সিনেমা, পুরস্কার, প্রেমের গুঞ্জন, পায়ে পাড়া দিয়ে তর্ক ছাপিয়ে গত কয়েক বছর রাজনীতি নিয়েও সরব থেকেছেন বলিউড তারকা কঙ্গনা রানাউত। আর নিজের ‘গেরুয়া’ প্রীতি নিয়ে কখনই রাখঢাক করেননি স্পষ্টভাষী কঙ্গনা।
২০২২ সালে এক রকম ঘটা করেই লোকসভা নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দেন তিনি। তখনই তার আগ্রহ ছিল বিজেপির হয়ে মান্ডি আসনে লড়বেন ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটে।
হিমাচলের কন্যা কঙ্গনা তখনই পাকা রাজনীতিকের মতো বিরোধীদের হুঁশিয়ার করে বলেছিলেন,“হিমাচল প্রদেশ আর আম আদমি পার্টির ফাঁপা প্রতিশ্রুতিতে বোকা হবে না। হিমাচলে সবার নিজের সৌরশক্তি আছে; এখানে সবাই নিজের সবজি নিজেই ফলায়।”
নরেন্দ্র মোদীর গুণমুগ্ধ কঙ্গনার রাজনীতিক হওয়ার ইচ্ছেকে নিরাশ করেনি বিজেপি।
ভারতে লোকসভা নির্বাচনে প্রার্থীতা মঞ্জুরের পঞ্চম তালিকা ঘোষণা করেছে ক্ষমতায় থাকা দলটি। ১১১ জনের মধ্যে রয়েছেন কঙ্গনা রানাউতও।
এ বছর ১৯ এপ্রিল থেকে ১ জুন পর্যন্ত লোকসভা নির্বাচনের ভোটপর্ব চলবে। ফলাফল ঘোষণা হবে ৪ জুন। এই লোকসভা নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলই ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করবে।
এমন গুরুত্বপূর্ণ ভোটে হিমাচলের কন্যা কঙ্গনার হাতেই মান্ডি শহর তুলে দিতে চাইছে বিজেপি।
তালিকা প্রকাশের পর কঙ্গনাও এরমধ্যে ফেইসবুকে দলের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন ও ভোটারদের উদ্দেশ্যে নিজের আনুগত্য প্রকাশ করে বার্তা দিয়েছেন।
“আনুষ্ঠানিক ভাবে দলে যোগ দিতে পেরে আমি সম্মানিত এবং উচ্ছ্বসিত। আমি একজন যোগ্য কর্মকর্তা এবং বিশ্বস্ত জনসেবক হয়ে উঠতে চাই।”
‘পড়ুয়া শিক্ষার্থী’ কঙ্গনা রানাউত ১৬ বছর বয়সে বাড়ি ছাড়েন এবং রুপালি জগতে পা রাখেন।
২০০৬ সালে ‘গ্যাংস্টার: আ লাভ স্টোরি’ সিনেমা দিয়ে বলিউডে অভিষেক ঘটে তার। ওই সিনেমা তাকে ফিল্ম ফেয়ারে সেরা নবাগত অভিনেত্রী পুরস্কার পাইয়ে দিয়েছিল।
এবার ৩৭ বছর বয়সে বিজেপির টিকেটে রাজনীতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিষেক হলো কঙ্গনা রানাউতের।
চারবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, পাঁচবার ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ডস জয় করা এই অভিনেত্রী কি ভোটেও জিততে পারবেন?
