বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ভারতের আসাম রাজ্যের বরাক উপত্যকায় করিমগঞ্জ জেলার নাম পাল্টে শ্রীভূমি করা হয়েছে। এর কারণ হিসেবে রাজ্যের বিজেপি সরকার বলছে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চেয়েছিলেন করিমগঞ্জের নাম শ্রীভূমি হোক। নিজের এক কবিতায় তিনি সেই ইচ্ছার কথা জানান।
তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ইচ্ছাপূরণ করতেই করিমগঞ্জের নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
যদিও ইতিহাসবিদেরা বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের মতে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার কোনও কবিতায় এমন ইচ্ছার প্রকাশ ঘটাননি।
টাইমস অব ইন্ডিয়া জানিয়েছে, আসামের মন্ত্রিসভা মঙ্গলবার করিমগঞ্জের নাম বদলের অনুমোদন দেয়।
অনুমোদনের পর রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও বিজেপি নেতা হিমন্ত বিশ্ব শর্মা সোশাল মিডিয়া এক্সে দেওয়া এক পোস্টে বলেন, “কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক শতাব্দীরও বেশি সময় আগে আজকের করিমগঞ্জ জেলাকে শ্রীভূমি বলেছিলেন, যেখানে মা লক্ষ্মী বাস করেন।”
আসামের মুখ্যমন্ত্রী মনে করেন, রাজ্যের সর্বদক্ষিণের জেলার নাম পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে তার আগের গৌরব ফিরিয়ে আনা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে আসামের জনগণের দীর্ঘদিনের দাবি পূরণ হয়েছে।
তিনি বলেন, “করিমগঞ্জের নাম পাল্টে শ্রীভূমি করার সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে জেলার মানুষদের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটবে।”
বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে বলা হয়, মঙ্গলবার করিমগঞ্জ জেলার নাম পরিবর্তনের ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে উল্লাসে মেতে ওঠে বিজেপি ও তাদের সহযোগী সংগঠনের কর্মী-সমর্থকরা। করিমগঞ্জে দলীয় কার্যালয়ে তারা বাজিও পোড়ায়।
তবে করিমগঞ্জের জনগণের একাংশ এই নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ। সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলা লাগোয়া ওই জেলার প্রায় ৫৫ শতাংশ মানুষই মুসলমান।
তাদের ভাষ্য, করিমগঞ্জ নামটি ঐতিহাসিক। সেখানকার এক জমিদারের নামে জেলার এই নামকরণ করা হয়। এই নাম বদলের জোরালো দাবি কখনই ওঠেনি। কেবল হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো নানা সময়ে করিমগঞ্জের নাম পাল্টে শ্রীভূমি রাখার দাবি তুলে আসছিল।
বিজেপি নেতাদের দাবি কতটা সঠিক
আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মাসহ বিজেপির নেতাদের দাবি, শ্রীভূমি নামটি মূলত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরই দেওয়া।
তাদের এই দাবি নাকচ করে দিয়ে ইতিহাসবিদরা বলছেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একবার ১০ লাইনের নামহীন এক কবিতা লেখেন, যেখানে শ্রীভূমির উল্লেখ আছে। কিন্তু সেটা তিনি লেখেন ১৯৪৭ সালে দেশভাগের আগে অবিভক্ত সুরমা উপত্যকার সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শ্রীভূমি নাম কখনোই করিমগঞ্জ জেলাকে বর্ণনা করতে লেখেননি বলে একাধিক ইতিহাসবিদের ভাষ্য।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতাটিতে শ্রীভূমির উল্লেখ আছে এভাবে- ‘মমতাবিহীন কালস্রোতে/ বাঙলার রাষ্ট্রসীমা হোতে/ নির্বাসিতা তুমি / সুন্দরী শ্রীভূমি…’
এই কবিতার প্রেক্ষাপট তুলে ধরে আসাম ইউনিভার্সিটির প্রথম ও সাবেক উপাচার্য ইতিহাসবিদ জয়ন্ত ভূষণ ভট্টাচার্য বলেন, “১৯১৯ সালে সিলেট বা শ্রীহট্ট যাওয়ার পথে রবীন্দ্রনাথ একবারই করিমগঞ্জে এসেছিলেন। তখন সেটা ছিল সুরমা ভ্যালি ডিভিশন।
“ট্রেনে আসার পথে সুরমা ভ্যালির সৌন্দর্য দেখে এবং মূল বাংলা থেকে নির্বাসিত অর্থাৎ বাংলা থেকে সিলেট এবং কাছাড়কে বের করে নিয়ে আসামের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার কষ্ট থেকেই রবীন্দ্রনাথ ওই পঙক্তিটি লেখেন। করিমগঞ্জ স্টেশনে তিনি কিছুক্ষণ ছিলেন ঠিকই, তবে সেখানে বসেও কবিতাটি লেখেননি তিনি।
“তাই করিমগঞ্জকে রবীন্দ্রনাথ শ্রীভূমি হিসেবে বর্ণনা করেছেন বা তার স্বপ্ন ছিল শ্রীভূমি নামটি, এই আখ্যানের কোনও ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই।”
করিমগঞ্জের ইতিহাস গবেষক বিবেকানন্দ মহন্তও ইতিহাসবিদ জয়ন্ত ভূষণ ভট্টাচার্যের সঙ্গে একমত পোষণ করেন।
তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, “রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিলং থেকে গুয়াহাটি হয়ে ট্রেনে বদরপুর হয়ে করিমগঞ্জ যান ১৯১৯ সালের ৪ নভেম্বর। সেই ট্রেনের নাম ছিল সুরমা মেইল।
“কবিগুরুকে স্টেশনেই সংবর্ধনা দেওয়া হয় স্থানীয়দের উদ্যোগে। যে ট্রেন মাত্র ৩ মিনিট থামার কথা, তা সেদিন থেমেছিল প্রায় ২৫ মিনিট।
“সেখান থেকে ট্রেনটি পৌঁছায় কুলাউড়া জংশন স্টেশনে। এখন সেটি বাংলাদেশে। ওই স্টেশন থেকে তখন সবেমাত্র সিলেট শহরে যাওয়ার একটি রেললাইন বসেছে।
“রাতে ওই লাইনে ট্রেন চলত না। তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ট্রেনেই রাত কাটান এবং পরের দিন সকাল সাড়ে ৯টার দিকে সিলেট শহরে পৌঁছান। বাংলাদেশের কুলাউড়া জংশনে রবীন্দ্রনাথের আগমনকে স্মরণ করে একটি বিরাট হোর্ডিং আমি দেখে এসেছি।”
বিবিসি বাংলা জানিয়েছে, করিমগঞ্জ জেলা হিসেবে স্বীকৃতি পায় ১৯৮৩ সালে। তার আগে এটি মহকুমা শহর ছিল। দেশভাগের আগে অবশ্য সিলেট জেলার অন্যতম মহকুমা ছিল করিমগঞ্জ, সেই ১৮৭৮ সাল থেকে।
করিমগঞ্জ নামের ইতিহাস সম্পর্কে বিবেকানন্দ মহন্ত বলেন, “আনুষ্ঠানিকভাবে করিমগঞ্জ মহকুমা হয় ১৮৭৮ সালে। এই অঞ্চলে মুহম্মদ করিম চৌধুরী নামে এক ছোট জমিদার ছিলেন। তার নাম থেকেই এলাকার নাম হয় করিমগঞ্জ।
“আনুষ্ঠানিকভাবে করিমগঞ্জ থানার নাম এর কয়েক বছর আগে, ১৮৭৪ সালে এসেছিল। ব্রিটিশ সরকার বাংলা প্রদেশ থেকে সিলেট আর অন্য প্রান্তে রংপুর থেকে গোয়ালপাড়াকে সরিয়ে এনে আসাম প্রদেশের সঙ্গে জুড়ে দেয়।
“১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় দাবি ওঠে, সিলেটকে বাংলার সঙ্গে আবারও যুক্ত করে দিতে হবে। বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাব রদ হয়ে গেলেও সিলেট কিন্তু আসামেই থেকে যায়।”
এরপর ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় সিলেট পাকিস্তানে যাবে নাকি ভারতে, তা নির্ধারণ করতে গণভোট হয়।
সেই ভোটে আসামের কংগ্রেস নেতারা মুসলমানপ্রধান সিলেটকে নিজেদের রাজ্যে নিতে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন না বলেই ইতিহাসবিদরা মনে করেন।
অন্যদিকে মুসলিম লীগ সিলেটকে পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত করতে চায়। শেষ পর্যন্ত সিলেটের অধিকাংশ মানুষ পাকিস্তানের পক্ষেই ভোট দেয়।
তবে র্যাডক্লিফ লাইন সিলেটের একটি অংশকে আলাদা করে দেয় – ভারতের দিকে আসে সিলেটের করিমগঞ্জ অংশটি।
বিবেকানন্দ মহন্ত বলেন, “সিলেটে সেসময় ৬টি থানা ছিল। এর মধ্যে সাড়ে ৩টি থানা ভারতে আর আড়াইটা থানা পাকিস্তানের দিকে যায়। ওই সাড়ে ৩টি থানা নিয়েই আজকের করিমগঞ্জ জেলা।”