ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার যোগাযোগ নিরবচ্ছিন্ন করতে বিদ্যমান সেতুর পাশে কালুরঘাটে কর্ণফুলী নদীর উপর নতুন রেল-কাম-সড়ক সেতু নির্মাণ করতে যাচ্ছে সরকার।
১০ বছর আগে ২০১৪ সালে এই সেতু নির্মাণের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ঠিকঠাক নকশার অভাবে সেই সেতুর কাজ শুরু করা যায়নি এই দীর্ঘ সময়েও। উপরন্তু এই সময়ে বেড়েছে প্রকল্পটির ব্যয়।
২০১৪ সালে যখন প্রথম এই প্রকল্পটির প্রস্তাব করা হয় তখন ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ হাজার ১৬৩ কোটি টাকা। তবে গত জুনে বিগত সরকারের আমলে প্রকল্পটির ব্যয় প্রায় ১১ হাজার ৫৬১ কোটি টাকা প্রস্তাব করা হয়। অর্থাৎ দশ বছরের ব্যবধানে এই প্রকল্পে প্রস্তাবিত ব্যয় দশগুণ বাড়ানো হয়।
একই ব্যয়ের প্রস্তাব উঠেছে এই সরকারের আমলেও। প্রকল্পটি অনুমোদনের জন্য জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় উপস্থাপনের জন্য তালিকাভূক্তির প্রক্রিয়ায় রয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সোমবার (আগামীকাল) অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া চলতি অর্থবছরে (২০২৪-২৫) জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) তৃতীয় বৈঠকে খসড়া প্রকল্পটি উপস্থাপন করা হতে পারে। বর্তমান সরকারের দ্বিতীয় একনেক সভায় সভাপতিত্ব করবেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
এর আগে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকার সময় গত ২৭ জুন পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের তৎকালীন সদস্য ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান সকাল সন্ধ্যাকে জানিয়েছিলেন, পরিকল্পনা কমিশনের মুল্যায়ন শেষে প্রকল্পটি চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য একনেক সভায় উপস্থাপনের জন্য তালিকাভূক্তির প্রক্রিয়ায় রয়েছে।
কিন্তু এর পরই তৎকালীন সরকার ‘বেশি ব্যয় প্রাক্কলন করে প্রকল্প অনুমোদন দিচ্ছে’ এমন সমালোচনা শুরু হয়।
শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর গঠিত ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম একনেক সভায় উপস্থাপনের জন্যও প্রকল্পটি তালিকাভূক্ত করা হয়। পরে সেখান থেকে ব্যয় যাচাই বাচাই করার জন্য প্রকল্পটি ফেরত পাঠানো হয়েছিল।
এমন এক প্রেক্ষাপটে আগের প্রাক্কলিত ব্যয়েই এ প্রকল্পটি অনুমোদনের জন্য আবারও একনেক সভায় তোলা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের একজন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা।
সোমবার ঢাকার তেজগাঁওয়ে অবস্থিত প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। বৈঠকে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য এই প্রকল্পসহ মোট ৮টি প্রকল্প উপস্থাপন করা হতে পারে। যার মধ্যে এই প্রকল্পসহ দুটি নতুন আর ছয়টি সংশোধনের জন্য উপস্থাপন করা হতে পারে বলে জানিয়েছেন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সেই কর্মকর্তা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ২০১৪ সালে ‘কালুরঘাটে কর্ণফূলী নদীর উপর রেল-কাম-রোড সেতু নির্মাণ’ শীর্ষক প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছিল মাত্র ১ হাজার ১৬৩ কোটি টাকা। সেই ব্যয় প্রায় ১০ গুণ বাড়িয়ে ১১ হাজার ৫৬১ কোটি টাকা করা হয়, যা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশন সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, “অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম একনেক সভার আগে আমরা প্রকল্পটি তালিকাভুক্তির জন্য পাঠিয়েছিলাম। তখন প্রকল্পটির ব্যয় আরও যাচাই বাচাইয়ের জন্য ফেরত পাঠানোর নির্দেশ দেন অর্থ উপদেষ্টা।
“এমনকী এক পর্যায়ে শিক্ষা ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা নিজেই প্রকল্পটির ব্যয় যাচাই করেন।”
তারপরও শেষ পর্যন্ত প্রকল্পটি থেকে ব্যয় কমানো সম্ভব না হওয়ায় আগের প্রস্তাবিত ব্যয়েই একনেক সভায় উপস্থাপন করা হচ্ছে জানান এই কর্মকর্তা।
প্রকল্পটির জন্য দক্ষিণ কোরিয়ার উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশন ফান্ড (ইডিসিএফ) ৭২ কোটি ৪০ লাখ ডলারের সহজ শর্তের ঋণ দিচ্ছে। বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ প্রায় ৮ হাজার ৫৪৩ কোটি টাকা। ১৫ বছরের রেয়াত কালসহ মাত্র দশমিক ৫ শতাংশ হারে ৪০ বছরে এই ঋণ পরিশোধ করতে হবে।
১ হাজার ১৬৩ কোটি থেকে যেভাবে সাড়ে ১১ হাজার কোটি
প্রকল্পসংশ্লিষ্ট রেল মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে এই প্রকল্পে দুই লেনের সড়ক এবং এক লেনের রেলসেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। এরপর ওই সমীক্ষা অনুযায়ী ব্যয় প্রাক্কলন করে ২০১৮ সালের ৭ আগস্ট প্রকল্পটির চুড়ান্ত অনুমোদনের জন্য জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় উপস্থাপন করা হয়।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৈঠকে গুরুত্বপূর্ণ এই প্রকল্পের নকশা দেখে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। রেল ও সড়ক পথে চলাচলের আলাদা নকশা এবং সড়কের জন্য দুই লেনের পাশাপাশি ডাবল রেললাইন স্থাপনের নির্দেশ দিয়ে প্রকল্পটি অনুমোদন না দিয়ে ফেরত দেন তিনি।
এরপর ইডিসিএফ নতুন নকশার জন্য ২০২১ সালের অক্টোবরে দায়িত্ব দেয় দেশটির আরেকটি প্রতিষ্ঠান ‘দহওয়া ইঞ্জিনিয়ারিং কো-অপারেশন জেভিকে’।
দ্বিতীয় ওই নকশায় কালুরঘাট রেল-কাম সড়ক সেতুটি পদ্মাসেতুর আদলে দ্বিতল সেতু তৈরির নকশা করা হয়। ওই নকশা অনুযায়ী সেতুর নিচতলায় ডাবল লাইনে রেল এবং উপরের তলায় দুই লেনে গাড়ি চলার কথা ছিল। ওই নকশায় ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৬ হাজার ৩৪১ কোটি টাকা।
প্রকল্পসংশ্লিষ্ট রেল মন্ত্রণালয়ের ওই কর্মকর্তা আরও জানান, ২০২২ সালে প্রকল্পের দ্বিতীয় নকশাটি প্রধানমন্ত্রীর কাছে গেলে প্রধানমন্ত্রী ফেরত পাঠান। তিনি একতলা সেতুতেই ডাবল রেললাইন ও যানবাহন চলাচলের জন্য দুই লেন বিশিষ্ট সড়ক সেতুর নকশা করার নির্দেশ দেন। তারপর নতুন এই নকশা করা হয়েছে।
নতুন নকশা অনুযায়ী সেতুর দুই পাশে দুই লেন করে চার লেনের সেতু তৈরি করা হবে। এক পাশে চলবে ট্রেন, অন্যপাশে বাস-ট্রাকসহ সাধারণ যানবাহন।
সেই নকশাতেই উপস্থাপন করা হচ্ছে প্রকল্প প্রস্তাব। এ বিষয়ে রেল বিভাগের প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা এসএম সলিমুল্লাহ বাহার সকাল সন্ধ্যাকে জানিয়েছেন, এখন প্রকল্পের ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে প্রায় ১১ হাজার ৫৬১ কোটি টাকা।
২০১৮ সালে বিআইডব্লিউটিএ নদীর ওপর সেতু তৈরির ক্ষেত্রে ন্যূনতম নেভিগেশন (পানি থেকে সেতুর উচ্চতা) বাধ্যতামূলক করে জানিয়ে এই পরিকল্পনাবিদ বলেন, “সেই নির্দেশনা অনুযায়ী এবং কর্ণফুলী নদীতে ভবিষ্যতে কত বড় জাহাজ চলাচল করতে পারে সেই সম্ভাব্যতা নতুন নকশায় আমলে নেওয়া হয়েছে।”
তিনি বলেন, “প্রকল্পের প্রথম প্রস্তাবে নেভিগেশন ধরা হয়েছিল ৭ দশমিক ৬২ মিটার। নতুন নকশায় নেভিগেশন ধরা হয়েছে ১২ দশমিক ২ মিটার। নতুন নকশায় এই সেতুর নেভিগেশন বেড়েছে প্রায় সাড়ে ৫ মিটার।”
প্রকল্পটির ব্যয় এতো বেশি বেড়ে যাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “নতুন নকশায় ভায়াডাক্টসহ এই সেতুর দৈর্ঘ্য হবে প্রায় ৬ কিলোমিটার। এই দীর্ঘ ভায়াডাক্টের জন্য জমি অধিগ্রহণেই ব্যয় হবে প্রায় ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।”
তিনি জানান, প্রকল্পটির প্রথম নকশায় ২০১৫ সালের রেট শিডিউল ধরা হয়েছিল। ফলে ওই সময়ে প্রকল্পটির ব্যয় কম ধরা হয়েছিল। কিন্তু ২০২২ সালের রেট শিডিউল অনুযায়ী ব্যয় স্বয়ংক্রিয়ভাবেই বেড়ে যায়।
তাছাড়া ২০১৫ সালে ডলারের দাম ছিল ৮০ টাকা, এখন সেটা ১১৮ টাকা। ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়াও প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধির আরেকটি বড় কারণ বলে মন্তব্য করেন রেল বিভাগের প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা এসএম সলিমুল্লাহ বাহার।