হোলি উৎসব আর বিজেপির টিকেট পাওয়ার আনন্দ মিলেমিশে আবির হয়ে লেগেছে অভিনেত্রীর গালেমুখে। সাদা জামা আর মাথায় লাল টুপি পরে মান্ডিতে সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হন তিনি।
পাহাড়ি পরিবেশ ছেড়ে বলিউডে পা রেখে শুরুতে ইংরেজি নিয়ে অনেকের উপহাসের মুখে পড়তে হয়েছিল তাকে। এরপর কঠোর অনুশীলন করে ইংরেজি আয়ত্তে আনা কঙ্গনাকে যে কোনও অনুষ্ঠানে ইংরেজিতে কথা বলতে শোনা যেত। সেই কঙ্গনা বিজেপির প্রার্থীতা নিয়ে এএনআই সংবাদমাধ্যমের সামনে ঝরঝরে হিন্দিতে কথা বলে গেলেন।
শুরুতেই জানিয়ে দিলেন, ‘তারকা খ্যাতি’ নিয়ে ভাবনা একেবারে ‘ত্যাগ’ করেছেন তিনি।
জন্মভূমি তাকে আবার ডেকেছে উল্লেখ করে কঙ্গনা বলেন, “অনেক ছোট বয়স থেকেই চ্যালেঞ্জ এসেছে জীবনে … হয়তো এ কারণেই ঈশ্বর এমন শক্তি দিয়েছেন যে আপনাদের সেবা করতে পারি।
“আমি সবার কাছে কৃতজ্ঞ। আমরা প্রচার-প্রচারণায় কমতি রাখবো না। মান্ডি আসনে অনেক লোক রয়েছেন। আমরা সব লোক, ছোট ছোট সব গ্রামে পৌঁছাবো।”
“আমার নিজের এখন কোনো অস্তিত্ব নেই। দলই সব এখন আমার কাছে। দলের জয়েই আমার জয়। প্রধানমন্ত্রীর (নরেন্দ্র মোদী) জয়েই আমার জয়। আমি এখন মামুলি একজন কর্মী। আমাকে যেখানে পাঠানো হবে সেখানে যাবো।”
নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্ব ও নির্দেশনার ‘পিছে পিছে’ চলার অভিপ্রায় জানিয়ে তিনি বলেন, “আমার তো মনে হয় না যে আমি আমার নামের কারণে জয় পাবো। আমার বিশ্বাস, আমি আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সব ভালো কাজের কারণে, উনার পরিশ্রমের কারণেই জিতবো।”
২০২০ সালে অবশ্য এই কঙ্গনাই রাজনীতি আসার কোনো ইচ্ছে নেই বলে জানিয়েছিলেন। কংগ্রেস এবং বিজেপি থেকে টিকিট সাধা হলেও অভিনয় ছাড়তে তখন রাজি ছিলেন না এই তারকা।
বলেছিলেন, “একজন শিল্পী হিসেবে আমার কাছে কাজই সব। রাজনীতি নিয়ে কখনই ভাবিনি। তাই আমার স্বাধীন ভাবনা থেকে কাউকে সমর্থন দেওয়ার কারণে আমাকে নিয়ে যত ট্রল হচ্ছে সেসব এখনই বন্ধ হওয়া দরকার।”
অবশ্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও বিজেপির নরেন্দ্র মোদীর প্রতি সমর্থনের প্রকাশ তখনও দেখিয়েছিলেন কঙ্গনা।
পরের বছর ২০২১ সালে একের পর এক রাজনৈতিক টুইটের কারণে কঙ্গনার পোস্ট দেওয়া স্থগিত করেছিল টুইটার কর্তৃপক্ষ। ২০ মাস পর ২০২৩ সালে সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হলে আবারও ফেরেন এই নায়িকা। তবে ততোদিনে টুইটার হয়ে গেছে ইলন মাস্কের এক্স।
পরিবারেও রাজনীতির চর্চা ছিল কঙ্গনার। তার দাদা কংগ্রেস থেকে এমএলএ অর্থাৎ বিধানসভা সদস্য ছিলেন টানা ১৫ বছর।
আর এ কারণে প্রথম সিনেমা ‘গ্যাংস্টার’- এ অভিনয় করার পর পরই কংগ্রেস থেকে প্রতি বছর ডাক পেতেন বলে দাবি করেন কঙ্গনা।
একবার বাকবিতণ্ডার জেরে কংগ্রেস এই নায়িকাকে ‘বিজেপির দালাল’ বলেছিল।
সে কথা হেসে উড়িয়ে দিয়ে তখন টুইটে কঙ্গনা বলেছিলেন, “আমি তো বিজেপির টিকিট দুইবার ফিরিয়ে দিয়েছি। আমি কঙ্গনা রানাউত। আমার জনপ্রিয়তা এবং বাৎসরিক আয় অনেক সফল মন্ত্রী ও রাজনীতিকদের থেকেও বেশিও।”
সেই কঙ্গনা রানাউত এবার বিজেপির টিকিট পেয়ে বারবার কৃতজ্ঞতা জানাতে ভুলছেন না।
তবু মুখরা কঙ্গনা মানে একটু বিতর্ক তো আসবেই।
কঙ্গনা নাকি ২০১৯ সালে মান্ডির আসনে অনীহা দেখিয়েছিলেন। ২০২১ সালের ১৭ মার্চ পোস্ট করা কঙ্গনার সেই টুইটের স্ক্রিনশট ঘুরছে অনেক খবরে।
“আমি ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে গোয়ালিয়র (ভারতের মধ্যপ্রদেশ রাজ্যে) থেকে সুযোগ পেয়েছিলাম। এইচপি (হিমাচয় প্রদেশ) অঞ্চলে জনসংখ্যা বড়জোর ৬০ থেকে ৭০ লাখ হবে। এখানে কোনো দারিদ্র নেই, অপরাধ নেই।”
“আমি যদি রাজনীতি করি তবে এমন অঞ্চল বেছে নেবো যেখানে যথেষ্ট সংকট আছে। যেখানে আমার কাজ করার থাকবে। যেখানে আমি আমার কাজে একজন রানি হয়ে উঠতে পারবো। ক্ষুদ্র চিন্তার লোকেরা এসব বড় কথার মর্ম বুঝতে পারবে না।”
শেষ পর্যন্ত সেই মান্ডির হয়েই রাজনীতি ও ভোটের মাঠে নামতে হচ্ছে কঙ্গনাকে। এবার হোলির দিনে মান্ডিতে দাঁড়িয়ে ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগানও দিয়েছেন কট্টর বিজেপি সমর্থক কঙ্গনা।
২০১৩ সালে মুক্তি পাওয়া নারী চরিত্র প্রধান সিনেমা কুইন দিয়ে বক্স অফিস কাঁপিয়েছিলেন কঙ্গনা রানাউত। ৬০তম ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ডসে ছয়টি পুরস্কার বাগিয়ে নিয়েছিল এই সিনেমা। এরমধ্যে সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার ঝুলিতে পুরেছিলেন কঙ্গনা। সেই থেকে বলিউডেরও কুইন হয়ে ওঠেন এই নায়িকা।
এখন কঙ্গনার সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ, লোকসভা ভোটে জিতে গেরুয়া শিবিরে কুইন হয়ে ওঠা।
কংগ্রেসের টিকিটে নেহা শর্মার ‘না’?
২০১০ সালে ক্রুক সিনেমা দিয়ে বলিউডে আসেন নেহা শর্মা। ফ্যাশন ডিজ়াইনিং নিয়ে পড়াশোনা করা এই নায়িকা বরাবর পোশাকের জন্য আলোচিত ও সমালোচিত। প্রেম অথবা প্রেমের গুঞ্জন এবং সিনেমা সবই সমান তালে চালিয়ে গেছেন তিনি। হিন্দি সিনেমা ছাড়াও তেলেগু, ম্যান্ডারিন, তামিল, পfঞ্জাবি, মালয়ালম ছবিতে কাজ করেছেন।
২০২৩ সালের পর থেকে বড় পর্দায় নেহাকে দেখা যায়নি। এখন শোনা যাচ্ছে রাজনীতির পর্দায় অভিষেক হতে চলেছে তার।
নেহা শর্মার বাবা অজিত শর্মা কংগ্রেসের একজন নেতা এবং বিহারের ভাগলপুরের এমএলএ। ২০১৪ সালের উপনির্বাচন থেকে টানা তিনবার ভাগলপুর বিধানসভা আসনে কংগ্রেসের হয়ে জিতেছেন তিনি। তবে ভাগলপুর লোকসভা আসনে ১৯৮৪ সালের পর আর জয়ের মুখ দেখেনি কংগ্রেস।
এবার দল থেকে এবং খোদ অজিত শর্মাও চাইছেন নেহা শর্মা যেন লোকসভা নির্বাচনে প্রার্থী হন।
সেই আভাস দিয়ে নেহা শর্মার বাবা ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের কাছে বলেন, “কংগ্রেস আমার কন্যা নেহা শর্মাকে দলে চাইছে লোকসভা ভোটে দাঁড়াতে।
“আমি ওর সঙ্গে কথাও বলেছি। যদিও সে এখন অন্যান্য কাজ ও শুটিং নিয়ে ব্যস্ত আছে।”
কাজের চাপে নির্বাচন করার সময় নেই এখন নেহা শর্মার। সেই অপারগতার কথা জানিয়ে দিয়েছেন রাজনীতিক বাবাকেও।
“বাবা, আমি এখন ভোটের লড়াইয়ে নামতে পারবো না। যদি তুমি বা দল থেকে আমাকে পাঁচ-ছয় মাস আগে জানাতে আমি অবশ্যই নির্বাচনের মাঠে থাকতাম।”
তবে বাবা অথবা দল চাইলে এর পরের দফায় ভোটে দাঁড়াতে আগ্রহ দেখিয়েছেন নেহা শর্মা।
ভাগলপুরে আসনের জন্য কংগ্রেস ও লালুপ্রসাদের আরজেডি অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় জনতা দলের মধ্যে আসন রফার আলাপ চলছে। চূড়ান্ত ঘোষণা এলেই বোঝা যাবে শেষ পর্যন্ত রাজনীতিক বাবা ও কংগ্রেসের মন রক্ষার্থে লোকসভা নির্বাচনের জন্য সময় মেলাতে পারেন কি না বলিউডের এই নায়িকা।