন। পরে ৯ নভেম্বর হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ রুল জারি করে।

এরপর ২০১৬ সালের ৫ মে তিন বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের একটি বিশেষ বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ, বাতিল ও সংবিধান-পরিপন্থী বলে রায় দেয়। ওই বছরের ১১ আগস্ট পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়।

বিচারপতি এস কে সিনহা।
বিচারপতি এস কে সিনহা।

এরপর রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিলের শুনানি নিয়ে ২০১৭ সালের ৩ জুলাই ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে হাইকোর্টের রায় বহাল রাখেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা (এস কে সিনহা) নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ। এরপর ওই বছরের ১ আগস্ট ৭৯৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ পায়।

রায়ে মুক্তিযুদ্ধ, গণতন্ত্র, সংসদসহ বিভিন্ন বিষয়ে পর্যবেক্ষণ রাখা হয়। তাতে ‘বঙ্গবন্ধুকে খাটো করা হয়েছে’ অভিযোগ তুলে বিচারপতি সিনহার পদত্যাগের দাবিতে সরব হয়ে উঠে আওয়ামী লীগ সমর্থক আইনজীবীরা। জাতীয় সংসদেও সেই রায় এবং বিচারপতি সিনহার অনেক সমালোচনা করা হয়।

এরপর ওই বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর সংসদে রায় পুনর্বিবেচনার জন্য আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার প্রস্তাব গৃহীত হয়। এরপর ২০১৭ সালের ২৪ ডিসেম্বর আপিল বিভাগে রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। 

৯৪টি সুনির্দিষ্ট যুক্তি তুলে ধরে ৯০৮ পৃষ্ঠার রিভিউ আবেদনে পুরো রায়টি বাতিল চায় রাষ্ট্রপক্ষ।

এদিকে এ রায়কে কেন্দ্র করে তুমুল আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে ২০১৭ সালের ৩ অক্টোবর ছুটিতে যান তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা। পরে ১৩ অক্টোবর তিনি বিদেশে চলে যান। সেখান থেকে তিনি পদত্যাগপত্র পাঠান।

পরে বিচারপতি সিনহা অভিযোগ করেন, তাকে দেশছাড়া হতে এবং পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত