Beta
মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারি, ২০২৫
Beta
মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারি, ২০২৫

কাপ্তানবাজারে প্রতিরাতের সাড়ে ৫ লাখ টাকা যায় কোথায়

ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, কাপ্তানবাজারের ১১৪টি দোকানে সোনালি মুরগি বিক্রি হয়। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, কাপ্তানবাজারের ১১৪টি দোকানে সোনালি মুরগি বিক্রি হয়। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
[publishpress_authors_box]

কাপ্তানবাজার, ঢাকা শহরের মুরগির প্রধান পাইকারি বাজার। প্রত্যেক রাতে ঢাকা শহরের খুচরা বাজারের চাহিদা মেটায় এই বাজার। কিন্তু কোনও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় এই পাইকারি বাজার না চলায়, এই বাজার নিয়ে উঠেছে বড় ধরনের চাঁদাবাজির অভিযোগ।

প্রত্যেক রাতে মুরগি ব্যবসায়ীর কাছ থেকে দোকান ভাড়া বাবদ যে টাকা আদায় করা হয়, সেই টাকার একটা বড় অংশ, সাড়ে ৫ থেকে প্রায় ৬ লাখ টাকা কোথায় যায়, তা নিয়ে রয়েছে ধোঁয়াশা।

কাপ্তানবাজারের ব্যবসায়ীরা বলছেন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ‘খাস আদায় উপ কমিটি’র নামে এই টাকা উঠানো হয় নামমাত্র রসিদে। প্রায়ই এই টাকা বাড়িয়ে ধরা হয় সুনির্দিষ্ট কোনও কারণ ছাড়াই।

এর প্রভাব পড়ছে মুরগির পাইকারি দামে; খুচরায় বাড়ছে দাম। তাই চাঁদাবাজি বন্ধে, মুরগির দাম কমাতে কাপ্তানবাজারের ইজারা চাইছেন এসব পাইকারি ব্যবসায়ী।

ডিএসসিসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, কাপ্তানবাজার ধরে ‘কিছু বিশৃঙ্খলা’ আছে। সেগুলো দ্রুতই ঠিক হয়ে যাবে। এর অংশ হিসেবে বাজার ব্যবস্থাপনার জন্য এরই মধ্যে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে।

তবে দোকান ভাড়া বাবদ কারণ ছাড়াই অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের ব্যাপারে অবগত নন বলেও দাবি করছেন সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা।

ব্যবসায়ীরা সকাল সন্ধ্যাকে জানিয়েছেন, ডিএসসিসি ‘খাস আদায় উপ কমিটি’র মাধ্যমে রাজধানীতে মুরগির সবচেয়ে বড় এই বাজার তদারকি করে।

কাপ্তানবাজার পড়েছে ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যে। এখানকার কাউন্সিলার আহমেদ ইমতিয়াজ মন্নাফীর প্রতিনিধি হিসেবে রাব্বী নামে একজন রয়েছেন খাস আদায় উপ কমিটিতে। তিনি দোকান ভাড়া তোলা ও সিটি করপোরেশনে জমা দেওয়ার দায়িত্ব পালন করেন।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, কাপ্তানবাজার ধরে ‘কিছু বিশৃঙ্গলা’ আছে; দ্রুতই ঠিক হয়ে যাবে। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

তবে কাউন্সিলর আহমেদ ইমতিয়াজ মন্নাফী বলছেন, দোকান ভাড়ার টাকা নিয়ে কোনোপ্রকার ধোঁয়াশা নেই। চাঁদাবাজির কোনও বিষয় নেই।

“অভিযোগ তো আসতেই পারে। টাকাটা একজনই তোলেন না। এর জন্য একটি দল কাজ করে। তাদের খরচ আছে। এছাড়া বাজার ব্যবস্থাপনার জন্যও খরচ হয় দোকান ভাড়ার টাকা।”

