Beta
শনিবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৫
Beta
শনিবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৫

স্টারমারের সামনে যত চ্যালেঞ্জ

যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের সঙ্গে স্ত্রী ভিক্টোরিয়া।
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের সঙ্গে স্ত্রী ভিক্টোরিয়া।
[publishpress_authors_box]

যুক্তরাজ্যের কনজারভেটিভ পার্টির অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতার খেসারত দিতে হলো দলটিকে। বৃহস্পতিবারের সাধারণ নির্বাচনে দলটি হেরে গেছে। টানা ১৪ বছর পর ক্ষমতায় এল লেবার পার্টি।

এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে কনজারভেটিভ পার্টিকে ব্রেক্সিট, মহামারী এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থির অবস্থা সামলাতে হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এত সময় ধরে কোনও পার্টি যুক্তরাজ্যের ক্ষমতায় থাকেনি।

ফলে কনজারভেটিভ পার্টির এই হার লেবার পার্টির জন্য জয় হলেও যুক্তরাজ্যের জন্য কতটা ভালো হবে তাই এখন দেখার বিষয়।

বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষকরা লেবার পার্টিকে নিয়ে সন্দিহান। তাদের মতে, লেবার পার্টি নিরঙ্কুশ জয় পেলেও তাদের জনপ্রিয়তা হারাতে সময় লাগবে না।

এর কারণ হিসেবে পর্যবেক্ষকরা লেবার পার্টির নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিগুলোর প্রতি আলোকপাত করেছেন। কারণ, যুক্তরাজ্যের এমন অনেক সমস্যা আছে যা কনজারভেটিভরা মেটাতে হিমশিম খেয়েছেন। আর এসব সমস্যা নিয়ে কোনও বক্তব্যই নেই লেবারের ইশতেহারে।

শুক্রবার জয়ের প্রাথমিক খবর প্রকাশের পরই লেবার পার্টি প্রধান কিয়ার স্টারমার সমর্থকদের নিয়ে উল্লাস প্রকাশ করেন। এসময় বিজয় ভাষণে তাকে বলতে শোনা যায়, “আমরা পেরেছি। এখন থেকে পরিবর্তন শুরু হচ্ছে।”

প্রাপ্ত ফল অনুযায়ী, যুক্তরাজ্যে বৃহস্পতিবারের নির্বাচনে হাউস অব কমন্সের ৬৫০ আসনের মধ্যে ১২১ আসনে জয় পেয়েছে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টি। নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য প্রয়োজন ছিল ৩২৬ আসন; লেবার পার্টি পেয়েছে ৪১২ আসন।

নির্বাচনের এ ফলকে কনজারভেটিভদের গত দুইশ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে দুর্বল ফল হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।

বিজয় ভাষণে কিয়ার স্টারমার আরও বলেন, “আমাদের দেশ জুড়ে মানুষ এই খবরে জেগে উঠবে, স্বস্তি পাবে যে শেষমেষ একটি ওজন নেমেছে। এই মহান জাতির কাঁধ থেকে বোঝা সরানো হয়েছে।

“আশা করা যায়, এই মুহূর্তে ব্রিটেন উজ্জ্বলভাবে জ্বলবে না, তবে আমরা আগুনকে পুনরুজ্জীবিত করার ম্যান্ডেট অর্জন করেছি। এটাই এই দলের, এই সরকারের উদ্দেশ্য।”

বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক জয়ের জন্য অভিনন্দন জানাতে ফোন করেছিলেন কিয়ার স্টারমারকে। এরপরই তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ব্রিটিশ জনগণ তাদের রায় দিয়েছে। এসময় সুনাক নির্বাচনে তাদের হার স্বীকার করে নেন।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রুস ও বরিস জনসন জনগণের আস্থা নষ্ট করার পর দেশের স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২০২২ সালে ক্ষমতায় বসেছিলেন ঋষি সুনাক। কিন্তু ক্ষমতায় থাকাকালে অনেক চেষ্টা করেও তিনি অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন করতে পারেননি।

শুক্রবারই সুনাকের পদত্যাগ করার কথা। এরপর তিনি কনজারভেটিভ বা টরি পার্টির নেতা হিসেবে কাজ চালিয়ে যাবেন কিনা তা নিশ্চিত নয়। যদি তিনি পার্টি থেকে সরে দাঁড়ান, সেক্ষেত্রে বিরোধী দলের নেতা হিসেবে নতুন কাউকে নির্বাচন করতে হবে কনজারভেটিভদের।

নির্বাচনের ফল যে লেবার পার্টির পক্ষে যাবে, তা অনুমেয় ছিল। সুনাক আগাম নির্বাচনের ডাক দেওয়ার আগেই এক বছরের বেশি সময় ধরে একাধিক জরিপে এগিয়ে ছিল লেবার পার্টি। এর কারণ ছিল কনজারভেটিভদের একাধিক কেলেঙ্কারি ও আইনি ঝামেলায় জড়িয়ে পড়া।

লেবারদের বিজয় এতটাই প্রত্যাশিত ছিল যে, কনজারভেটিভরা তাদের নির্বাচনী প্রচারের শেষ দিকে ভোটারদের স্টারমারকে ‘সুপার মেজরিটি’ না দেওয়ার ব্যাপারে সতর্ক করেছিল। কিন্তু এই সতর্কতা কোনও কাজে যে লাগেনি, তার প্রমাণ নির্বাচনের ফল।

নির্বাচনে কনজারভেটিভদের হেভিওয়েট প্রার্থীদের অনেকেই তাদের আসন ধরে রাখতে পারেননি। সাবেক প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রুস ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রী গ্রান্ট শ্যাপসও হেরেছেন।

লেবার পার্টির জয় নয়, শুক্রবার রাতের অবাক করা ঘটনা হলো যুক্তরাজ্যের ছোট দলগুলোর প্রত্যাশার চেয়ে ভালো ফল করা। মধ্যপন্থী লিবারেল ডেমোক্র্যাটরা নির্বাচনী অপ্রাসঙ্গিকতা থেকে বেরিয়ে কমন্সের তৃতীয় বৃহত্তম দল হয়ে উঠেছে। নাইজেল ফারাজের ডানপন্থী রিফর্ম ইউকে পার্টি চারটি আসন পেয়ে গ্রিনস পার্টির সমান হয়েছে। এটি এই দলের জন্য এক কথায় রেকর্ড। একই সঙ্গে যুক্তরাজ্যের রাজনীতিতে ডানপন্থীরা যে নীরবে মাঠ গোছাচ্ছে, তাও প্রকাশ্যে এসেছে।

ব্রেক্সিটের কট্টর সমর্থক ও যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মিত্র নাইজেল ফারাজ নিজেও আটবারের চেষ্টায় এবার এসেক্সের একটি আসন থেকে জয় পেয়েছেন।

লেবার পার্টি পার্লামেন্টের দুই-তৃতীয়াংশ আসন জিতেছে। তবে এটি মোট ভোটের এক তৃতীয়াংশ। ব্রিটেনের ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’ নির্বাচনী ব্যবস্থার অধীনে দলগুলোর প্রার্থীরা সর্বোচ্চ সংখ্যক ভোট পেলেই আসন জিততে পারে।

২০১৯ সালের নির্বাচনের তুলনায় এবার ভোটার সংখ্যা কম ছিল, যা ৬০ শতাংশের নিচে। এর অর্থ হলো, বিপুল সংখ্যক ভোটার ভোটদান থেকে বিরত ছিল। তারা কনজারভেটিভ ও লেবার পার্টির মধ্যে কোনও পক্ষকেই তাদের সমস্যা সমাধানে উপযুক্ত মনে করেনি।

কনজারভেটিভ পার্টি এখন বিরোধী দলের ভূমিকায়। ফলে লেবার পার্টিকে টিকে থাকতে হলে তাদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে হবে। এরমধ্যে দেশটির ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের মানোন্নয়ন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করার মতো বিষয়গুলো রয়েছে।

আগামী সপ্তাহেই ন্যাটোর ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে কিয়ার স্টারমারকে ওয়াশিংটন ডিসিতে যেতে হবে। ফলে ক্ষমতায় বসার এক সপ্তাহের মধ্যেই তাকে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে। আর তার দিকে তাকিয়ে থাকবে যুক্তরাজ্যের জনগণ।

পর্যবেক্ষকদের অনেকে শুক্রবারের নির্বাচনী ফলকে ব্রিটিশ রাজনীতির নতুন সকাল হিসেবে দেখছেন। তাদের মতে, নির্বাচনে জয়ের মধ্য দিয়ে লেবার পার্টির আসল চ্যালেঞ্জ মাত্র শুরু হলো।

চেইঞ্জিং ইউরোপ থিংক ট্যাংকের পরিচালক আনন্দ মেনন বলেন, “লেবার পার্টি অবিশ্বাস্যভাবে বিস্তৃত। কিন্তু একইভাবে দলটি অগভীরও। এমন অনেক সমস্যা রয়েছে যেগুলোকে দলটি আদতে কোনও সমস্যাই মনে করে না। অথচ সেগুলোর মুখোমুখি হতে হয় যুক্তরাজ্যকে।”

স্টারমার খুব দ্রুতই অজনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারেন বলেও মনে করেন মেনন। তার মতে, “এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তারা কীভাবে আয়কর না বাড়িয়ে দেশের প্রবৃদ্ধি ও জনগণের পরিষেবাগুলোর মান বাড়াতে পদক্ষেপ নেয়। কারণ তারা আয়কর না বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে।”

স্টারমার তার বিজয় ভাষণে স্বীকার করেছেন যে, একটি দেশের পরিবর্তন সুইচ টেপার মতো সহজ নয়। এটা অনেক কঠিন কাজ। ধৈর্য ধরে সংকল্পের সঙ্গে এই কাজ করে যেতে হয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, যুক্তরাজ্যের জনগণের কি সেই ধৈর্য আছে?

রাষ্ট্রীয় নীতিগত পরিবর্তনের মতো বড় কোনও প্রতিশ্রুতি লেবার পার্টি তাদের নির্বাচনী প্রচারে দেয়নি। যা দিয়েছে তা সব স্বল্পমেয়াদী।

পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, নির্দিষ্ট কিছু প্রতিশ্রুতি দেওয়ার ফলে লেবারদের ভুল করার সুযোগ থাকবে কম। আর ভুল করলে জনগণ প্রতিক্রিয়া জানাবে অতীতের চেয়ে অনেক দ্রুত।

তথ্যসূত্র : টাইম

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত