“প্রধানমন্ত্রী হলেও নারীর স্বভাবসুলভ বৈশিষ্ট্য তো হারিয়ে যায় না”; ১৯৮৫ সালে ব্রিটিশ টিভি ডক্টর মিরিয়াম স্টপার্ডকে দেয়া সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেছিলেন ‘আইরন লেডি’ হিসেবে খ্যাত সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার।
“আমি তো মাঝে মাঝেই বো বাঁধি। এটা কিন্তু কমনীয় দেখায় … বেশ সুন্দর লাগে।”
যুক্তরাজ্যের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী নারী হিসেবে কারও মনোযোগ আদায় না করে পুরুষ সহকর্মীদের মতই কাজ করে গেছেন। তিনি জানতেন রাজনীতি মানে নিপুন ভঙ্গিমার নৃত্যকলা; এখানে কোমল ও কঠোর শৈলী দিয়েই টিকে থাকতে হয়।
তার ১১ বছরের রাজনৈতিক জীবনে শ্রমিক ইউনিয়ন, অভ্যন্তরীণ ক্ষমতা, ফকল্যান্ড যুদ্ধের মতো সাংঘর্ষিক পরিস্থিতির তীব্রতা কমাতে পোশাক খুব ভালো কাজে দিয়েছে।
ফ্যাশনের জগতে গলার সামনে ফুলের পাপড়ির মতো বাঁধা এক জোড়া ফিতাকে বলে ‘পুসি বো’। বিংশ শতকের দিকে এই নাম জনপ্রিয় হতে শুরু করে। যদিও ব্লাউজের গলার কাছে ফুলের মতো ফিতা বেঁধে আটকে দেয়ার ফ্যাশন বহু পুরনো।
এর আরেক নাম লা ভ্যালিয়ের টাই। রাজা চতুর্দশ লুইয়ের স্ত্রী ডাচেস দে লা ভ্যালিয়েরের সময় থেকে এই নাম হয়।
রাজা গলায় ক্র্যাভাট বাঁধতেন। টাইয়ের ইতিহাস বলছে, রাজাকে দেখে ডাচেস এতোটাই মুগ্ধ হলেন যে নিজেই নিজের জন্য রিবন বানিয়ে ফেললেন ডাচেস।
তখন অবশ্য তিনি ঘুণাক্ষরেও জানতেন না, তিন শতাব্দী পরও পেশাজীবী নারীরা তার ওই ফ্যাশন ধরে রাখবে; কখনও নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে, আবার কখনও পরিস্থিতি অনুসারে সূক্ষ্ণ বার্তা পাঠাতে।
এই যেমন, প্রচারণায় নেমে আমেরিকার বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের নির্বাচনী ড্রেস কোডে ‘পুসি বো’ ফ্যাশন বিশেষ সংযোজন।
আগস্টে ডেমোক্রেটিক ন্যাশনাল কনফারেন্স থেকে টেলিভিশনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট বিতর্ক, আবার সেপ্টেম্বরে অপরাহ শোতে তারকার মতো চেয়ারে বসে সাক্ষাৎকার দেয়া; সবখানেই কমলা হ্যারিসের সাজপোশাকে বিশেষ হয়েছিল ‘পুসি বো’।
হালে বিল হুইটেকারের সঙ্গে ’সিক্সটি মিনিটস’ শোতে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়েও এই বো বাঁধতে ভোলেননি কমলা হ্যারিস। পররাষ্ট্র কূটনীতি, অর্থনীতি এবং নিজের বন্দুক নিয়ে একের পর এক প্রশ্নের জবাব দেয়ার সময় গাঢ় বেগুনি রঙের স্যুট আরও মার্জিত করে তুলেছিল একই রঙের টাই।
যে ‘পুসি বো’ আজকে কমলা হ্যারিসের রাজনীতির ময়দানের পরিচ্ছদ হয়ে উঠেছে, তা মধ্য শতাব্দীতে নারীদের কর্মক্ষেত্রের জন্য নির্ধারিত পোশাক হয়েছিল।
১৯৫০ থেকে ১৯৭০ সালের মধ্যে ৩৫ থেকে ৪০ বছর বয়সী বিবাহিত নারীদের কর্মক্ষেত্রে যোগ দেয়ার হার ২৫ শতাংশ থেকে লাফিয়ে ৪৬ শতাংশ হয়েছিল।
ওই সময় নারী কেমন পোশাক পরবে- তা বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিল। ১৯৭৭ সালে প্রকাশিত লেখক জন টি ম্যালয়ীর বই ‘দ্য ওমেনস ড্রেস সাকসেস’ বিশাল নামডাক কুড়িয়েছিল। তাতে লেখকের পরামর্শ ছিল, সফল নারীর জন্য নেক-টাই ব্লাউজ হচ্ছে এক তর্কাতীত পরিচ্ছদ। স্কার্ট সুটের সঙ্গে এই টাই অনায়াসে পরার কথাও বলেন তিনি; যেহেতু তখনও প্যান্ট নারীর কর্মক্ষেত্রের পোশাক হয়ে ওঠেনি।
জন টি ম্যালয়ীর সঙ্গে একমত হয়েছিলেন নারীরাও। ৭০ থেকে ৮০ -র দশকে চাকরিতে নতুন যোগদানকারী নারীদের কাছে পুসি-বো ব্লাউজ হয়ে উঠেছিল করপোরেট পোশাক। বলা যায়, নারীবাদে দ্বিতীয় ঢেউ তুলেছিল পুসি-বো।
যদিও নারীর ক্ষমতায়ন ওই চাকরি হওয়া পর্যন্তই সীমিত ছিল। কর্মক্ষেত্রে সমান অধিকার ছিল না। পুরুষরা নারী সহকর্মীর পোশাক নিয়ে নীতি নির্ধারকের মতো আচরণ করতেন। যেমন ম্যালয়ী তার বইতে নিজেকে পরামর্শ দাতা করে তুলেছিলেন।
১৯৭৩ সালে সাংবাদিক হেলেন থমাসের স্ল্যাকস পরা দেখে প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন মৃদু তিরস্কার করেছিলেন। চিকন ও সোজা মাপের এই প্যান্ট পরা নারী সাংবাদিকের উদ্দেশে প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন বলেছিলেন, তিনি (রিচার্ড নিক্সন) কাউকে পোশাক পরা দেখতে পছন্দ করেন।
পুরুষের দুনিয়ার নারীর পোশাক
“আমরা সুটের সঙ্গে স্কার্ট আর জ্যাকেট পরতাম। শার্টে বোতাম লাগাতাম আর একটা ছোট বো টাই বাঁধতাম।”
২০১৩ সালের ‘মেকার্স: ওমেন হু মেক আমেরিকা’ তথ্যচিত্রে এ কথা জানালেন প্রক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বলের প্রথম নারী কর্মকর্তা মেগ হুইটম্যান।
তিনি আরও বলেন, “পুরুষের টাইকে নারীর পোশাকে রূপান্তরের সময় এমন একটা ব্যাখ্যা দেখাতে হয়েছিল নারীকে। আসলে পুরুষের সমাজে নিজেকে মানিয়ে নিতে নারীকে এভাবে চেষ্টা করতে হয়েছে।”
শত শত দশক পরে অর্থ্যাৎ আজকের দিনে কর্মক্ষেত্রে আগের মতো মতো লিঙ্গ বৈষম্য নেই। এরপরও উঁচু পদে থাকা নারীর জন্য পুসি-বো নিরাপদ পোশাকের প্রতীক হয়ে আছে।
“এর অর্থ দাঁড়িয়েছে, আমি একজন পেশাজীবী, এর সঙ্গে নিজেকে আরেকটু নমনীয় করে তোলা।”
জুমে দেয়া বক্তব্যে নিউ ইয়র্কের মেয়েদের পোশাক নকশাকারী নিনা ম্যাকলেমোর সিএনএনকে বলেন, “আপনি যদি একটু বেশি পুরুষালী হয়ে ওঠেন, তাহলে আপনাকে সবাই আপদ হিসাবে দেখবে।”
নিনা ম্যাকলেমোর নকশায় পোশাক পরেছেন হিলারি ক্লিনটন থেকে এলিজাবেথ ওয়ার্নার, ডেমোক্রেটিক রিপাবলিকানের ম্যাক্সিন ওয়াটারস এবং সুপ্রিম কোর্টে বিচারক এলেনা কাগান।
“লাখ লাখ বছরের চর্চা এক শতকে মুছে যাবে না”, বললেন নিনা ম্যাকলেমোর।
পোশাক যখন পরিবর্তনের প্রকাশ
শেষ পর্যন্ত পুসি-বো শুধু কর্মক্ষেত্রের পোশাক হয়ে থাকেনি; বরং আরও সামাজিক-রাজনৈতিক বার্তা বাহক হয়ে উঠেছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্ট একবার বলেছিলেন, “মেয়েদের গোপন স্থানে হাত দেয়া দোষের কিছু নয়।”
২০১৬ সালে স্ত্রী মেলানিয়া ট্রাম্পকে গোলাপী রঙের গুচি লা ভ্যালিয়ের শার্ট পরতে দেখা যায়। অনেকেই ধারণা করেন, স্বামীর কথার প্রতিক্রিয়াতেই তিনি এই পোশাক বেছে নেন।
২০২২ সালে সাবেক প্রেমিক জনি ডেপের মানহানির মামলায় সাক্ষ্য দেয়ার দিনে পলকা বসানো সাদা পোশাকের সঙ্গে পুসি-বো টাই বেঁধেছিলেন।
সারা দানিয়াস হলেন সুইডিশ একাডেমির নোবেল কমিটি প্রধান হিসাবে নিয়োগ পাওয়া প্রথম নারী। তখন ২০ বছর ধরে একাধিক যৌন হয়রানি করেছেন এমন অভিযোগ ছিল একাডেমির এক সদস্যের বিরুদ্ধে। এর তদন্ত কাজে অবশেষে অপসারিত হন সারা দানিয়াস। ২০১৮ সালে এ নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তাকে সাদা রঙের রেশমী পুসি-বো পরতে দেখা গিয়েছিল। গোটা সুইডেনে নারীরা সারা দানিয়াসকে অপসারণের প্রতিবাদ করেছিল একই রকম নেকটাই পরে। তখন এই বো হয়ে উঠেছিল নারীর একতার প্রতীক।
“ওই প্রতীকি ব্লাউজ রীতিমত জনপ্রিয় হয়ে গিয়েছিল। ওই পোশাক হয়ে উঠল নারীবাদের প্রতীক”, বললেন জেনি সুনডেন।
সুইডেনের সোটারটর্ন ইউনিভার্সিটির জেন্ডার বিষয়ক গবেষক এই অধ্যাপক সিএনএনকে ফোনে বলেন, “সবাই এই পোশাক নিয়ে পথে নেমে গিয়েছিল। স্টকহোমের স্টক এক্সচেঞ্জের ভবনে যেখানে একাডেমি বসেছিল তার বাইরে চলছিল পুসি-বো আন্দোলন।”
প্রেক্ষাপট আলাদা মনে হলেও মেলানিয়া, মস এবং দানিয়াস তাদের পোশাক দিয়ে গোটা দুনিয়াকে মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন যে এই পুরুষদের চেয়ে তারা আলাদা।
তাদের বো টাই পোশাক বলছিল তারা নারী। তারা দায়িত্বশীল হওয়ার পরও সহজ। তারা যোগ্য এবং ভরসা করার মতো।
চাপিয়ে দেয়া পোশাক পুসিক্যাট বো?
পুসি বো নিয়ে ভিন্ন দৃষ্টিও রয়েছে। এই পোশাক কি সত্যিই নারী মুক্তির প্রতীক? না কি চাপিয়ে দেয়া পুরনো ধারণা?
“মহিলারা কর্মক্ষেত্রে এই পোশাক পরলেই তা নারীবাদের চিহ্ন হয়ে ওঠে না।”
সুনডেন এভাবেই নিজের মতামত জানালেন। তার কাছে বো-টাই একটি ‘ভারী পোশাক’।
একই সঙ্গে ‘নমনীয় ও আবেদনময়ী’ এই পোশাক নিয়ে তিনি বলেন, ”এই ব্লাউজে শরীর ঢাকা থাকে আবার শরীরের গড়ন বোঝাও যায়।”
“আমি মনে করি নারীবাদের চিহ্ন হিসাবে এ ধরনের পোশাক খুবই অদ্ভুত নির্বাচন। এই পোশাক খানিকটা হাস্যকরও।”
একই কথা বললেন ম্যাকলেমোরও।
“আমার মনে হয়, এই পোশাক কাউকে হাসানোর জন্য যথেষ্ট। আমি ভেবেছিলাম, আমেরিকায় করপোরেট দুনিয়ার যেসব সফল নারীদের আমি চিনি, শত শত কোম্পানির নির্বাহী কর্মকর্তার পদে থাকা নারীরা, তাদের মধ্যে দারুণ এক মিল রয়েছে; তাদের হাস্যরস।”