বাজারে ভাড়া কত টাকা

বর্তমানে কাপ্তানবাজারে দোকান রয়েছে ২১৪টি। এর মধ্যে টিনশেড মার্কেটে রয়েছে ৫৪টি দোকান। এগুলো সারাদিনই খোলা থাকে। এছাড়া রাত ১১টা থেকে কাপ্তানবাজারের রাস্তায় বসে আরও ১৬০টি দোকান, যারা ব্যবসা করে সকাল ৬টা পর্যন্ত।

ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে সকাল সন্ধ্যা জানতে পেরেছে, এই দোকানগুলোর মধ্যে সোনালি মুরগি বিক্রি হয় ১১৪টি দোকানে। এর মধ্যে টিনশেড মার্কেটে ৫৪টি এবং রাস্তায় ৬০টি দোকান। ব্রয়লার ও লাল মুরগি বিক্রি হয় রাস্তার ৮৯ দোকানে। এছাড়া প্যারেন্টস মুরগির দোকান রয়েছে ১১টি।

এসব দোকানের ভাড়া নির্ভর করে কী ধরনের, কোন জাতের মুরগি বিক্রি হচ্ছে তার ওপর। সোনালি মুরগি বিক্রি করে যেসব দোকান তাদের প্রত্যেক দিনের ভাড়া ৪ হাজার টাকা, ব্রয়লার আর লাল মুরগি বিক্রির দোকানের ভাড়া ৩ হাজার টাকা এবং প্যারেন্টস মুরগি বিক্রির দোকান ভাড়া ৩ হাজার টাকা।

এই হিসাবে প্রত্যেক দিন সোনালি মুরগির দোকানগুলো থেকে ৪ লাখ ৫৬ হাজার টাকা, ব্রয়লার ও লাল মুরগির দোকান থেকে ২ লাখ ৬৭ হাজার টাকা এবং প্যারেন্টস মুরগির দোকান থেকে ৩৩ হাজার টাকা তোলা হয়। এই হিসাব করা হয় এক ট্রাক (পিকআপ) মুরগির ওপর। এক ট্রাকের বেশি বিক্রি করলে গুনতে হয় অতিরিক্ত এক হাজার টাকা।

সব মিলে এ হিসাবে শুধু একদিনে কাপ্তানবাজার থেকে ওঠানো হয় ৭ লাখ ৫৬ হাজার টাকা এবং মাসে ২ কোটি ২২ লাখ ৮০ হাজার টাকা।

ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, ডিএসসিসি ‘খাস আদায় উপ কমিটি’র মাধ্যমে রাজধানীতে মুরগির সবচেয়ে বড় এই বাজার তদারকি করে। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

টাকা অগ্রিম, নেই রসিদ

দোকান ভাড়ার এই টাকা প্রত্যেক দিন দিতে হয়, বিষয়টা এমন নয়। ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করে জানান, তাদের মাসের শুরুতেই এই টাকা হিসাব করে জমা দিয়ে দিতে হয়। কোনও কারণে মুরগি অবিক্রিত থাকলে, বা মুরগি আনতে না পারলেও দিন হিসাবেই দোকান ভাড়ার টাকা কেটে রাখা হয়। অগ্রিম না দিলে দোকান খোলা যায় না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমি কয়দিন বিক্রি করতে পারব, বা পারব না- এটা হিসাব না। আমাদের মাসে যতদিন, ততদিনের হিসাবে টাকা দিয়ে দিতে হয়। অগ্রিম না দিলে দোকান খোলার পারমিশন পাওয়া যায় না।”

তিনি বলেন, “কিন্তু সব ব্যবসায়ী প্রত্যেক দিন মুরগি পায় না। মাসে আমরা গড়ে ১৫-২০ দিন ব্যবসা করতে পারি। কিন্তু টাকা দিতে হচ্ছে মাস হিসাব করে, ৩০ দিন হিসাব করে।

“ফলে যেদিন আমি মুরগি বিক্রি করি, সেদিন আমাকে বেশি দামেই বিক্রি করতে হয়, লোকসান কমাতে। এই টাকাও কোনও রিসিটের মাধ্যমে নেওয়া হয় না। ডায়েরির কাগজে টুকে রাখা হয়।”

ডিএসসিসি গত বছরের ১৮ ডিসেম্বর কাপ্তানবাজারে খাস আদায় উপ কমিটি করে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে দোকান ভাড়ার টাকা সংগ্রহের জন্য। এর আগে ইজারার মাধ্যমেই চলত এই বাজার। ইজারা সংক্রান্ত জটিলতার প্রেক্ষাপটে ওই খাস আদায় উপ-কমিটি করে দেয় সিটি করপোরেশন।

নতুন করে ইজারা দেওয়ার আগ পর্যন্ত এই কমিটির কাজ করার কথা। কমিটিতে ৩৮ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের প্রতিনিধি হিসেবে রাব্বী আছেন সদস্য হিসেবে।

কত টাকা পায় সিটি করপোরেশন

সিটি করপোরেশন মুরগির এই পাইকারি বাজার থেকে কত টাকা রাজস্ব পায় তা নিয়ে আছে বিভিন্ন ধরনের বক্তব্য। ব্যবসায়ীরা বলছেন, তাদের জানামতে দিনে ১ লাখ ৯৮ হাজার যায় সিটি করপোরেশনের কাছে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, মাসের শুরুতেই পুরো মাসের টাকা হিসাব করে জমা দিতে হয় তাদের।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমরা জানি- দোকান ভাড়া বাবদ দিনে ১ লাখ ৯৮ হাজার টাকা দেওয়া হয়। কিন্তু এই টাকার পুরোটা করপোরেশন পায় কি না, তা নিয়ে গুঞ্জন রয়েছে। আমরা ব্যবসায়ী, দোকানদার। আমরা তো ভাই জানি না- এই টাকা কীভাবে, কই যায়। আমাদেরকে প্রথম সপ্তাহেই পুরো মাসের টাকা দিয়ে দিতে হয়। না দিলে দোকান খুলতে দেয় না।”

একদিনে কাপ্তানবাজার থেকে দোকান ভাড়া বাবদ ওঠানো হয় ৭ লাখ ৫৬ হাজার টাকা। এর মধ্যে ১ লাখ ৯৮ হাজার টাকা যায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কাছে। ব্যবসায়ীরা এটাই জানেন। তবে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলার আহমেদ ইমতিয়াজ মন্নাফী বলছেন, সিটি করপোরেশনে যায় ১ লাখ ৫৭ হাজার টাকা। বাকি টাকা বাজার ব্যবস্থাপনায় ব্যয় হয়।

ব্যবসায়ীদের হিসাব ঠিক ধরলে দিনে ১ লাখ ৯৮ হাজার টাকা সিটি করপোরেশনকে দিলে বাকি ৫ লাখ ৫৮ হাজার টাকা কই যাচ্ছে, কাদের কাছে যাচ্ছে- সে প্রশ্ন উঠেছে। আর কাউন্সিলর মন্নাফীর হিসাব ঠিক ধরলে সিটি করপোরেশনকে দেওয়ার পরও খাস আদায় কমিটির কাছে থাকে ৫ লাখ ৯৯ হাজার টাকা।

দোকানের ভাড়া নির্ভর করে কী ধরনের, কোন জাতের মুরগি বিক্রি হচ্ছে তার ওপর। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

বিষয়টি খোলাসা হওয়ার জন্য সকাল সন্ধ্যা ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট শাখায় যোগাযোগ করলেও মুখ খোলেননি কর্মকর্তারা। করপোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা কাইজার মোহাম্মদ ফারাবী কাপ্তানবাজারে ‘কিছু বিশৃঙ্খলা’ থাকার কথা স্বীকার করলেও রাজস্ব আদায় সংক্রান্ত কোনও তথ্য দেননি।

কাইজার মোহাম্মদ ফারাবী বলেন, “কিছু বিশৃঙ্খলা আছে বাজারজুড়ে। কিন্তু এরকম তথ্য আমাদের কাছে নেই যে অতিরিক্ত টাকা আদায় হচ্ছে। আমরা খোঁজ নিয়ে দেখব।”

তিনি বলেন, “আমরা বাজারের ইজারার জন্য এরই মধ্যে টেন্ডার দিয়েছি। ইজারা জটিলতা মিটে গেলে এরকম অভিযোগ আর আসার জায়গা থাকবে না।” 

