বাফুফে ভবনের দিকে তাকিয়ে পথ চলতি মানুষ এখন বিদ্রুপের হাসি হাসে। এটি নামে ফুটবলের, আড়ালে হয়ে গেছে ‘বাংলাদেশ ফলস অ্যান্ড ফরসারি’ ভবন। ফিফার তদন্ত রিপোর্টে বহু ব্যবহৃত ফলস অ্যান্ড ফরসারি শব্দ দুটোও কাকতালীয়ভাবে মানিয়ে গেছে হালের বাফুফের (বিএফএফ) সঙ্গে। তাই এই ভবনে চকচকে গাড়ি চেপে আসা কর্তাদের ঘিরে জনমানুষের ঘোরতর সন্দেহ সংশয়।
২০২৩ সালের এপ্রিলে বাফুফের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবু নাইম সোহাগকে ফিফা নিষিদ্ধ করেছিল দুর্নীতি ও জালায়াতির জন্য। বছর ঘুরতেই শাস্তির তালিকা আরও লম্বা হয়েছে। যোগ হয়েছে আরও তিন জনের নাম। তাতে উল্লেখযোগ্য সংযোজন বাফুফের সিনিয়র সহ সভাপতি ও ফিন্যান্স কমিটির চেয়ারম্যান আব্দুস সালাম মুর্শেদী। তাকে দায়িত্বে অবহেলার জন্য ১৩ লাখ টাকা জরিমানা করে ফিফা। তাহলে ফিফার তদন্ত কি আস্তে আস্তে ওপরের দিকে যাচ্ছে! যেসব কেনাকাটায় ফিফা জালিয়াতি ধরেছে, ওসব কাগজপত্রের একটিতে ফিফা সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনের স্বাক্ষর আছে। দেখা গেছে, সহ সভাপতি কাজী নাবিল আহমেদের স্বাক্ষরও।
সালাম মুর্শেদীর গায়ে ফিফার কলঙ্ক দাগ
বাফুফের নানা কেনাকাটায় দুর্নীতি ও জালিয়াতির দায়ে ২০২৩ সালে সাধারণ সম্পাদক আবু নাইম সোহাগ নিষিদ্ধ হয়েছিল দুই বছরের জন্য। তখনকার ইস্যু ছিল ২০২০ সালের কেনাকাটায় অনিয়ম ও জালিয়াতি। ফিফার টাকা খরচ করার একটা নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া আছে। বাফুফে সেটা মানেইনি, উল্টো ভুয়া দরপত্র দেখিয়ে জালিয়াতি করেছিলেন সোহাগ। এবার ধরা পড়ে তার ২০২২ সালের আরও কয়েকটি জালিয়াতির ঘটনা। এজন্য গত ২৩ মে ফিফা তার বিরুদ্ধে নতুন নিষেধাজ্ঞা দেয় তিন বছরের। এই সময় কোনও ফুটবলীয় কর্মকাণ্ডে তার সংশ্রব থাকতে পারবে না।
যেহেতু বাফুফের ফিন্যান্স কমিটির চেয়ারম্যান সালাম মুর্শেদী, তাই তার বিরুদ্ধেও ওঠে অনিয়ম ও জালিয়াতির একই অভিযোগগুলো। কারণ বাফুফের ক্রয় প্রক্রিয়ায় শেষ স্বাক্ষরটি তার, একইভাবে অর্থ পরিশোধের বেলায়ও। কিন্তু তিনি দায় চাপিয়েছেন বাফুফের দুই সাবেক চাকুরে, প্রধান হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা আবু হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক সোহাগের ওপর। ১৭ বছর সিনিয়র সহ সভাপতির দায়িত্ব পালন করা সালাম ফিফাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, তার অধস্তনরা সবকিছু নিয়ম মেনে করতেন বলে নিশ্চিত করার পরই তিনি অনুমোদন দিতেন।
এছাড়াও তিনি সোহাগের বিরুদ্ধে স্বাক্ষর জালিয়াতির অভিযোগ করেছেন ফিফার কাছে। তার দাবি, সাবেক সাধারণ সম্পাদক তাকে না জানিয়ে তার স্বাক্ষর স্ক্যান করে প্রত্যেকটা ইস্যুতে ব্যবহার করেছেন। সেটা বুঝতে পেরেই সালাম মুর্শেদী ২০২৩ সালের ৫ অক্টোবর মতিঝিল থানায় লিখিত অভিযোগ করেন এবং সেই নথি ফিফার কাছেও প্রেরণ করেছেন। এটাই হয়তো তাকে ফুটবল থেকে নিষিদ্ধ হওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। তবে দায়িত্বে অবহেলার জন্য জরিমানা গুনতে হবে ১০ হাজার সুইস ফ্রাঁ (১৩ লাখ টাকা)। এটা এই ব্যবসায়ীর জন্য বড় চাপ না হলেও তার সাংগঠনিক ক্যারিয়ারে কালো দাগ লাগিয়ে দিয়েছে ফিফা।
বাফুফের তদন্ত কমিটি ‘অবৈধ’
ফিফা সোহাগকে নিষিদ্ধ করার পর বাফুফে একটা তদন্ত কমিটি গঠন করে ‘ফিফা তদন্তের অধিকতর তদন্ত’ নাম দিয়ে। নাম যেমন হাস্যকর তেমনি তার কর্মকাণ্ডও। বাফুফে সহ সভাপতি কাজী নাবিল আহমেদের নেতৃত্বাধীন এই কমিটির সবাই নির্বাহী কমিটির লোকজন। যারা এতদিন জালিয়াতকে প্রশ্রয় দিয়েছে এখন তারাই ধরবে জালিয়াতি! তদন্তের জন্য এক মাসের কথা বলে সময় নিয়েছে আড়াই মাস। তবে সেই রিপোর্ট তারা দেশে সবিস্তারে প্রকাশ করেনি।
বাহবা কুড়নোর জন্য পাঠিয়েছিল ফিফার কাছে, যারা এটাকে “বাফুফের তথাকথিত তদন্ত রিপোর্ট” হিসাবে অ্যাখ্যা দিয়েছে। ফিফার তদন্ত কমিটি এর বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে লিখেছে, “বাফুফের নির্বাহী কমিটির সঙ্গে সম্পর্কিত থাকায় বাফুফের তদন্ত কমিটি গুরুতরভাবে প্রশ্নবিদ্ধ।” ২০২৩ সালের ১৭ এপ্রিল দেশের সাংবাদিকরাও তুলেছিলেন একই প্রশ্ন। ঘরের ভেতর যখন দুর্নীতি আর জালিয়াতি তখন বাইরের অভিজ্ঞ লোকজন দিয়েই তদন্ত করানো কি সমীচীন নয়? যৌক্তিক আলাপ কাজী সালাউদ্দিনের সাধারণত ভাল লাগে না। ওই দিন বাফুফের জরুরি সভা শেষে বাফুফে সভাপতি তার নির্বাহী কমিটির লোকজনদের নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করেন। বাস্তবতা হলো কাজী নাবিলের আড়াই মাসে প্রসব করা সেই তদন্ত রিপোর্টের কোনও মূল্য নেই ফিফার কাছে!
থাকবে কেন! সোহাগের বিরুদ্ধে সালাম মুর্শেদী তার স্ক্যান করা স্বাক্ষর ব্যবহারের যে অভিযোগ তুলেছেন, কোনও প্রমাণ ছাড়াই সেটাকে সত্য মেনে নিয়েছে তদন্ত কমিটি! এই প্রেক্ষিতে ফিফার তদন্ত কমিটি বলছে, “উপস্থাপিত অভিযোগের কোনও সত্যতা যাচাই করা হয়নি। নিশ্চিত করার মতো কোনও প্রমাণ দেয়নি।” এটা কেবল একটা উদাহরণ। এরকম আরও অনেক অসঙ্গতি দেখেছে ফিফা কাজী নাবিলের নেতৃত্বাধীন কমিটির তদন্ত রিপোর্টে।
সালাম মুর্শেদীর পর কে?
২০২৩ সালে ফিফার কঠিন ধাক্কার এক বছর পর আরেকটি ধাক্কা খেয়েছে বাংলাদেশের ফুটবল। ফিফার তদন্তে এবার ২০২২ সালের জালিয়াতি সামনে এসেছে। তার সিনিয়র সহ সভাপতি সালাম মুর্শেদীকে জরিমানা করেছে ফিফা। ফুটবলকে কলঙ্কিত করার ঘটনাগুলোকে কিভাবে দেখেন, সেটা জানতে বাফুফে সভাপতিকে বারবার ফোন করেও পাওয়া যায়নি। অন্যান্যদের ফোন করে বোঝা গেছে, নির্বাহী কমিটির সদস্যরা বেশ অস্বস্তির মধ্যে আছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সদস্যের শঙ্কা, “ফুটবলের কমিটিতে থেকে মানসম্মান সবই গেছে। এটা এখন আর পরিচয় দেওয়ার মতো জায়গা নয়। ফিফা তো লেগেই আছে, কে যে কিভাবে ফেঁসে যাবে জানি না।”
আসলে ফিফা জোর করে কাউকে ফাঁসাচ্ছে না। কৃতকর্মেরই ফল ভোগ করছেন বাফুফের কীর্তিমানরা। এরপরও তারা শুধরাননি। অপকর্ম করে সাবেক বাফুফে সাধারণ সম্পাদক আবু নাইম সোহাগ নিষিদ্ধ হওয়ার পর ওই গুরুত্বপূর্ণ পদে নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া মেনে দক্ষ, ফিফার নিয়ম-নীতি বোঝা ও নিষ্ঠাবান কাউকে নিয়োগ দেয়নি বাফুফে। সভাপতি তার ব্যক্তিগত সহকারী ইমরান আহমেদ তুষারকে বসিয়েছেন সাধারণ সম্পাদক পদে। এতেই স্পষ্ট, ফিফার নিয়ম-কানুন জানার চেয়ে আজ্ঞাবহ লোকই পছন্দ বাফুফে কর্তার।
এদিকে ফিফার রিপোর্টে বিভিন্ন জায়গায় বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনের নাম এসেছে। তার স্বাক্ষরসহ কাগজপত্র ডকুমেন্ট হিসেবে উপস্থাপন করেছে ফিফা। তাহলে ফিফা-ঝড়টা কি আস্তে আস্তে তার দিকে ধাবিত হচ্ছে? এটা বলা কঠিন। তবে সালাম মুর্শেদীর দেওয়া প্রেস বিজ্ঞপ্তির শেষের প্যারার একটি বাক্যে বেশ রহস্যের গন্ধ আছে। তিনি লিখেছেন, “সভাপতি কাজী মো. সালাউদ্দিন সরাসরি জড়িত না থাকায় তাকে খারিজ করা হয়েছে।” এর অর্থ দাঁড়ায়, সালাউদ্দিন এসব জালিয়াতির সঙ্গে পরোক্ষভাবে জড়িত! পাশাপাশি প্রশ্ন হলো, ফিফা কি চিঠি দিয়েছে কিংবা সালামকে বলেছে, সালাউদ্দিনকে খারিজের কথা?
পরিশেষে
সাবেক ফুটবল তারকা আশরাফ উদ্দিন চুন্নুও মনে করেন কাজী সালাউদ্দিনের দায় এড়ানোর সুযোগ নেই, “সভাপতিকে এসব আর্থিক ফেডারেশনের জালিয়াতির দায় নিতেই হবে। অনেকে বলে, তার আশ্রয়-প্রশ্রয়ে সব হয়েছে। প্রথমত, তারা ফুটবল ধ্বংস করেছে। দ্বিতীয়ত, দুর্নীতি ও জালিয়াতির জন্য এখন বিশেষ খ্যাতি হয়েছে বাফুফের। এখনই তাদের পদত্যাগ করে ফুটবলকে রেহাই দেওয়া উচিত।”
সালাউদ্দিন করবেন পদত্যাগ? ১৬ বছর কাটিয়ে তিনি পঞ্চমবারের মতো ‘ওপর-ওয়ালার’ আশীর্বাদপুষ্ট নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ইনিয়ে-বিনিয়ে সেটা বলেছেনও, “আমি ফুটবলের সঙ্গে থাকলেই ভাল থাকব।” তার ভাল থাকার জন্য বারবার দেশের ফুটবলকেই বলি দিতে হবে! ফুটবলকে আরও কলঙ্কিত করার সুযোগ দিতে হবে!
২০২৩ সালে ফিফার শাস্তি
আবু নাইম সোহাগ
সাবেক সাধারণ সম্পাদক
২ বছর নিষিদ্ধ ও ২৬ লাখ টাকা জরিমানা
২০২৪ সালে ফিফার শাস্তি
সালাম মুর্শেদী
সিনিয়র সহ সভাপতি
১৩ লাখ টাকা
জরিমানা
আবু নাইম সোহাগ
সাবেক সাধারণ সম্পাদক
৩ বছর নিষিদ্ধ ও ২৬ লাখ টাকা জরিমানা
আবু হোসেন
সাবেক চিফ ফিন্যান্স অফিসার
২ বছর নিষিদ্ধ ও ১৩ লাখ টাকা জরিমানা
মিজানুর রহমান
সাবেক অপারেশনস ম্যানেজার
২ বছর নিষিদ্ধ ও ১৩ লাখ টাকা জরিমানা