গত ডিসেম্বরে খাস আদায় উপ-কমিটি দায়িত্ব নেওয়ার পর দুইবার টেন্ডার হয়েছে। প্রথমে চলতি বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি। ইজারার মূল্য নির্ধারিত হয় ৩ কোটি ৬৭ লাখ ৯২ হাজার টাকা। কোনও এক অজানা কারণে টেন্ডার বাতিল করে পুনরায় একই মূল্যে টেন্ডার দেওয়া হয় চলতি মাসের ১৪ তারিখে।

কেন আগের টেন্ডার বাতিল করা হয়েছে তা নিয়ে পরিষ্কার কোনও বক্তব্য পাওয়া যায়নি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা কাইজার মোহাম্মদ ফারাবীর। বিষয়টি এড়িয়ে যান তিনি। তবে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, ‘পছন্দের লোক’ ইজারা পায়নি বলেই বাতিল হয়েছে টেন্ডার।

অতিরিক্ত টাকা বাজারের কাজেই লাগে, দাবি কমিশনারের

প্রত্যেক রাতে বাড়তি যে ৫-৬ লাখ টাকা আদায় করা হয় সেই টাকা কোন খাতে খরচ হয়- সকাল সন্ধ্যার এমন প্রশ্নে ওয়ার্ড কাউন্সিলার আহমেদ ইমতিয়াজ মন্নাফী বলেন, “রাব্বী খাস কমিটির লোক। সে টাকা উত্তোলন করে। একা তো করা সম্ভব না; আরও অনেকে আছে। তাদের খরচ আছে। এছাড়া বাজার ব্যবস্থাপনায় খরচ হয়।”

কাপ্তানবাজারে প্যারেন্টস মুরগির দোকান রয়েছে ১১টি। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

ব্যবসায়ীরা বলছেন, অতিরিক্ত টাকা আদায় করা হচ্ছে, যা আসলে চাঁদাবাজি। এই চাঁদাবাজিতে কাউন্সিলর মন্নাফীর প্রত্যক্ষ মদদ রয়েছে বলেও অভিযোগ করেন ব্যবসায়ীরা।

এ অভিযোগ অস্বীকার করেন ওয়ার্ড কাউন্সিলার ইমতিয়াজ মন্নাফী। তিনি বলেন, “অভিযোগ করার তো লোকের অভাব নেই। কিন্তু চিন্তা করেন, এখান থেকে সরকার কোনও রাজস্ব পেত না। এখন আমরা তৎপরতা শুরু করার পর সরকারের কাছে রাজস্ব যায়।”

বাজার নিয়ে চিন্তিত দাবি করে কাউন্সিলর মান্নাফী বলেন, “এই বাজার বন্ধ করে দিলেই সবচেয়ে ভালো। অন্য জায়গায় নিয়ে গেলে আমার ওপর থেকে চাপ কমে।”

চাঁদাবাজি বন্ধে, মুরগির দাম কমাতে ইজারা চান ব্যবসায়ীরা

ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাজারের ইজারা বাজারের ব্যবসায়ীদের হাতে দিলেই বাজার সুস্থ থাকবে। চাঁদাবাজি বন্ধ হবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী বলেন, “আমাদের হাতে তো ইজারা দিতে চায় না। কারণ আমরা ব্যবসায়ীদের পক্ষে কাজ করব, চাঁদাবাজি হতে দিব না। নিয়ম মাফিক কাজ হবে।”

চাঁদাবাজির প্রভাব পরোক্ষভাবে ভোক্তার ওপর পড়ছে মন্তব্য করে এই পাইকারি ব্যবসায়ী বলেন, “এই চাঁদাবাজির টাকা তো আমাদের অতিরিক্ত দামে মুরগি বিক্রি করেই ব্যালান্স করতে হয়। এই টাকা আদায় না হলে আমরা আরও দাম কমিয়ে বিক্রি করতে পারি। তাহলে ভোক্তাও কম দামে মুরগি পেত।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত